শুরুর কথা
বেশি দূর নয়, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেই অবস্থার আরেক সংস্করণের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এই সংকট, দুর্ভোগ, যন্ত্রণা জাতির কোনভাবেই প্রাপ্য ছিল না।
এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যে কারণে ‘তার মূলে হাত না দিলে’ এই পরিস্থিতি আবার হবে- এটা ইতিহাসের পরীক্ষিত সত্য। জাতীয় জীবনে আরও কিছু ক্ষতি, ধ্বংস, মৃত্যু, পঙ্গুত্ব যুক্ত করে হয়তো এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিও আমরা একদিন অতিক্রম করব। কিন্তু তারপর কি? আবারও লাশের যোগান? হ্যাঁ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা ও বৈশিষ্ট সেই কথাই বলে। এই সমস্যার তাৎক্ষণিক ও খণ্ডিত সমাধান এই বাস্তবতার দীর্ঘ মেয়াদে কোন সমাধান দেবে না। কেবল জোড়াতালি বা আপাত উপশমের সংস্কার দিয়ে নয়, প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার। প্রয়োজন সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী (Proportional Representative) ব্যবস্থার।
কেন এই ব্যবস্থা অতি গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে এই দাবি পূরণ অনেক জরুরি কেন জরুরি এখানে সেই আলোচনারই সূত্রপাত।
বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি পর্যালোচনা
তত্ত্বগতভাবে আমরা জানি যে, নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটের মাধ্যমে কোন প্রার্থীকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় কনস্টিটুয়েন্সির ভিত্তিতে `অনেক প্রার্থীর মধ্যে যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে সে জয়ী হবে` (First Past The Post-FPTP)। প্রচলিত FPTP ব্যবস্থায় সংসদে প্রাপ্ত আসনের সঙ্গে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না।
২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ৪০.২১ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ পেয়েছে মাত্র ৬২টি আসন অর্থাৎ ২১% আসন। আর বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫.১৫% ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ২০৮টি অর্থাৎ ৬৯% আসন। এখানে মাত্র ৪.৯৪% বেশি ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসনের চেয়ে ১৪৬টি বেশি অর্থাৎ ২৩৫% বেশি আসন।
এই হিসাব বলে দেয়. FPTP ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। এ ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী আসনের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জনমতের এ ধরনের অন্যায্য প্রতিফলন ঘটতে পারে।
যেমন ধরা যাক, একটি আসনে ৫ জন প্রার্থীর মধ্যে যদি তারা যথাক্রমে ২৭%, ২৬%, ২১%, ১৭% ও ৯% করে ভোট পায় তাহলে যিনি ২৭% ভোট পেয়েছেন তিনিই নির্বাচিত হয়ে `সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি` গণ্য হবেন, যদিও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট মোটেও পাননি (মানে প্রদত্ত ভোটের ৫১%)। এ ব্যবস্থায় একটি দল ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রত্যেকটিতে ২০% করে ভোট পেয়েও (মোট ভোটের ২০%) একটি আসনও না পেতে পারে, অন্যদিকে প্রধান দু`টি দল গড়ে ৪১% ও ৩৯% করে ভোট পেয়ে সব আসন পেয়ে যেতে পারে। সঙ্গতই এ ব্যবস্থা মোটেও জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করে না।
বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটা বড় ধরনের ভাওতাবাজি আছে যা আমরা অনেকেই জানি। আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখনই বলা যাবে যখন ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৫১ জন কারো পক্ষে থাকবে বা সমর্থন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শব্দের মানে হচ্ছে অধিকাংশ বা বেশিরভাগ কোন কিছু। অংঙ্ক, বিজ্ঞান, যুক্তি, তত্ত্ব সব জ্ঞানই তাই বলে।
প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এই ‘অদ্ভুত সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংজ্ঞা’ বিদ্যমান এবং তা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত আছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর রহস্যময় উদাসীনতা ও নির্বাচনের সংকীর্ণ রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই তা টিকে আছে। কিন্তু এই ভাবে জনগণকে ‘প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ’ থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের সঙ্গে ‘ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে’ প্রতারণা করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে যদি সংযোগ ঘটানো না যায় তাহলে তার পরিণতি কি হয়, বর্তমান পরিস্থিতিই এর একটি বড় প্রমাণ।
গত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ও তার বিশ্লেষণ
এবার নজর দেয়া যাক বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম) নির্বাচনের ফলাফল ও তার একটি পর্যালোচনায়। এই ৪টি জাতীয় সংসদকে বেছে নেয়া হয়েছে কারণ, এই নির্বাচনগুলো কোন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি, হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
নিচের ফিগারঃ ১ এ দেখা যাচ্ছে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩০.৮%, আর আসন পেয়েছিল ১৪০টি। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১% ভোট, আর আসন পেয়েছিল ৮৮টি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৭.৪% ভোট, আর আসনের সংখ্যা ছিল ১৪৬টি। বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ১১৬টি। ২০০১ সালে বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৪১% ভোট এবং আসন সংখ্যা ছিল ১৯৩টি। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.০২% ভোট এবং আসন সংখ্যা ছিল ৬২টি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৯.০% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ২৩০টি এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.২% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ৩০টি।
ফিগারঃ ১, বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ভোটের শতাংশ ও প্রাপ্ত আসনের তুলনামুলক চিত্র
উপরের আলোচনায় দেখলাম, গত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ভোটের শতাংশ এবং প্রাপ্ত আসনের তুলনামূলক চিত্র। এবার হিসেবটা একটু অন্যভাবে করা যাক। যদি বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এই চিত্রটা কেমন হতো?
