১.
এর আগে কখনো নির্বাচনের দিন ১৯টি মানুষকে লাশ হতে হয়নি। অভিনন্দন বাংলাদেশ।
এর আগে কোনো নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ ভোটারকে ভোট বঞ্চিত থাকতে হয়নি। অভিনন্দন বাংলাদেশ। তুমি নতুন রেকর্ড গড়েছ।
এর আগে কোনো সময় ভোটের আগুনে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়নি। অভিনন্দন বাংলাদেশ। তুমি নতুন রেকর্ড গড়েছ।
২.
ভোটের ঝামেলা শেষ। এখন সময় অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসার। আসুন, ভাসি।
আওয়ামী লীগ সমমনাদের ভাষায় এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। মুখ রক্ষার নির্বাচন। কিন্তু নিয়ম কি রক্ষা হলো! মুখ কি রক্ষা হলো!!
এক দিক থেকে অবশ্য নিয়ম রক্ষা হয়েছে। এর আগে জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়া একতরফা নির্বাচন করেছেন। সে নিয়মের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে ঠিকই। এবার শেখ হাসিনাও সেই পন্থাই অবলম্বন করেছেন।
৯৬’র ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে তিন বার (কারো কারো ভাষায় সোয়া ২ বার) প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন খালেদা জিয়া। এবার শেখ হাসিনাও তাই হতে যাচ্ছেন। নিয়মটা রক্ষা হচ্ছে বৈকি!
কিন্তু এ নিয়মগুলো রক্ষা করতে গিয়ে আমরা হারিয়েছি বহু কিছু। সেটা যে দীর্ঘমেয়াদে এ দেশটির গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কলঙ্কিত করেছে, তার দায় কে নেবেন?
নবম জাতীয় সংসদ কিংবা ৫ সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে উদাহরণ তৈরি হয়েছিলো- তাকে কি কলঙ্কিত করা হয়নি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে? কি দেখলাম আমরা এদিন?
৩.
সাধারণ ভোটাররা সাড়া দেননি এমন নির্বাচনে, এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ১৮ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে মিডিয়া মনিটরিং হয়তো সম্ভব হয়নি। তবে যেটুকু হয়েছে, তা থেকে এটা সহজে অনুমেয়- জাল ভোট হয়েছে ব্যাপক। ঢাকা -১৮ আসনের ৩টি কেন্দ্রে শেষ ঘণ্টায় মিনিটে ১৮ ভোট পড়ার খবর মিডিয়ায় যেমন এসেছে, তেমনি বগুড়া-৪ আসনের একটি কেন্দ্রে ঘণ্টায় পড়েছে মাত্র ১৮ ভোট। সারাদেশের ৩৯টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। ভোটকেন্দ্র স্থগিত করতে হয়েছে ৫৩৯টি।
সরকারের মন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগ নেতারা তারপরও বলছেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা যারা আম-আদমি, তারা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ১৫৩ আসনে যাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হলো, তারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ১৪৭ আসনে যারা ভোট দিতে যাননি, তারাও সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
৪.
শুধু কি নির্বাচন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনকেও কি খাদের কিনারে ঠেলে দেওয়া হলো না? অনেক বিতর্কের যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে নিজেদের মেরুদণ্ডহীনতা বারবার প্রকাশ করেছে ইসি। বর্তমান কমিশনের অধীনে প্রশংসনীয় ৫সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিলো। এবার হলো না, কারণ সরকার চায়নি। আর সে চাওয়াকে এড়িয়ে সঠিক কাজটা করার মতো সৎ সাহস দেখাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এমনকি সারাদেশে কত শতাংশ ভোট পড়েছে, ভোটের দিন সে তথ্যটুকু জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই ইসির অধীনে কি একাদশ নির্বাচন সম্ভব?
এবারের পুরো সঙ্কট তৈরি যে বিষয়টি নিয়ে, সেখানেও ব্যর্থ সরকার। কেয়ারটেকার পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব- দাবিটি সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো। তা কি শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেলো না? এটাই কি সরকারের সবচেয়ে বড়ো পরাজয় নয়?
এই নির্বাচনটিকে পিছিয়ে দেওয়ার স্পষ্ট সাংবিধানিক সুযোগ ছিলো। সে পথে হাঁটেনি সরকার। তারা নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে সব নিয়মকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন।
বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনগণ তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে, একথা বলার সুযোগ নেই। যে ৫৩৯টি কেন্দ্র ভোট স্থগিত করা হয়েছে, সেগুলো হয়তো তাদের সহিংসতার ক্রেডিট। কিন্তু এ কথা সত্য, অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থকও এ নির্বাচনে ভোট দেননি। জনগণ যায়নি আসলে বিবেকের তাড়নায়। কিছুটা সহিংসতার আশঙ্কায়ও।
নিয়মতো রক্ষা হলো। এবার বিরোধী দলের দুর্বল আন্দোলনের মুখে টিকেও যেতে পারেন। টিকে গেলে থাকবেন কি? দয়া করে এই ভুলটা করবেন না। দেশকে অনিবার্য পতনের হাত থেকে বাঁচাতে ঘোষণা করুন ঠিক কোন সময়ের মধ্যে আপনাদের প্রতিশ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন দেবেন। এমনকি এই ঘোষণার জন্য ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করারও প্রয়োজন নেই। না হয় ধ্বংসের শেষটুকু দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের।
লেখক: এহসান জুয়েল, সংবাদকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৪