ঢাকা: আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নেতৃত্ব যখন গণতন্ত্রের কথা বলে, আমাকে স্পর্শ করে না, হাস্যকর মনে হয়। গণতন্ত্র চর্চা তাদের ভেতর অবদমিত হয়েছে।
৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বাতিলের দাবিতে বিএনপি তার রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ‘মার্চ টু ডেমোক্রেসি’র ডাক দিয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় যেকোনো দল যেকোনো কর্মসূচি দেবেÑএটা স্বাভাবিক, এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে না করে, সহিংসভাবে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রতিহত করতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বলছেন, ‘মার্চ টু ডেমোক্রেসি’র নামে জামায়াত-শিবিরের নাশকতা ঠেকাতে তারা বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দেয়নি।
আমি মেনে নিচ্ছি তাদের এ বক্তব্য। উড়িয়ে দিলাম না এ নাশকতার খবর। এ নাশকতাকারীদের শক্তি বিস্তারে আওয়ামী লীগই যথেষ্ট সঞ্চার করেছে। গত পাঁচ বছরে জামায়াতের নেতাদের গ্রেফতার করা হলে আওয়ামী লীগ নেতারা তাদেরকে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের সন্ত্রাস কবলিত সীতাকুণ্ডের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারণ, এখানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রভাবশালী প্রায় সব নেতার ভাইসহ নিকটাত্মীয়রা জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী।
আমাদের রাজনীতিতে-সমাজে জামায়াত-তোষণ এবং পোষণের ফলে এখন জামায়াত সদস্যরা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের পেটাচ্ছেন। আবার সরকারের ভেতর ঘাঁপটি মেরে থাকা তাদেরই পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তান দূতাবাস ঘেরাও প্রাক্কালে শান্তিপূর্ণ-সুশৃঙ্খল অবস্থান কর্মসূচিতে অতর্কিত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের ওপর হামলা করেছেন (এতে সরকারের প্রশ্রয় নেই, তা বলা যাবে না, এখন পর্যন্ত তাদের বিচার করেনি) এসব আমাদের দেখতে হচ্ছে! অথচ আওয়ামী লীগের কাছে সুযোগ ছিল, নাশকতাকারীদের অর্থের উৎস, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, ক্যাডার বাহিনীর কাঠামো ও নেতৃত্বের কেন্দ্র নিশ্চিহ্ন করতে পারতো। তারা সেটা করেনি। মিডিয়ার সামনে এসব বন্ধ করবে বলে গলাবাজি করেছে। আর ওদিকে আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপের স্পন্সরশিপ, আইসিসি’র সহ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের কাছ থেকে সংবর্ধনা নিতে দ্বিধা করেনি।
বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়া, কিংবা মার্চ টু ডেমোক্রেসির কর্মসূচি করতে না দিয়ে সরকার নৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছে। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অসাড়। সরকার তাদের নাশকতা মোকাবেলা করতে সক্ষম না, এটা নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো হামলা! জাতীয় পতাকার সম্মান কতটা পদদলিত হয়েছে, ভাবা যায়! ধিক ধিক। এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।
বিএনপিকে এ কর্মসূচি করতে দেওয়া আওয়ামী লীগের উচিত ছিল। যদি এ কর্মসূচিকে ঘিরে সরকারের কাছে নাশকতার কোনো তথ্য থাকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতো। এ কর্মসূচি বাতিলের আহবানে যৌক্তিকতা তারা দেখাতে পারতো। আমজনতা দেখতো, বিএনপি তখন কী করছে? এরপরও তারা কর্মসূচি অব্যাহত রাখতো তাহলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের নাশকতা প্রতিহত করতো। তাহলে আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা জোরালো হতো।
একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে রাজপথে আন্দোলন করতে বলছেন, অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছেন না। ২ ঘণ্টা গাড়িতে অবস্থান করার পরও তাকে বাসায় থেকে বের হতে দেওয়া হয়নি। এসব সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে কোনো শোভনীয় আচরণ নয়। শুধু খালেদা জিয়া নয়, গত তিনদিন ধরে পুরো ঢাকা অবরুদ্ধ। এই মুহূর্তটা একটি থমথমে অবস্থা। উৎকণ্ঠা, ভীতির মধ্যে ঢাকাবাসী সময় পার করছে। এরকম নীরব ঢাকা শহর গত কয়েক বছরে দেখেনি কেউ।
জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের সমাবেশ চলছে। সেখানে পাশ দিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের কর্মীরা সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়ছেন। অথচ পুলিশের ভূমিকা অকার্যকর। পুলিশ তাদেরকে আটকাতে পারেনি। আমাদের সাংবাদিক নেতাদের কার্যক্রম দেখলে মনে হয়, তারা আসলে সাংবাদিকদের স্বার্থ নিয়ে নেতৃত্ব দেন না বা দিতে ব্যর্থ। তারা আসলে বিভিন্ন লেবাসে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। গোটা সাংবাদিক সমাজের জন্য এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
সুপ্রিম কোর্টে প্রধান ফটকের সামনে ও কোর্টের ভেতরে পুলিশের উপস্থিতিতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ওপর দফায় দফায় চড়াও হন যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা। তাদের কারো কারো হাতে লাঠি-পিস্তল দেখা গেছে। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের ছাদে আগুন দেওয়া হলো। তাদের নিলর্জ্জ আঘাতে একজন নারী আইনজীবী আহত হয়েছেন। পুলিশের সামনে একদল লোক লাঠি নিয়ে সেখানে ঢুকে যেভাবে এ নারীকে পেটালেন, সেটা কোনো সভ্য দেশের সভ্য নাগরিকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একজন আলোকচিত্রী সংবাদকর্মী ওই নারী আইনজীবীকে দূর্বৃত্তদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে এসব ঘটনা খুব ন্যাক্কারজনক এবং ভাষাহীন নিন্দনীয়। এদের হঠকারিতার দায়ও নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই।
আমরা একটি বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। খুব সহজে পেছনের ঘটনাগুলো ভুলে যাই। আওয়ামী লীগের আগামী দিনে ভরসা এখানে হতেও পারে, এখন যা ঘটছে তাও ভুলে যেতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত না। ২০০৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের লংমার্চ বিএনপিও এইভাবে নির্মূল করার চেষ্টা করেছে। সেসময় ঢাকাতেই একদিনে গ্রেফতার হয়েছেন ৮ হাজার মানুষ। ঢাকায় আসা সকল যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছিল। মতিয়া চৌধুরীকে রাস্তায় ফেলে পুলিশ দিয়ে পেটানো আর ইডেনে ছাত্রদলের নির্বিচারে ছাত্রী পেটানোর ঘটনাও ঘটেছে।
ফলে এ কথা বলা যাবে না আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযাত্রা নতুন। বরং বিএনপির কাছ থেকে তা আওয়ামী লীগের কাছে চলে এসেছে। বিএনপি যে পথ দেখিয়েছে, তাদের দেখানো সে পথেই আওয়ামী লীগও হাঁটছে। আলাদা কিছু নয়। তবে এ হাঁটায় আরো বেশি বিধ্বংসীর হুঙ্কার। এ গর্তে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকেও পড়তে হবে না তা কেই বা জানে! আজ খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ হতে হয়েছে, কাল শেখ হাসিনাকে তার চেয়েও বেশি কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে না কেই বা সেটা জানে! ইতিমধ্যে খালেদা জিয়া গোপালগঞ্জের নামই পরিবর্তন করে দেবেন বলে ফেলেছেন। জানি না কোন দিন না তিনি বাংলাদেশের নাম বদলানোর কথা বলে ফেলেন!
