রঙ্গভরা বঙ্গদেশের রাজনীতি বোঝা বড়ই কঠিন। কখন যে ফুঁসে উঠছে, কখন যে শান্ত আর কখন পথহারা কেউই জানে না।
‘চমক-বাদশা’ এরশাদ সাহেব শপথ নিলেন। সুদূর সিডনিতে বসে টিভিতে এ দৃশ্য দেখার বিরল সৌভাগ্য হল। শপথের বাক্যগুলো শুনে এবং তার চেহারার দিকে তাকিয়ে কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
বলে রাখি, দেশজুড়ে যে সন্ত্রাস, বোমা হামলা,আগুন, স্কুল পোড়ানো, সর্বশেষ উপদ্রব সংখ্যালঘু নির্যাতন তার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই। বরং সরকারের ঢিলেমি আর সরকারি দলের ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয় অবস্থানই পরিস্থিতিকে জটিলতর করে ফেলেছে।
কথায় বলে মুগুরের বিকল্প নেই। কিন্তু এই যে মুগুর প্রক্রিয়া তার প্রতিবন্ধক এরশাদের শপথ আর বিগত কয়েক মাসের নাটক জাতি হিসেবে আমাদের কি পরিচয় তুলে ধরছে?
বিশ্ববাসী আমাদের নিয়ে আসলেই ভাবে না। তাদের সে সময়ও নেই। কিন্তু যারা ভাবেন বা যেসব প্রতিবেশী দেশ ও মানুষজন আমাদের নিয়ে ভাবতে বাধ্য হন তাদের সামনে আমাদের কিভাবে উপস্থাপিত করলেন এই সাবেক জেনারেল? এরা যদি আমাদের মানসিক সুস্থতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তা কি সত্যি দোষের কিছু হবে?
শেষ কথা নেই বলে সব আচরণ বা আস্কারা বৈধ হতে পারে না। এবারের সংকট শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এরশাদের অবস্থান একদিকে যেমন সংশয় আর কুয়াশাচ্ছন্ন, অন্যদিকে কিঞ্চিৎ পাগলামিরও বটে। এই বলছেন আছি, এই বলছেন নেই।
হেফাজত শাপলা গণজাগরণ মঞ্চ ও নির্বাচন যাবতীয় সব ব্যাপারে তার ভূমিকা মানসিক বিকার ও অধৈর্যের প্রতীক। ঘটনাচক্রে লাইমলাইটে চলে আসা জাতীয় পার্টির প্রধান সাবেক সেনানায়কের এই ভূমিকা সরকারি দলকে যেমন বিপদে ফেলেছে তেমনি বিরোধী দলকেও ফেলেছে ঘোর অন্ধকারে।
ধরে নিলাম সর্বশেষ অবস্থানই ছিল তার শেষ কথা। তিনি নির্বাচনে যাননি। আজকের শপথ তবে কি প্রমাণ করলো? এই সেদিনও তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন ভূমিকায় নাটক করলেন। মনোনয়নপত্রে ভুল তারিখ লিখে নিজের বৈধতা বজায় রাখলেন সেটাই কি এখন সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না?
একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও সদ্যবিদায়ী বিরোধী দলীয় নেতা তাকে সহ্য করেন কিভাবে? কিভাবে তার এজাতীয় উদ্ভট আচরণ আচরণ মেনে নেন?
আমরা এমনিতেই ঘোর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। দেশের স্কুলগুলোর মত নিরীহ বিদ্যাপীঠও আজ আক্রান্ত। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের না আছে রাজনীতিবোধ, না কোন রাজনৈতিক বিবেচনা। ভালো করে কথা ফোটা বা কথা বলার আগেই যারা জেনে যায় তাদের স্কুল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । তা নিজেদের দেশের মানুষের হাতে তখন তাদের মনের অবস্থা কি হয়? এরা কি আসলেই এটা ভুলে যেতে পারবে? নাকি তা আদৌ সম্ভব? যারা এ কাজগুলো করছে এরশাদও তাদের মদতদাতা। তিনি সরে না দাঁড়িয়ে নির্বাচনে এলে তারা শক্তিহীন হতো।
সেটা না করে শেষ মুহূর্তে তিনি যে ডিগবাজী খেলেন এবং শয্যাশায়ী হওয়ার নাটক করলেন সেজন্যে তার বিচার হওয়া প্রয়োজন। একদিকে বলছেন অসুস্থ । আবার নিয়মিত গলফও খেলছেন। এটা কি তুঘলকি রাজত্ব? এতো ছলাকলার পরেও বলার কেউ নেই?
