ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

হিংসার থাবা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা

গাজী মহিবুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
হিংসার থাবা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম / ফাইল ফটো

সময় এক বহতা নদীর মতো। বছর আসে বছর যায়।

হাজারো প্রত্যাশার হাতছানি দিয়ে আসে নতুন বছর। বছর যখন শেষ হয় তখন কেবলি দীর্ঘ হয় অপ্রাপ্তির তালিকা। এরকম হাজারো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই চলে জীবন, চলে রাষ্ট্র, চলে বিশ্ব। তবুও থেমে থাকে না ক্যালেন্ডারের পাতা। জীবনের সাথে সাথে চলে ক্যালেন্ডারের পাতাও। নতুন প্রত্যয় আর প্রত্যাশায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও পদার্পণ করবে এক নতুন ক্যালেন্ডার-বছরে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হলো, বাংলাদেশ বিদায়ী বছরের পাশাপাশি বিদায় জানাবে বর্তমান সরকারকেও; সেই সাথে নতুন বছরের শুরুতেই তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন হওয়ার কথা রয়েছে। নতুন বছরের শুরুতে ২০১৩ সালে বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে বিশ্বমিডিয়া। বিগত বছরের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হবে বিশ্ব, জাতি, গোষ্ঠী এমনকি ব্যক্তিমানুষও।
 
গত বছর একটি জাতীয় দৈনিকে নতুন বছরের বিশেষ ক্রোড়পত্রে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে নিবন্ধের শিরোনামে লিখেছিলাম-“ সবার উপরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। “ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বছরজুড়েই ছিল এর বিপরীত চিত্র।

বিগত হতে যাওয়া ২০১৩ সালটি ছিল বাংলাদেশের জন্য খুবই ঘটনাবহুল এবং সংকটবহুল। রাজনৈতিক অঙ্গনে বছরজুড়েই ছিল সংঘাত-সহিংসতা। দুই দলের সাপে-নেউলে সম্পর্কের বলি হয়েছে সাধারণ মানুষ। বছরের গোড়ার দিকে আন্দোলনের নামে নাশকতা একটু কম হলেও সময় যতই গড়িয়েছে সংঘাতের মাত্রা ততই বেড়েছে।

একটি হিসেবে দেখা গেছে, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শুরু হওয়া অবরোধের নামে যে নৃশংসতা হয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর নাশকতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আর এখন এই সহিংসতার মাত্রা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, শুক্রবারও বাদ যাচ্ছে না নাশকতা। জুমা‘র নামায শেষেই দেখা যাচ্ছে বাসে আগুন, অলিতে-গলিতে ফাটছে ককটেল। এবার আন্দোলনের মাঠে এক নতুন আতংকের নাম পেট্রোলবোমা। শাহবাগের নাম যেমন মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের কারণে, তেমনি এবারের অবরোধের কথা উঠলে প্রথমেই যে ঘটনাটি মানুষকে থমকে দিয়েছে সেটা শাহবাগে বাসে পেট্রোলবোমার হামলার কথা। আর ককটেল তো এখন আন্দোলনের নামে হোলি খেলার মতো এদিক-সেদিক ঢিল ছোঁড়া হয়। শাহবাগে বাসে পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ গীতা সরকারের কথা হয়তো সবারই মনে থাকার কথা। বার্ন ইউনিটে ঝলসে যাওয়া সারাদেশের মানুষের অকুন্ঠ কন্ঠস্বর হয়ে ওঠা গীতা সরকারকে প্রধানমন্ত্রী যখন দেখতে গিয়েছিলেন তখন গীতা সরকার সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন- “আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। আমরা ভালো সরকার চাই.. আমরা অসুস্থ সরকার চাই না। .. আমরা অসুস্থভাবে আমাদের সন্তানকে বড় করতে চাই না। আমরা আর অসুস্থ থাকতে চাই না, আমরা একটা ভালো সরকার চাই। আমরা তো ওদের ক্ষতি করি নাই, আমরা তো কিচ্ছু করি নাই, আমরা তো ওদের চিনিও না। আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না। আমরা যার যার সংসার নিয়ে থাকি, আমাদের কেন মারে ওরা ?
 