লক্ষ্য করুণ ফিগারঃ ২, ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে আসন নির্ধারিত হলে কোন দল কতগুলো আসন পেত। টোটাল কাসটিং ভোটকে একটি ইউনিট হিসেবে ধরে বিষয়টির একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যানগত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রদত্ত ভোটকে ১০০% ধরে হিসেবটা করতে হবে। যেহেতু আসন সংখ্যা ৩০০, তাই প্রাপ্ত ভোটের হারকে (১০০x৩=৩০০) তিনগুণ ধরে আসন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র প্রাপ্ত শতাংশ ভোটে কোন দল আসলে কতগুলো করে সিট পেত?
১৯৯১ সালের ভোটের হিসেবে বিএনপি’র প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩০.৮%। সে অনুযায়ী সিট পেত ৯৩টি। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১% ভোট। সে অনুযায়ী আসন পেত ৯০টি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭.৪%। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ সিট পেত ১১৩টি, আর বিএনপি’র ভোট ছিল ৩৩.৬%। সে হিসেবে তারা আসন পেত ১০১টি। ২০০১ সালে বিএনপি’র প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪১.৪১%। সে অনুযায়ী বিএনপি আসন পেত ১২৪টি। আর আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৪০.১%। সে অনুযায়ী তারা আসন পেত ১২০টি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৯%। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ আসন পেত ১৪৭টি। বিএনপি পেয়েছিল ৩২.২% ভোট। সে হিসেবে আসন পেত ৯৯টি।
ফিগার ২, বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রাপ্য আসনের তুলনামুলক চিত্র
ভোট ও আসনের হিসেবের এই যে অন্যায্য গড়মিল এটাই এই নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি মারাত্মক ত্রুটি। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে কোনভাবেই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। যার জন্য এই নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ও পরিবর্তন জরুরি। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার করে যদি ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি’ (Proportional Representation-PR) চালু করা যায় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটবে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন কি?
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন বলতে এমন একটি ধারণাকে বুঝায় যেখানে কোন দল জাতীয় ভিত্তিক নির্বাচনে, বিশেষ করে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ধারায় কত শতাংশ ভোট পেল তার ভিত্তিতে সংসদে তাদের আসন ও অবস্থান নির্ধারিত হবে। যেমন কোন নির্বাচনে কোন দল (গ্রুপ বা ব্যক্তি) প্রদত্ত ভোটের ৩০% পেল, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই দল সংসদের ৩০% আসন অর্জন করবে। এই ব্যবস্থায় পার্টির কর্মসূচি অধিক গুরুত্ব পায় এবং পার্টিই নির্বাচনের প্রাণ হিসেবে কাজ করে।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রধানত দুই ভাবে হতে পারে। একটি হচ্ছে দলভিত্তিক, আরেকটি হচ্ছে ব্যক্তিভিত্তিক। দলভিত্তিক নির্বাচনে সেখানে কোন দলীয় প্রার্থী নির্বাচন করবে না। নির্বাচন করবে দল ও তাদের কর্মসূচি এবং নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী দল সংসদে তাদের প্রতিনিধি নির্ধারণ করবে। আবার ব্যক্তি ভিত্তিক নির্বাচনে দল পূর্বেই তাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের নাম প্রকাশ করবে। তারপর আঞ্চলিক ও জাতীয় ভিত্তিক প্রদত্ত ভোটের হার অনুযায়ী দল তাদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করবে।
যেমন নেদারল্যান্ডে দল ভিত্তিক এবং স্পেনে ব্যক্তি ভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচনী ব্যবস্থা বিদ্যমান। বিশ্বের প্রায় ৫০টির অধিক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত।
