‘গুলতেকিন’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম একজন দুঃখীতম মানুষের অথবা একজন দুঃখীতম নারীর নাম। যিনি স্কুলপড়ুয়া কিশোরী বয়সে সম্ভাবনাময় এক তরুণ লেখকের প্রেমে পড়ে ঘরের বাহির হয়েছিলেন।
ধনীর দুলালী গুলতেকিন অল্প বয়সে হুমায়ূন আহমেদের টানাটানির সংসারে এসে নিজেকে তাদেরই একজন করে নিয়েছিলেন। এক সময়ের সম্ভাবনাময় লেখক হুমায়ূন আহমেদ সম্ভাবনার এক স্তর থেকে আরেক স্তরে পৌঁছেছেন। বিপুল খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার লেখনীর মাধ্যমেই অসম্ভব আনকমন এবং কঠিনতম ‘গুলতেকিন’ নামটি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে। তাঁর অনেক গল্পে গুলতেকিনকে পেয়েছি একজন অতুলনীয় নারী, একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে।
তার পরের কথা সবারই জানা। শীর্ষস্থান সবসময়ই পতনোন্মুখ। হুমায়ূন আহমেদও তার ব্যতিক্রম নন। কন্যার বান্ধবী শাওনকে বিয়ে করে নিন্দিত নরকে নির্বাসনে গেলেন। সেই সময়ে গুলতেকিনের প্রতি মানুষের ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। অকৃত্রিমভাবে। এক সময় সকলই ফুরায়ে যায়। গুলতেকিনও যখন মানুষের স্মৃতি থেকে প্রায় ফুরিয়ে যেতে বসেছিলেন তখন হুমায়ূন আহমেদ কালান্তক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। চিকিৎসার্থে আমেরিকায় গেলেন। মানুষের মুখে মুখে আবার রব উঠলো, গুলতেকিন কোথায়? মিডিয়াগুলো হন্যে হয়ে গুলতেকিনকে খুঁজতে লাগলো। জানা গেল, তিনি ছোট মেয়ে বিপাশার কাছে আমেরিকাতেই আছেন।
মানুষের কৌতূহলী মন কত কিছু ভাবে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, গুলতেকিন কি হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতালে একটু দেখতে যাবেন? অন্যরা উত্তর দেয়- ‘না, তিনি যাবেন কেন? হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে চরমভাবে অপমান করেছেন। তিনি যেতে পারেন না। ‘
আবার কেউ কেউ বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অন্তত একবার হলেও দেখতে যাওয়া উচিৎ। ‘ সব কথাই আম-জনতার। গুলতেকিন তার ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্বে অবিচল, অসমান্তরাল ছিলেন। তিনি ভাঙ্গেনও নি, মচকানও নি। গভীর প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে দেয়, শরৎচন্দ্রের কথাটিকে তিনি সত্য প্রমাণ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদকে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত দেখতে গিয়েছেন, কিন্তু গুলতেকিন যান নাই। দেশবাসী শোকের মাতম করে, কিন্তু গুলতেকিন নীরবই ছিলেন। খ্যাতির মোহ, প্রতিষ্ঠা কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে গুলতেকিন নামটি বাংলাদেশের মানুষের মনের কোনে আবার উকি দিয়েছে। না, এবার হুমায়ূন আহমেদের কারণে নয়। তাঁর কন্যা শীলা আহমেদ এর জন্য। দুই সন্তানের জননী শীলা তার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে আসিফ নজরুলের তৃতীয় স্ত্রী হয়েছেন। এটা এখন বাংলাদেশের রাজনীতির খবরের চেয়েও বড় খবর। সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর। চারদিকে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। কারো কারো মতে, এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে মেহের আফরোজ শাওন। শ্রদ্ধেয় লেখক ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কন্যাসম ভাতিজির জন্য বেদনা ভারাক্রান্ত মনে এক ট্যুইটার বার্তা লিখেছেন। কিন্তু বরাবরের মতো গুলতেকিন এবারও ঝিনুকনীরব। তিনি হয়তো নীরবেই সইবেন।
সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে। হুমায়ূন আহমেদের সংসারে গুলতেকিন সুখ এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু নারী জীবন সুখের হয় কার গুনে? নিশ্চয়ই স্বামীর কারণে। স্বামীর গুনে যে সুখ তিনি পেয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত আর তাঁর থাকে নি। আর নারী জীবন গৌরবের হয় সন্তানের কারণে। তাঁর তিন কন্যাই পিএইচডি করেছেন। বিয়ে-শাদী হয়েছিল। আমাদের মনে হয়েছিল সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবনটা হয়তো তিনি সন্মানজনকভাবে পার করতে পারবেন। তা কি আর হলো?
প্রিয় গুলতেকিন, আপনি কেমন আছেন? কিভাবে কাটছে আপনার দুঃখদিবস-দুঃখরজনী? আপনার কথা বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়। আপনার জন্য বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের চোখে জল এসেছে। বার বার, নানা কারণে। অনেক কারণে।
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া, nayonshakhawat@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