গীতা সরকারের মুখ দিয়ে উচ্চারিত এই কথাগুলো মূলত পুরো জাতিরই প্রশ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের রাজনীতিকদের কাছে। এই প্রশ্নগুলোর জবাব কি আছে তাদের কাছে ? তারা কি দেখে না বার্ন ইউনিটে মাছুমারা কিভাবে ক্রন্দনধ্বনিতে বাতাস ভারি করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে সকল মানবতাকে অমানবিকতায় ভাসিয়ে দিয়ে? তারা কি দেখে না কিভাবে নিরীহ মানুষের প্রাণ অকাতরে ঝরে যাচ্ছে আন্দোলনের নামে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে? আর দেখবেই বা কেমন করে। তারা যে ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলনই মানুষ হত্যা করে হতে পারে না। এ আন্দোলন কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার আন্দোলন।

২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল ৯ জনের বিচারের রায় ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে একজনের অর্থাৎ কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়েছে। যদিও ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। তারপরের কাহিনী সবারই জানা; এই রায়ের প্রতিবাদে দেশের সচেতন মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এমনই কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগে জড়ো হয়ে প্রতিবাদের সূচনা করেছিল। পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন সারাদেশে এমনকি বিদেশেও যেসব জায়গায় বাংলাদেশিদের বসবাস সেখানেও একই দাবিতে অর্থাৎ কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। জনগণের দাবির মুখে সরকার বাধ্য হয়ে সংসদে বিল পাস করে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কাদের মোল্লার (যাবজ্জীবন) রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এবং আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর সুবাদে গত ১২ ডিসেম্বর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান প্রতিকুলতা সত্ত্বেও প্রথম কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ঐতিহাসিক এই বিচারের রায় কার্যকর করা হলো। এই রায় কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তান পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যে দিয়ে কাদের মোল্লা এবং ‘কসাই কাদের’ বিতর্কের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটলো। যাদের জন্য একদিন কাদের মোল্লাকে ‘কসাই কাদের’ হতে হয়েছিল তারাই প্রমাণ করলো এই হচ্ছে সেই কাদের মোল্লা। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা ছিল বিগত ২০১৩ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি।

দেশবাসীর হয়তো সেদিনের হত্যাযজ্ঞের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। হ্যাঁ, আমি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কথাই বলছি। দেশপ্রেমিক সেইসব সেনা অফিসারকে হয়তো আমরা আর কোনোদিন ফিরে পাব না; কিন্তু দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে উপযুক্ত বিচার করতে পারলে হয়তো তাদের বিদেহী আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে—এই ছিলো প্রত্যাশা। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সেই বহুল প্রত্যাশিত বিচারও সম্পন্ন হয়েছে বিগত সালে। জানি না এই বিচার তাদের আত্মাকে কতটুকু শান্তি দিতে পেরেছে। তবে এটুকু শুধু বলতে চাই আর যেন এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ কোনোদিন বাংলাদেশের মানুষকে দেখতে না হয়।

গত বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল গণজাগরণমঞ্চের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ এনে হেফাজতে ইসলাম নামে এক সংগঠনের উত্থান। শাপলাচত্বরে হলো এদের সমাবেশ। সমাবেশকে ঘিরে নাশকতা। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের ফুটপাথে কোরআন শরিফে আগুন দেওয়া সহ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, মতিঝিলের মতো একটি বাণিজ্যিক এলাকায় লক্ষাধিক মানুষের রাতে অবস্থানকে ঘিরে তৈরি হয় এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ, সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশনের মাধ্যমে তাদের মতিঝিল থেকে বিতাড়িত করে। এবং পরে হাজার হাজার কর্মী হত্যার অভিযোগ-প্রপাগান্ডা ছড়ানো সবই ছিল গত বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনার অংশ।  

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র-সহিংস বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতার ৪২বছর পরে এসেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক আতংকের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভোটের মাঠে যেমন এদের রয়েছে একটি অবস্থান, তেমনি আন্দোলনের মাঠেও এরা সহিংসতায় প্রশিক্ষিত। এদের ছাড়া যে চলমান বিরোধীদলের আন্দোলন-সংগ্রাম নাশকতা সবই ভেস্তে যেত তা এখন হরহামেশা সবাই বলাবলি করে। বিগত বছরটি ছিল এই দলটির জন্য এক দুর্যোগকাল। গত বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন আদালত কর্তৃক বাতিল করা হয়। যদিও তারা এরই মধ্যেই এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। এই দলটির অধিকাংশ সিনিয়র নেতাই গুরুতর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং এরই মধ্যেই অনেকে সাজাপ্রাপ্ত।      