আবার অনেক দেশে দুই ব্যবস্থার (PR-FPTP) সংমিশ্রণও আছে, বাংলাদেশে একটি নীতিমালার ভিত্তিতে দুই পদ্ধতিই অনুসরণ করf যেতে পারে। অনেক দেশে উভয় পদ্ধতিই আধাআধি (PR ৫০%-FPTP ৫০%) অনুসরণ করা হয়। একই সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় ভিত্তিক ভোটের হার অনুযায়ী একটি নীতিমালার ভিত্তিতে নারীদের আসনও এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। প্রথমে নীতিগত সিন্ধান্ত নিতে হবে PR ব্যবস্থা সাধারণভাবে প্রবর্তন করার। প্রায় দুইশ’ বছর ব্রিটিশের অধীনে থাকার কারণে মানুষের কাছে এই ব্যবস্থা অধিক পরিচিত এবং অনেকের ধারণা এই পদ্ধতিই পশ্চিমা গণতন্ত্রের সব দেশে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা না, ইউরোপের প্রায় সব দেশে, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ দেশে, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কা, নেপালে এই ব্যবস্থা চালু আছে।
কেন বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি দরকার
গত ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, সরকার ও বিরোধী দলের প্রাপ্ত ভোটের রেশিও খুব কাছাকাছি থাকলেও আসন সংখ্যার ব্যবধান অনেক বেশি (ফিগার ১ ও ২)। যে কারণে অগ্রাহ্য হচ্ছে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামত। এ ব্যবস্থায় সরকারি দল সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে/কারণে একটি মীমাংসিত বিষয়কে সহজেই বাতিল বা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে অনেক জটিল ও ভয়াবহ পরিস্থিতির। একইভাবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংকট তা যতটা না জনস্বার্থ কেন্দ্রিক, তার চেয়ে অনেক বেশি দল ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক। আর এই বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুর চেয়ে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। কারণ, বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। কিন্তু তাকে কি দেশের রাজনৈতিক সংকট কিছুটা কমেছে? কার্যত তা ক্ষমতা বদলের আপত প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করেছে মাত্র। দীর্ঘ মেয়াদে একটি ব্যবস্থাকে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে কতিপয় নাগরিক ও আমলার উপর নির্ভর কোনভাবেই রাজনীতিকদের জন্য সন্মান ও নিরাপদ যেমন নয়, তেমনি সহায়ক ও সমর্থনযোগ্যও নয়। সম্পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থাই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের প্রধান উপায় হতে পারে।
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ধারা ও বৈশিষ্ট্য তাতে এই ব্যবস্থা কার্যকরা করা গেলে অনৈক্য ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি অনেকাংশে কমবে। ক্ষমতাসীন দল সব সময় জনগণের ভোটের অযুহাতে (সরকার ও বিরোধী দলের ভোটের শতাংশ যাই হোক) তাদের যে কোন কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত দেশ ও জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের পক্ষে বিবেচনায় নাগরিকদের তা মেনে নিতে বাধ্য করে। আর এই ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও মানসিকতা বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ তখন সরকার ও ক্ষমতাসীনদের সংসদে অবস্থান নির্ধারিত হবে ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদের ৯০ শতাংশের কর্তৃত্ব পেয়েছে, একই ঘটনা ঘটতে পারে বর্তমান বিরোধীদের ক্ষেত্রে, তা কি আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে না? তাহলে কেন আমরা সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে এই সংকটকে দীর্ঘ করছি? এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব ও ধারাবাহিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নটি। তাকে পাশ কাটিয়ে কেবল বর্তমান ধারায় ভোট উৎসব ও ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা তৈরি করা তাক্ষণিক চিকিৎসার কোরামিন হলেও সমস্যার দীর্ঘ মেয়াদী ও স্থায়ী সমাধান হবে না।
