খালেদা জিয়ার গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তনের হুমকি নিয়ে চারদিকে তুলকালাম চলছে। দেশে বিদেশে যত গোপালগঞ্জবাসী আছেন প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন।
বিএনপি সমর্থক অনেকেই ভেবে বসতে পারেন যে, নেত্রী ধৈর্য সীমা অতিক্রম করে কিংবা পুলিশের উস্কানিমূলক কথাবার্তায় রেগে গিয়ে এরকম উক্তি করে বসেছেন। কিন্তু যত রাগ বা বিরক্তই তিনি হন না কেন, তিনি আসলে মনের সত্যি ভাবটাই অত্যন্ত কদর্যভাবে প্রকাশ করেছেন। গোপালগঞ্জবাসীর প্রতি তার নিখাদ বিরূপ মনোভাবই প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের নেত্রীরা দেশের ক্ষমতার শিখরে উঠে নির্লজ্জের মত নিজেদের জন্মস্থান, স্বামীর জন্মস্থান কিংবা বাপ-দাদার জন্মস্থানের ওপর অতিমাত্রায় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকেন। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, তারা আসলে বিশেষ কোনো জেলার প্রধানমন্ত্রী, পুরো দেশের নয়!
কে না জানে, খালেদা যখন ক্ষমতায় আসেন তখন বগুড়া আর ফেনীর লোকেরা সর্বক্ষেত্রে সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিসিএস ক্যাডারের সর্বক্ষেত্রে এই দুই জেলার প্রার্থীরা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, যাবতীয় উন্নয়ন বরাদ্দ এই দুই জেলায় বেশি দেখা যায়।
তেমনি হাসিনা মানেই গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জবাসী যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে সে তো সর্বজনগ্রাহ্য। তারপরও যতখানি সন্দেহ থাকে, তা তো খালেদার হুমকির মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হয়ে গেল! খালেদার বক্তব্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যে জেলা থেকে আমাদের নেত্রীরা ভোটে হেরে যান সেই জেলার প্রতি থাকে তাদের বিমাতাসুলভ মনোভাব।
গোপালগঞ্জ হাসিনার বাপের ভিটা, স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থন বেশি থাকবে। আর এজন্য গোপালগঞ্জের প্রতি খালেদা বিষোদগার করেছেন। এ অন্যায়।
হাসিনা-খালেদা যেই ক্ষমতায় আসুন না কেন, তারা পুরো দেশের উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ থাকেন। এমনকি যখন বিরোধী দলে থাকেন সেখানেও তাদের দায়বদ্ধতা কম নয়। বিরোধী নেত্রী হয়ে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হয়ে একটি বিশেষ জেলার প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করা খালেদার মোটেও উচিত হয় নি।
যে কারণেই হোক না কেন, ভুল তো ভুলই। তাই জল বেশি ঘোলা হবার আগেই, নিজের বলা এই অন্যায় হুমকির জন্য কি খালেদা জিয়া গোপালগঞ্জবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারেন না? ‘যা বলেছি ভুল বলেছি’ বলে ক্ষমা চেয়ে নেবার মধ্যে লজ্জা নয় বরং ব্যক্তি চরিত্রের সততাই প্রকাশিত হয়।
দুই
প্রতিটি পত্রিকায় অবাক হয়ে দেখলাম কিভাবে জাতীয় পতাকা লাঠির মাথায় বেঁধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান ছাত্রলীগ নামধারী বীর তরুণরা হিংস্র হয়ে একজন মধ্যবয়সী নারীকে বেধড়ক পেটাচ্ছে!
আসলে চারদিকে এত ঘটনা ঘটছে যে, অবাক হবার শক্তিও আস্তে আস্তে লোপ পেতে বসেছে। একজন নারীকে বীরদর্পে কয়েকজন ঘিরে পেটাচ্ছে!! কোথায় আমাদের নৈতিক শিক্ষা? ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির ছাড়া আমাদের কি আর কোনো পরিচয় নেই? থাকতে নেই?
কতটা নৃশংস হলে, কতটা নীতিহীন হলে, কতটা অসুস্থ সমাজের অংশ হলে প্রকাশ্যে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে জীবন দিয়ে চরম মূল্য দিতে হয়, তা আমরা টিভি পর্দায় বিশ্বজিতের মৃত্যুতে দেখেছি। বিশ্বজিতের মৃত্যুর পরও আমাদের নৈতিকতার এতটুকু উন্নয়ন হয় নি। আর হয় নি যে, তার প্রমাণ হলো আইনজীবী সিমকি ইমামের ওপর বেধড়ক লাথি ও লাঠি পেটা।
সিমকি ইমামও হয়ত আর অল্পের জন্য বিশ্বজিতের ভাগ্য বরণ করে নিতে পারতেন!! সৌভাগ্যক্রমে দায়িত্বরত সাংবাদিকেরা তাকে উদ্ধার করেছিলেন।
সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গনে মিছিল করা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, সিমকি ইমামের ভূমিকা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন থাকতে পারে। একজন নারী হিসেবে তাকে কোনো ধরনের সম্মান না দিতে পারি, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তো তিনি ন্যূনতম সম্মানজনক ব্যবহার ও নিরাপত্তা পেতে পারতেন।
কিন্তু সভ্য জগতে বাস করে একজন ব্যক্তিকে গণপিটুনির মত ন্যাক্কারজনক কাজকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড়াই করা ছাত্রলীগের পায়ের কাছে ভুলুণ্ঠিত জাতীয় পতাকার অবমাননা আমরা কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না।
ছাত্রলীগ যা করেছে অবশ্যই ভুল করেছে। একজন নারীকে রাস্তায় ফেলে বে-আব্রু করে পিটিয়ে নারীর অবমাননা, সুপ্রিমকোর্টে মারামারি করে আদালত প্রাঙ্গনের অবমাননা, তথা পায়ের কাছে জাতীয় পতাকা ফেলে জাতীয় পতাকার অবমাননার জন্য, ছাত্রলীগের মাতা শেখ হাসিনা তার ছেলেদের পক্ষ হয়ে কি দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেবেন সিমকি ইমামের কাছে? সমগ্র দেশবাসীর কাছে?
ছাত্রলীগ মাতার কাছে প্রত্যাশার পরিমাণ যদি খুব বেশি হয়ে যায় তবে অন্তত এটুকু দাবি তো জানাতেই পারি যে, হাসিনার ছাত্রলীগের এই দুষ্টু ছেলেদের অন্তত গ্রেফতার করে “যা করেছি ভুল করেছি” বলে থানায় নিয়ে গিয়ে কান-ধরে উঠ-বস করার বন্দোবস্ত করতে।
ড. জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৪