ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ইসলামের বিপরীত দর্শন মওদুদী ও জামায়াতের

হাবীব ইমন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
ইসলামের বিপরীত দর্শন মওদুদী ও জামায়াতের

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তাত্ত্বিক গুরু মওলানা আবুল আলা মওদুদীর দর্শন ইসলামের বিপরীত। তাদের বই ও ওয়াজ এমনটিই প্রমাণ করে।



এসব উপাদানের অনুষজ্ঞ ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ধর্মের ব্যাপারে সবসময় সহানুভূতিশীল, শ্রদ্ধাশীল। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে মানুষের সহানুভূতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতো করে ধর্মকে বিকৃত করছে জামায়াত-শিবির, সেই সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের আড়ালে প্রচার করছে মওদুদীর দর্শন। এ প্রচারণা তারা স্কুল-মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝেও চালিয়ে যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে সারাদেশে যেভাবে সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, যে কোনো সংজ্ঞায় এখন জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ে যুদ্ধাপরাধের রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখও করা হয়েছে।

নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে ৭৩টি ফেরকা উদ্ভব হবে।

এদের স্বরূপ সম্পর্কে তিনি অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘শেষ জামানায় কিছু প্রতারক সৃষ্টি হবে। তারা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করবে। তারা মানুষের নিকট নিজেদের সাধুগিরি প্রকাশ করে মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ভেড়ার চামড়ার পোশাক পরবে (মানুষের কল্যাণকারী সাজবে)। তাদের রসনা হবে চিনির চেয়ে মিষ্টি। কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ের হৃদয়ের মত হিংস্র (তিরমিযী শরীফ)। ’

অথচ মওদুদী বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই, সে জান্নাতবাসী হবে না। ’

একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর দেখা যায়, মওদুদী রাজনীতিতেও নাক গলাতে শুরু করেন। ব্রিটিশদের পা চাটার পাশাপাশি পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন তিনি। পাকিস্তানকে তিনি ‘আহাম্মকের বেহেশত’ এবং ‘মুসলমানদের কাফেরানা রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করেন (তরজুমানুল কোরআন)। হিন্দু জাতীয়তাবাদ যেমন তার কাছে ‘লানত’, মুসলিম জাতীয়তাবাদও তাই। মুসলিম লীগ সম্পর্কে ‘জামায়াতে ইসলামী কি ইন্তেখাবি জিদ্দো জেহাদ’ গ্রন্থে মওদুদী বলেছেন, ‘খোদা সম্পর্কে অজ্ঞ, ওরা পরিবেশকে পায়খানার চাইতেও নোংরা করে ফেলেছে। ’

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ‘কাফেরানা রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের লাহোরে বসে ডেরা বাঁধেন মওদুদী এবং ঘোষণা করেন, পাকিস্তান হলো ‘খোদাদাদ’ বা ‘আল্লাহর দান’। ভারতের পাঠানকোট থেকে প্রকাশিত তার আগের বইগুলো যখন পাকিস্তানে ছাপা হয় তখন জিন্নাহ, পাকিস্তান, মুসলিম লীগ সম্পর্কে যেসব সমালোচনা ছিল সেগুলো ছেঁটে ফেলেন। সুবিধাবাদের জন্য নিজের অবস্থান পাল্টাতে তার বেশি সময় লাগেনি। নিজ উদ্দেশ্য সাধনার্থে ধর্মকে সবসময় সুবিধাবাদের রাজনৈতিক পুঁজি করে এগিয়ে গেছেন তিনি। মওদুদীর পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে সততা ও দায়িত্বের সঙ্গে বলেছেন, ‘বাবা মওদুদী নিজের স্বার্থের কারণেই একসময় পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছেন। ’

১৯০৩ সালে পাকিস্তানের আওরঙ্গবাদ শহরের আইন ব্যবসায়ী আহমদ হাসান মওদুদীর গৃহে জন্ম লাভ করেন মওদুদী।