সংবিধানের ৭০ (১) ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কনস্টিটুয়েন্সির ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো সংসদ সদস্য দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে ভোট না দিলে বা তার বিরুদ্ধে ভোট দিলে সংসদপদ হারাবেন। এর মানে, প্রত্যেক সংসদ সদস্য শেষ বিচারে দলের সিদ্ধান্তের অধীন। কনস্টিটুয়েন্সির ভোটারদের মতামতের প্রতি দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে দলের সিদ্ধান্তের প্রতি তার দায়বদ্ধতা। পাকিস্তানি আমলে `ফ্লোর ক্রসিং`-এর মাধ্যমে সরকারকে অস্থিতিশীল করার কারসাজির অভিজ্ঞতা থেকে এরকম অবস্থা পরিহার করার উদ্দেশ্যে এই বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যদি দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিতেই হয়, তাহলে তার সঙ্গে কনস্টিটুয়েন্সি ভিত্তিক FPTP ব্যবস্থা কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারের স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে দলের প্রতি আনুগত্যকে যদি সর্বোচ্চ স্থান দিতেই হয় তা হলে PR ব্যবস্থাই তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তনে কি সুবিধা হবে
১. এতে প্রদত্ত ভোটের হার অনুযায়ী আসন বণ্টন হবে এবং ভোটের যথার্থ মূল্যায়ন হবে ২. জনমতের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ও মূল্যায়ন ঘটবে ৩. নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জনমত ও জনগণের প্রতি অধিক দ্বায়বদ্ধতা তৈরি হবে ৪. রাজনীতি হবে অধিক জনমুখী ও কর্মসূচি কেন্দ্রিক ৫. ব্যক্তি, নেতা ও পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে যৌথ নেতৃত্বের চর্চা ও গুরুত্ব বাড়বে ৬. সংসদে কোন বিল পাশ করতে হলে অন্যান্য দলের অংশগ্রহণ ও মতামত গুরুত্ব পাবে এবং সংসদে পারস্পারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভাব বৃদ্ধি পাবে ৭. গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যে কোন কর্মকাণ্ড বাধার সন্মুখীন হবে ৮. দলীয় সংকীর্ণতার মনোভাব, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সমস্যা-সংকট, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মাত্রা কমে আসবে ৯. কোন রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন হবার সুযোগ কমবে ১০. জাতীয় স্বার্থে ঐক্যমতের পরিবেশ তৈরি হবে ১১. নির্বাচনে পেশিশক্তি ও টাকার খেলা বন্ধ হবে ১২. এ ব্যবস্থায় বড় দলগুলোর বাইরেও অনেক ছোট ও বিকাশমান দল সুযোগ পাবে সরকারে অংশগ্রহণের ১৩. এতে গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রসারিত ও রাজনীতিতে প্রকৃত বহুদলয়ীয় গণতন্ত্রের চর্চা হবে ১৪. রাজনীতিতে নীতি ও আদর্শ চর্চা বাড়বে ১৫. দল তাদের অধিকতর সৎ, শিক্ষিত, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে সংসদে পাঠাবে ফলে সংসদের মান, পরিবেশ ও কার্যক্রম উন্নত হবে।
শেষ কথাঃ নির্দলীয় সরকার না সংখানুপাতিক নির্বাচন কোনটি জরুরি
আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুর চেয়ে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যকর করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিক বিশ্লেষণে বলা যায়, এই ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি হবে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক চলছে এই প্রশ্নের খণ্ডিত সমাধান আপাত স্বস্তির হলেও প্রকৃত ও দীর্ঘমেয়াদে সমাধান দেবে না। বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারা ও বৈশিষ্ট বিশ্লেষণে বলা যায়, এ ব্যবস্থা অধিক কার্যকর। এ ব্যবস্থার কারণে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া হবে অনেক কঠিন ও দুরূহ কাজ। যার ফলে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে কোন কিছু করা হবে প্রায় অসম্ভব। এবং যে কোন বিল পাশ করতেও বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এর কিছু নেতিবাচক দিক আছে, যেমন সংসদের অচলাবস্থা এবং ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন ইত্যাদি, সে ক্ষেত্রে PR-FPTP উভয় পদ্ধতির অনুসরণ বেশ কার্যকর। এই ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস লেখা হবে ভিন্নভাবে। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে দীর্ঘ সংগ্রাম, সহিংসতা ও অবিশ্বাস তা হবে অতীত বিষয়।
সারনীঃ ১, এক নজরে বিগত ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভোটসংখ্যা, হার ও প্রাপ্ত আসন এবং প্রধান দুই দলের ভোটের শতকরা ব্যবধানের হার
ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, জাপান, সাবেক ছাত্রনেতা
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১4