জুবায়ের ও বিশ্বজিৎ- দুই জগতের মানুষ দু’জন। জুবায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
এই ‘প্রতিপক্ষ’ ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটা সবাই জানেন যে, বিশ্বজিতের ক্ষেত্রে পক্ষ-বিপক্ষের প্রশ্ন তোলা বাতুলতা মাত্র। কিন্তু জুবায়েরের ক্ষেত্রে মোটেও নয়। জুবায়েরের একটা প্রত্যক্ষ-পক্ষ ছিল অবশ্যই। পছন্দ-অপছন্দের এই পক্ষাবলম্বন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার জন্য যে তাকে প্রাণ দিতে হবে সেটা কে ভেবেছিল! জুবায়ের যে ভাবেন নি এটা নিশ্চিত। কারণ যখন তিনি খুন হন তখন কোন রকম রাজনীতির সঙ্গেই তার আর যুক্ততা ছিল না। পূর্ব ঘটনার জের তার পুরো জীবনকেই স্তব্ধ করে দিয়ে গেল! কিন্তু রাজনীতি করলেই কেন এমন নৃশংস আক্রোশের শিকার হতে হবে? আজকের দিনে এই প্রশ্নের খুবই জরুরি। সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোকে আমাদের সরকারগুলো ও তাদের ক্ষমতাকাঠামো ‘শিক্ষার অভয়রাণ্য’ বানাতে পারেনি। কেননা তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠনগুলোই রক্তের এই হোলি খেলায় বেশি মাতোয়ারা। নৈতিক ছাত্র আন্দোলনে নেই, শুধু মারামারি করার নামে ছাত্র রাজনীতির পচন তরান্বিত করাটাই এই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজ। এমন ঘোরতর ব্যর্থতার দায় কাঁধে না নিয়ে বরং শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য দাবি করাটা মাঝে মধ্যে হাস্যকর শোনায়! বিদ্যাপীঠগুলোকে যেদিন ‘শিক্ষার অভয়রাণ্য’ বানানো যাবে সেদিনই শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্য দাবি করা সঙ্গত।
স্পষ্ট হওয়া দরকার, ছাত্র রাজনীতি ছিল, আছে এবং থাকতেই হবে। রাজনীতির যেহেতু প্রয়োজন আছে, সেহেতু ছাত্র রাজনীতির সেই রাজনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন আছে। মারামারি-কাটাকাটি-হানাহানি কোনো রাজনৈতিক সংজ্ঞায়নের মধ্যে পড়ে না। যারা এসবের সঙ্গে জড়িত তাদের সমস্যাটা মানসিকতার। শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত নৈতিক-জ্ঞানের প্রয়োজন। এবং সে দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে।
বিশ্বজিৎ দাসের মৃত্যু-দৃশ্য আমরা দেখেছি। বিশ্বজিতকে যেভাবে মারা হয়েছে, মনে হচ্ছিল যেন আমরা কোনো ক্রিকেট খেলার ধুন্ধুমার চার-ছক্কার হাইলাইটস্ দেখছিলাম! মৃত্যু এতটা মর্মপীড়াদায়কও হয়! কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদের মৃত্যু-দৃশ্য তো আমরা দেখিনি। নির্জন জঙ্গলে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে মারা হয়েছিল। তবু চোখ বন্ধ করে বলা যেতে পারে, বিশ্বজিৎয়ের মৃত্যু-দৃশ্যর সঙ্গে জুবায়েরের কোনো দূরত্ব হয়তো নেই। পার্থক্য নেই। এই ঘটনা দু’টো মুখোমুখি সংঘর্ষ তো ছিল না। অস্ত্রের সামনে একদম একা হয়ে পড়েছিলেন তারা। কেউ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। পৃথিবীকে নিশ্চয়ই তাদের তখন নির্মম এক জেলখানা মনে হচ্ছিল। হায় সেলুকাস...!