হঠাৎ শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে তিনি আবার কোন খেলা খেলবেন? কোন এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামবেন? এরই মধ্যে এ জাতি যে মাশুল দিয়েছে বা দিচ্ছে তার আর নতুন কোন খেলোয়াড়ের প্রয়োজন নেই। জামায়াতের সহিংসতা আর চোরাগোপ্তা হামলায় জনজীবন আতঙ্কিত।
এখন সংখ্যালঘু নামে পরিচিত হিন্দুদের চলছে চরম দুরাবস্থা। এই কঠিন সময়ে এরশাদের শপথ গ্রহণ নব নির্বাচিতদের জন্য ভয় না ভরসার এ নিয়ে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। তার আচার আচরণ বা কথা বার্তায় এখন কোনো পাগলও বিশ্বাস রাখে না। তবু তিনি আমাদের রাজনীতির বড় খেলোয়াড়।
একটু হলেও গুছিয়ে উঠছে জাতি। বর্তমান সরকারের কথা জানি না। তবে জনমনে কিছুটা আস্থা আর আশার ভাব ফিরছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে জীবন। কোথাও কোথাও রুখে দাঁড়াচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমন সময় তার আর্বিভাব আসলেই প্রশ্নবোধক।
শপথ নিয়ে রওশন এরশাদকে দায়িত্ব দিয়ে চুপ থাকলে ভালো হয় বা হবে। কিন্তু তিনি কি তা পারবেন? তার স্বভাব ও চরিত্র তা বলে না। ফলে সাবধানতার বিকল্প নেই।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সততা। এককালে রাজনীতিকরা সৎ ছিলেন বলে কর্মীরা তাদের অনুসরণ করতো। জীবন দিয়ে হলেও নেতার মান রাখার রেওয়াজ ছিল। আদর্শ যে নেতা ও রাজনীতির চালিকা শক্তি তার বিনাশ নেই। তাকে ঘিরেই আবর্তিত মানুষ ও দুনিয়ার জীবন ব্যবস্থা । আমাদের দেশে তার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। হয় দমন, নয় নির্যাতন, নয় জ্বালাও-পোড়াও আর ধর্মের নামে মাতম। এমন বাস্তবতায় এরশাদের মত নেতার মানসিক হাসপাতালে থাকার কথা হলেও থাকেন সংসদে।
হাসপাতাল থেকে সশরীরে সুস্থ অবস্থায় শপথ নিয়ে আবার সটান গিয়ে শুয়ে পড়েন। পরদিন গলফ খেলার আগে তার আর বাইরে বেরুতে হয় না। নির্বাচন বানচাল ও অংশ না নেয়ার জন্য জান কোরবান দেয়ার মানুষটি যখন শপথ নিয়ে ফিরে যান তখন আমি অন্তত আশ্বস্ত বা আশাবাদী হই না।
এরশাদের এমন কাণ্ড দেখে ভাবতে ইচ্ছা করে, হাসপাতালে ফিরে যেতে যেতে গাড়িতে বসেই ড্রাইভারকে হেমন্তের সেই বিখ্যাত গানটি বাজাতে হুকুম দেন. ‘আজ শপথের মালা খুলে/ আমারে গেছ যে ভুলে’....তারপর তো সকলেই জানি, দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে...এবার কোনদিকে বাঁক নেবেন এই বর্ণচোরা ???
অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৪