বহুল আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক অগ্রযাত্রার পথ সুপ্রশস্ত হয়েছে বলেই অনেকের বিশ্বাস। সেই অগ্রযাত্রার পথে রোববার গঠিত হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীসহ ৪৯ সদস্যের কাঙ্ক্ষিত মন্ত্রিপরিষদ।
বিতর্কিত ও সমালোচিতদের বাদ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মুখ। নতুন এ অগ্রপথের সৈনিক হয়েছেন নবীন ও প্রবীণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের অনেকেই শুনিয়েছেন আশার বাণী। জঙ্গিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন অনেকেই, বলেছেন অতীতের ধারা সমুন্নত থাকবে।
১. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করে জাতির ললাটে আঁকা কলঙ্ক টিকা দ্রুত মুছে ফেলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ফসল, ৭১’র ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত সোনার বাংলায় যুদ্ধাপরাধী নামক কলঙ্ক যতদিন থাকবে ততদিনই বীর শহীদের আত্মারা আমাদের অভিশাপ দিয়ে যাবে। মা-বোনের সম্ভ্রম ছিনিয়ে নিতে কিংবা এ কাজে সহযোগিতা করতে যাদের হৃদয় এতটুকুও কেঁদে ওঠেনি, বরং নানাভাবে সাহায্য করেছিল, পাকি সেনাদের সাহায্যকারী সেই হাত ও চক্ষু যত দ্রুতই অকার্যকর করে দেওয়া যায় ততই শ্রেয়।
পাকি সেনাদের এসব দোষরদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পুতে দেওয়া হোক শত সহস্র হাত মাটির নিচে। পাকি-প্রেমীরা শিক্ষা নিক তাদের পূর্বসূরিদের শাস্তি দেখে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ কোনো দিন মানব প্রেম ভুলে অমানুষ হয়ে না ওঠে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই বিচার কাজ শেষ করতে হবে।
২. জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে এরা যাতে নতুন কোনো দলের মোড়কে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
অনেকেই মনে করছেন, যদি জামায়াত-শিবির বাংলাদেশে রাজনীতি না করতে পারে, তাহলে তারা আত্মগোপনে চলে যাবে। কিছু দিনে তারা যেসব নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে, আত্মগোপনে থাকার সময়ে এর মাত্রা বা পরিধি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সেই মাত্রা বা পরিধি যাতে কোনো ক্রমেই বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে এদের শিকল টেনে ধরতে হবে।
এদের রাজনীতি করা বা করতে পারবে কিনা এই নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকলেও অনেকেই মনে করেন, যদি জামায়াত নিষিদ্ধ হয় তাহলে এরা হেফাজতের আড়ালে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারে। কিন্তু লক্ষ রাখতে হবে যাতে কোনো ভাবেই এরা হেফাজতের ট্যাগ ব্যবহারের সুযোগ না পায়।
৩. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ও নির্বাচন সম্পন্ন করতে গিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার যে অবনতি হয়েছে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার নিরাপত্তা বিধানের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার যে ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছে, বাসে-ট্রেনে পেট্রোল বোমা মারার যে দৃশ্যগুলো আমাদের চোখে ভেসে ওঠে; ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ মুভমেন্টের পর পরই শিবিরের বাঁশের কেল্লায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ছকে চলছিল প্রায় প্রতিটি অপকর্ম। তাই নব গঠিত মন্ত্রিপরিষদের প্রথম কাজ হবে ফেইসবুক পেইজ বাঁশের-কেল্লার প্রতিটি অ্যাডমিনকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা। ভবিষ্যতে কেউ যাতে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার পথে বাধা না হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৪. যেসব স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার সুষ্ঠু বিচার করে ভবিষ্যতে যেন কোনো উগ্রবাদ দেশে মাথাচাড়া দিতে না পারে সেই ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। সম্প্রতি যশোরের মালোপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা যে ন্যক্কারজনক রাজনীতির শিকার হয়ে শেষ সম্বল হারিয়েছে, যাদের কারণে হারিয়েছে সেইসব বক ধার্মিকদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহারের তীব্র মতবিরোধী। এই শব্দের পরিবর্তে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলাই অধিকতর শ্রেয়। গণজাগরণ মঞ্চসহ তরুণ প্রজন্মের আরও অনেকেই ত্রাণ ও সাহায্য নিয়ে আমাদের হিন্দু ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের মুখের ভাষায় ফুটে ওঠে ভালোবাসা ও আবেগ। এরা সাম্প্রদায়িকতা বোঝে না, এরা মানবতার কাঙাল। তাই যাতে আর ভবিষ্যতে বলতে না হয়- ‘দশ-বারো জন তোমাদের ঘোর ভেঙেছে, পাশে আছে পুরো বাংলাদেশ। ’ আমরা নতুন কোনো দুর্যোগ চাই না, তবে এই মুহূর্তের দুর্যোগ মোকাবেলায় পাশে আছি।
৫. পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন আঙ্গিকে, নতুন ভাবে শুরু করতে হবে। পদ্মা সেতু, শেয়ার বাজার, ডেসটেনি ও হলমার্কের মতো নতুন কোনো ইস্যু যেন এই মেয়াদে সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করতে হবে।
শেয়ার বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নে আধুনিক ট্রেডিং ব্যবস্থা চালু, ফটকা কারবারি প্রথা বিলোপ, সূচকের উত্থান-পতন রোধে নতুন কোনো পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সিকিউরিটি অ্যান্ড স্টক এক্সচেঞ্জকে মানসম্মত করে যুগের উপযোগী করে তুলতে হবে। পদ্মা সেতুর কাজ যত দ্রুত শুরু করা যায় সে দিকে এই সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের যেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিল সবগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।
৬. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি,বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় গত মেয়াদে উন্নয়নের যে ধারা অব্যাহত ছিল সেই ধারা সমুন্নত রেখে উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। অতীতের ধারা বজায় রেখে বাণিজ্যিক উন্নয়ন সম্ভব হলে দেশ দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। তাই উন্নয়নের ধারা অব্যাহতের থাকবে বলেই তারুণ্যের আশাবাদ।
৭. টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থায় গত মেয়াদের সাফল্য থ্রিজি প্রযুক্তিকে দ্রুত সারা দেশে সম্প্রসারিত করে ডিজিটালাইজেশনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই প্রক্রিয়া গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। দেশের আনাচে কানাচে ব্রডব্যান্ড লাইন বা ওয়াই ম্যাক্স ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানেরও ব্যবস্থাকরতে হবে।
সোনার বাংলাদেশ গড়তে থ্রিজি প্রযুক্তি সবার হাতের নাগালে পৌঁছানো সম্ভব হলে দ্রুত ফোরজি প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মনে রাখা উচিৎ যখন আমরা থ্রিজির স্বপ্নে বিভোর হই তখন বহির্বিশ্ব কত এগিয়ে!
বাণিজ্য ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিসহ উপযুক্ত বিষয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরের সফলতাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে এখন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে বহু দূর। তাহলেই সত্যিকারের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ না হয়ে নতুন দিগন্তের দেখা মিলবে।
এমদাদুল হক তুহিন: ব্লগার ও কবি emddl2008@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২১০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