মৃত্যুদশা জুবায়ের-বিশ্বজিৎকে এক কাতারে এনেছে সত্য, কিন্তু বিচারের বাণী পৃথকও করে দিয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর। পুরান ঢাকার চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হলো গত ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর। ঘটনার ১২ মাস পার হয়ে। যদিও মামলার বিচার করেছেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, তবুও এটা ঠিক দ্রুতসুলভ বলা যায় না!
অন্যদিকে জুবায়েরের মৃত্যু হয়েছিল বিশ্বজিৎয়ের ঠিক ১১ মাস আগে। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি জুবায়েরকে পৈশাচিকভাবে আহত করা হয়। ৯ জানুয়ারি সকালে মারা যান ঢাকার ইউনাইটডে হাসপাতালরে আইসিউতে। সেদিন থেকেই ছাত্র আন্দোলন শুরু। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীনগর’র ব্যানারে সেই ‘সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলন’ সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল- অপরাধীদেরও বিচার বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রও প্রহসন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তো করেছেই। জুবায়েরের হত্যাকারীরা তো গ্রেফতার হয়ইনি, উল্টো গ্রেফতারকৃতরা ছাড়া পেয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়, পরীক্ষা দেয়, হলে থাকে। আদালতেরও মানবিকতা নেই।
আশার কথা, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। রায় কার্যকর কবে হবে সেটা নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা থেকেই যায়। তারপরও, বিশ্বজিতেরটা যখন হয়েছে, তখন জুবায়ের হত্যাকাণ্ডেরও ন্যায়বিচার আশা করা অসঙ্গত নয়। আশা করি, জুবায়ের হত্যারও রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে ফেলবেন। কিন্তু কবে করবেন? দুই বছর যে হয়ে গেল!
বিশ্বজিৎয়েরটাই তো দ্রুতসুলভ মনে হলো না। বিশ্বজিতেরও ১১ মাস আগে খুন হওয়া জুবায়েরেরটাকে তাহলে কী বলা হবে? নাকি, রাষ্ট্র ঠিক তখনই মানবিকতা দেখায়, যখন মৃত্যুদৃশ্য বিশ্বজিতের মতো সেলুলয়েডের পর্দায় উত্তেজনা তৈরি করতে সক্ষম হয়! তাই, আমরা বিশ্বজিৎকে মনে রাখি। জুবায়েরকে ভুলে যাই!
দেখতে দেখতে জুবায়ের-হত্যা ও সেই সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের দুই বছর হয়ে গেল। দুই বছর হয়ে গেল জুবায়েরের চলে যাওয়ার! কিন্তু খুনিদের রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার নিশ্চিত হলো না! এমনদিনে জুবায়েরকে মনে পড়ে! মনে পড়ে জুবায়েরকে? জাহাঙ্গীরনগরের জুবায়ের। মৃত্যু যাকে নিঃসঙ্গ করতে পারেনি। করেছে আরও আপন। জুবায়েরের মৃত্যু সেদিন বিচ্ছিন্ন-বাউন্ডুলে শিক্ষার্থীদের `সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর` ব্যানারের মায়াতলে সঙ্ঘবদ্ধ করেছিল। প্রচণ্ড প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও ঘটিয়েছিল শিক্ষার্থীদের বিস্ফোরণ। হাতে হাত, কণ্ঠে কণ্ঠ রেখে বিচারের দাবিতে টানা ২৩ দিন হার না মানা, দুরন্ত-দুর্দান্ত লড়াই হয়েছিল। দুই বছর পরে, আজকের এই প্রচণ্ড আশাভঙ্গের কালেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষগুলো ৯ জানুয়ারিকে, জুবায়েরের মৃত্যু দিবসকে, ‘সন্ত্রাস বিরোধী দিবস’ আখ্যা দিয়ে লড়াইটা জারি রাখতে চান। লড়াইয়ের অংশ হিসেবে `সন্ত্রাস বিরোধী দিবস` সফল হোক। এই লড়াই আমাদের বিদ্যাপীঠগুলোকে অস্ত্রের ঝনঝনানি থেকে রক্ষায় পথিকৃৎ হয়ে উঠুক।
সৌমিত জয়দ্বীপ: সাংবাদিক
sc.joydip@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৪
এএ/