দেশে চলছে এক অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক সংকটকাল। দেশের আপামর জনগণের প্রত্যাশা ছিল সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন। এই প্রত্যাশা পূরণে সকলেই চেয়েছিলেন চলমান সংকট সমাধানে দুই দলের মধ্যে একটি সমঝোতার সংলাপ হবে এবং সকল বিরোধ মিটে যাবে। দুই দলের মধ্যে আড়ালে-আবডালে সংলাপ হয়েছে, প্রকাশ্যে দুই নেত্রীর মধ্যে ফোনালাপও হয়েছে যা পরে দেশবাসীও শুনেছে; কিন্তু কাজের কাজ যা হওয়ার তা তো হলোই না, বরং সম্পর্কের আরো একদফা বেশি অবনতি ঘটেছে। সর্বশেষ জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকোর দুতিয়ালিও ভেস্তে গেছে। এখন এক যুদ্ধংদেহী অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে দেশ। আগামী পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে এখনো রয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, আতংক। এরই মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন এমপি সাহেবরা। যেসব এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেখানে ভোটারদের মধ্যে যেমন ভোট নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই তেমনি আবার রয়েছে আতংকও। কারণ বিরোধীদল মিটিংয়ে-মিছিলে ভোট প্রতিরোধের কড়া ঘোষণা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। যদিও দেশে এরই মধ্যেই সেনা মোতায়ন করা হয়েছে। তারপরও এক অজানা ভয় তো থেকেই যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখি যে গার্মেন্টস শিল্প সেই শিল্পের জন্য বিগত বছরটি ছিল এক দুর্যোগের বছর। বছরজুড়েই ছিল শ্রমিক অসন্তোষ। কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে পুঁজি করে বা গুজব রটিয়ে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও ছিল বছরজুড়েই। মোহাম্মদপুরের স্মার্ট ফ্যাশনে আগুনে পাঁচজন মারা গেলেও আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা যায় শতাধিক যা পুরো দেশবাসীকে করেছিল শোকাহত, অতি সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ট গার্মেন্টে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের দেওয়া আগুনে কয়েক ‘শ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। আর গার্মেন্ট ট্র্যাজেডির কথা বলতে গেলে যে নামটি নিজের অজান্তেই চলে আসে সেই রানা প্লাজার কথা নিশ্চয় মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না কোনোদিন। রানা প্লাজা ধসে মানবতা যেমন চাপা পড়েছিল প্রতিটি ফ্লোরের ভাঁজে ভাঁজে, ঠিক তেমনি মানুষকে বাঁচানোর যে মানবিকতাবোধ তাও নতুনভাবে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিল উদ্ধারকারীরা-- ১৭দিন পরে রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের মধ্য দিয়ে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই চলছে অপার সম্ভাবনার গার্মেন্ট শিল্প।

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড। এই একটি হত্যাকাণ্ড যেটি বিবেক বোধ সম্পন্ন সকল মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। মানুষ ধিক্কার জানিয়েছিল এমন নৃশংসভাবে মানুষ হত্যার রাজনীতিকে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিরোধীদলের অবরোধ চলাকালে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে খুবই ন্যক্কারজনকভাবে খুন হয়েছিল বিশ্বজিৎ দাস। এ হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাসে একটি জঘন্যতম নজির হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। রাজনীতির এই মৃত্যুখেলায় বিশ্বজিৎ দাসেরা নৃসংশভাবে খুন হবে- রাজনীতির অসহায় টোপ হবে। ২০১৩ সালে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারের রায় হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে ন্যায়বিচারই হয়েছে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এই রায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে যদি উচ্চ আদালতে নি¤œ আদালতের রায় বহাল থাকে এবং ঘোষিত দণ্ড অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এই রায় কার্যকর হলে মানবতার যেমন দায়মুক্তি হবে, সেইসঙ্গে এই বার্তাটিও রাজনীতিজীবী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে: অন্যায় করে কেউ পার পায় না। সে সরকারী দলেরই হোক আর বিরোধী দলেরই হোক, কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নন।

কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। মানুষের হাতে মরছে মানুষ। কোনো রোগে নয়, কোনো শোকে নয়, রাজনীতির নৃশংসতায় চলন্ত বাসে ছুড়ে মারা পেট্রোলবোমায় ঝলসে গিয়ে মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে কাতরে মরছে মানুষ। রাজনীতির নামে আন্দোলনকারীরা রেল লাইনের ফিশপ্লেট তুলে ফেলায় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে মরছে মানুষ। জীবিকার প্রয়োজনে তাজরীন গার্মেন্টে কাজ করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে হাজারো মানুষ। রানা প্লাজায় কাজ করতে গিয়ে ভবন ধসে মানবতার নীচে চাপা পড়ে মরছে মানুষ। বাংলাদেশে গত এক বছরে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা দেখলে মনে হয়, গোটা দেশটাই যেন হয়ে উঠেছে এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই এখানে লম্বা হচ্ছে লাশের মিছিল।  

এতসব সমস্যার মধ্যেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের এই অগ্রযাত্রায় এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। আগামী পাঁচ জানুয়ারি নির্বাচন হয়ে গেলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এই নির্বাচনে যেহেতু দেশের প্রধান বিরোধীদল অংশগ্রহণ করছে না, সেহেতু স্বভাবতই এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং বিরোধীদল তাদের সেই আন্দোলনের নামে গঁৎবাধা অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাবে। বিশিষ্টজনেরা এমন ধারণাই করছেন। সেক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে একটা শংকা থেকেই যায়। দেশে এখন আর আদর্শিক রাজনীতির ছিটেফোঁটাও নেই। রাজনীতি এখন কেবলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক। ক্ষমতার জন্যই যতো আন্দোলন-সংগ্রাম। একদল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, অন্যদল ক্ষমতায় আসার জন্য সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে। আর দুই দলের সর্বনাশা খেলায় পুড়ছে মানুষ, মরছে মানুষ, পড়ছে লাশ।  

নতুন বছরকে ঘিরে মানুষের যেমন আশংকা আছে তেমনি প্রত্যাশারও কমতি নেই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নতুন বছর বাংলাদেশে টি২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে টিকেটও বিক্রি হয়ে গেছে। ক্রিকেটের এই বিশ্ব-আসরকে ঘিরে দেশের মানুষের মধ্যে এক উন্মাদনা কাজ করছে। কিন্তু দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এই আসরকে ঘিরেও তৈরি হচ্ছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের অবনতি এবং পাকিস্তান ক্রিকেট টিম বাংলাদেশে আসবে না বলে গুঞ্জন। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হয় তবে টি২০ বিশ্বকাপের মতো এই আসরটিকেও হারাতে পারে বাংলাদেশ।

কাজেই নতুন বছরের প্রত্যাশার তালিকায় খুবই সঙ্গত কারণে আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে বিশ্বকাপ টি২০ আসরটির খাতিরে হলেও যেন দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকে। কারণ ক্রিকেটই যে এখন আমাদের জাতি হিসেবে একত্রিত করার একমাত্র মাধ্যম।

দেশের আপামর জনগণ প্রত্যাশা করে, দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে উঠবে, একটি সুষ্ঠু অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে, রাজনৈতিক দলগুলো হীনমন্যতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের উন্নয়নে এক হয়ে কাজ করবে। দেশে হরতাল, অবরোধ, হানাহানি-মারামারি আর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির বদলে একটি সুন্দর, উন্নয়নবান্ধব স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে এমন প্রত্যাশাও মানুষ করে। দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষ নতুন বছরে প্রত্যাশা করে গ্রহণযোগ্য, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হবে। এবং এই বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়ে উঠবে। নতুন বছর এলেই মানুষ নতুন নতুন স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়। তারা স্বপ্ন বোনে এক সুন্দর আগামীর। স্বপ্নের ভেলায় চড়ে নিঃসন্দেহে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নচারী বাঙালি কেবলই স্বপ্ন দ্যাখে, দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে উঠবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার আপন লক্ষ্যে। এমন একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দৃপ্ত প্রত্যয়ে আমাদের রাজনীতিকদের কাছে নতুন বছরে প্রত্যাশা হোক- “ক্ষমতার জন্য আর লাশ নয়, মানুষের কল্যাণে যেন রাজনীতি হয়। “ শুভ হোক সবার আগামী।
                               
গাজী মহিবুর রহমান:  কলাম লেখক                                     

বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।