খালেদা জিয়া কীভাবে গণতন্ত্র রক্ষার অভিযাত্রার কথা বলছেন জানি না। তার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণগুলো বিদিত। আরও মানুষেরও তো রাগ হয়, পেট্রোলে পোড়া মুখগুলোও তো ভাবেন, এই দেশের মানুষগুলো তার আপন না। তাদের কী পাল্টে দিতে ইচ্ছে হয় শুনতে চেয়েছেন! যেদিন তিনি মার্চ টু ডেমোক্রেসির ঘোষণা দিলেন, সেদিন রাতে তার দল ও জোটের সমর্থকদের মিছিল থেকে বোমা হামলায় রাজশাহীতে পুলিশের একজন সদস্য নিহত হয়েছেন। এছাড়া সারাদেশে তাদের ঝটিকা মিছিল থেকে ককটেল, পেট্রোল নিক্ষেপ, নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
একদিকে খালেদা জিয়ার দল ও জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করছে। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে তাদের ১৮ দলীয় জোটের শরিক জামায়াত-শিবিরের দলীয় কর্মসূচি জোটের কর্মসূচিকে গিলে ফেলেছে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনের এসব সহিংসতা মুখ্য নয়। ‘যুদ্ধাপরাধী বাঁচাও’ ইস্যুটাই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির এখানেই বড় ব্যর্থতা। কারণ, জোটের কর্মসূচির স্বাতন্ত্র্য তারা বজায় রাখতে পারেনি।
এছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান পরিস্কার না। তাদের বক্তব্য, সব সময়ই জামায়াত-শিবিরের পক্ষেই ছিল। এটা তাদের জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক আদর্শিক পরাজয়। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা শুধু নয়, এবার বিএনপি যা করলো তা হলো নিজের নাক কেটে বাংলাদেশে জামায়াতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেকে বিলীন করে দেওয়া।
গত পাঁচ বছরে বিএনপি যে নিজেদের একটি ব্যর্থ দল হিসেবে প্রমাণ করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। না পেরেছে তারা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে, না পেরেছে সংসদে কোনো ভূমিকা রাখতে। আর সবশেষে গোপন জায়গা থেকে ভিডিও টেপে হরতাল-অবরোধের ঘোষণা পাঠিয়ে জনগণের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে পেট্রোল বোমা। বার্ন ইউনিটে পরিণত করেছে ঢাকা শহরকে। ফলে জোটের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা কম।
ঢাকার বাইরের সহিংস রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরাও ঢাকায় এসে গণতন্ত্র রক্ষার নামে আরো কী করবেন, সরকারের আচরণের পাশাপাশি এ নিয়েও সাধারণ জনগণ শঙ্কিত।
গত নির্বাচনে বেশ ঘটা করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, সেই ইশতেহারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘দিন বদলের সনদ’। তাদের এই সনদে তরুণদের বিশ্বাস ও আস্থা জন্মেছিল, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক চর্চাকে বদলে দেবে। একটি সুস্থধারার রাজনীতির দৃষ্টান্ত রাখবে তারা। কোথায় সেটি? তাদের মধ্যে এসব আছে এখন? বরং সহনশীল রাজনীতির পরিবর্তে প্রতিহিংসার রাজনীতি চর্চা করছে তারা। আর নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। শান্তিপূর্ণ-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর তারা হামলা করেছে। পিপার স্প্রে’র মতো মানবদেহের ক্ষতিকারক স্প্রে করেছে আন্দোলনকারীদের ওপর। যেন, যেভাবে তারা চালাবে, সেইভাবে চলতে হবে! কেউ তাদের সমালোচনা করতে পারবে না! তাদের বিরোধিতা করতে পারবে না!
এর নাম গণতন্ত্র! গণতন্ত্রের মুখে কুলুপ নির্বাচনী লাগিয়ে বৈতরণী পার হওয়া যাবে। সাময়িকভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারবে আওয়ামী লীগ। তাতে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটবে? ফলাফল যাই হোক, ইতিহাসের কাছে তাদেরকে আজীবন কলঙ্কিত থাকতে হবে। এ গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেন, আমিনুল হুদা টিটো, ডা. মিলনরা প্রাণ দিয়েছেন? আওয়ামী লীগ এখন আর এসব চেতনা ধারণ করে না, তারা বাণিজ্য করে। কারণ, তাদের জোটে সেই স্বৈরাচার এরশাদও আছেন।
আমরা খুব দেখছি, উপলব্ধিটা এখন স্পষ্ট, দুটো দলই তার স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আলাদাভাবে কোনো দলকে দেখার কিংবা পক্ষ নেওয়ার সুযোগ নেই। ক্ষমতা থাকা, না থাকা নিয়ে যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান, তাতে অকালে ঝরে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের প্রাণ। তাদের রক্তের হোলি খেলায় শিশুরাও বাদ পড়ছে না। একই সঙ্গে দেশের অথনৈতিক অবস্থার বিরূপ প্রভাব তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে গার্মেন্টস শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৫০ কোটি ডলারের ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে চলে গেছে। অন্যান্য ছোট ছোট ব্যবসায়ও লোকসানের প্রভাব পড়ছে। কৃষকের মাথায় হাত এখন। এতো কষ্ট করে তারা ফসল ফলিয়েছেন, সেই ফসল তারা বিক্রি করতে পারছেন না। দেশের মানুষের মধ্যে শান্তি নেই। সারাক্ষণ ভয়ের ভেতর আছেন তারা। এসবে হাসিনা-খালেদার কিচ্ছু যায়-আসে!
হাবীব ইমন: শিক্ষক, কবি, রাজনৈতিক কর্মী
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