মওদুদী নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে বলেছিলেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা হচ্ছে আলেম তথা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। পিতার আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে ব্যর্থ হন তিনি। তবে বাল্যকাল থেকে লেখালেখি ছিল তার অভ্যাস। কিন্তু ধীরে ধীরে এ অভ্যাসকে নিজের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে এবং ভ্রান্ত মতবাদ প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে ১৯১৮ সালে বিজনৌর থেকে প্রকাশিত ‘মদীনা’ নামক পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। নিজের ভ্রান্ত মতবাদকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘তরজমানুল কুরআন’ নামক নিয়মিত মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন মওদুদী। ইসলামের মৌলিক নীতি ও ভিত্তিসমূহ উপেক্ষা করে শাসন ব্যবস্থা ও মওদুদীবাদ প্রচারের ওপর বেশি জোর দেন তিনি। মওদুদী বলেন, ‘শাসন ও কর্তৃত্ব করার নামই হচ্ছে ধর্ম, শাসন ব্যবস্থার আইন হলো শরিয়া এবং উপাসনা হচ্ছে শাসন ব্যবস্থার ঐতিহ্যকে অনুসরণ করা। ’
মওদুদী ও তার গড়া জামায়াতে ইসলামী ব্রিটিশ শোষকদের দালাল আব্দুল ওহাব নজদীর অনুসারী, আউলিয়া বিরোধী ইবনে তাইমিয়ার ভক্ত। যে তাইমিয়া সম্পর্কে ইবনে বতুতা তার ‘ভ্রমণ কাহিনী’তে উল্লেখ করেছেন, ‘ইবনে তাইমিয়া ছিল মস্তিস্ক বিকৃত’ (সূত্র: ইবনে বতুতার সফরনামা, মোহাম্মদ নাসির আলী, নভেম্বর ১৯৬৮, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, অধ্যায়-এক, পৃষ্ঠা-২৮-২৯)। আব্দুল ওহাব নজদী ও সৌদ মিলে ইসলামের মধ্যে বিরাট ফেতনার সৃষ্টি করেছে। সৌদ কে? তিনিই সে সউদ, যার প্রশ্রয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছিল, যার আশ্রয়ে জান্নাতুল বাকীর অগণিত সাহাবাদের নির্দিষ্ট মাজার ও তার গম্বুজ এবং মিনার ও যাবতীয় মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন ধ্বংস হয়েছে। সেই বিপথগামীদের দালাল এদেশের জামায়াত।
পাকিস্তান আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধিতার কারণে ‘জামায়াতে ইসলামী’ পাকিস্তানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার জন্য তাদের ধর্মীয় নতুন ইস্যুর প্রয়োজন ছিল। এমতাবস্থায় তারা ‘কাদিয়ানীরা মুসলমান নহে’ এবং ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে’-এরকম একটি সদ্য স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৪৯ সালে কাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘোষণার দাবি করে ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ নামে আরেকটি সংগঠন কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার আহবান করে। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তাত্ত্বিক গুরু মওদুদীর সরাসরি উস্কানিতে পাঞ্জাবে কাদিয়ানীবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, দ্রুত লাহোরেও ছড়িয়ে পড়ে এ দাঙ্গা এবং তা ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে থাকে। দীর্ঘ চার বছর ধরে চলার পর ১৯৫৩ সালে দাঙ্গা এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, পাকিস্তান সরকার লাহোরে সামরিক শাসন জারি করতে বাধ্য হয়। এ দাঙ্গায় মদদ দেওয়ার জন্য মওদুদীকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হল। পরে অবশ্য, সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে ফাঁসির দণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে যান মওদুদী।

নিজের লেখা ‘তাফহিম’র চতুর্থ খণ্ডে সৌদি রাজবংশকে কা’বার খাদেম মানতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন মওদুদী। কা’বার খাদেমদের বলেছেন ‘হরিদ্বারের পা’। মওদুদীর এমন রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তান আমলে বেশ কয়েকবার নিষিদ্ধও হয় ‍তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াত। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষরা হয়তো তাকে আর তার সংগঠনকে ঐশী সংগঠন মানেন। অথচ মওদুদী বলেন, ‘ফেরেশতা হলো ভারতের এবং গ্রিসের দেবদেবীর অনুরূপ। ’ নিজের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও অন্যান্য নবী সম্পর্কেও আপত্তিকর উক্তি করতে দ্বিধা করেননি মওদুদী। সহীহ হাদিস মতে, ‘মুহাম্মদ (সা.) এর স্বভাব-চরিত্র-অভ্যাস তাঁর উম্মতদের অনুকরণের জন্য উত্তম নমুনা বা সুন্নত। ’ (বুখারি শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৮৪)। অথচ মওদুদীর মতে, ‘নবীর আদত (অভ্যাস), আখলাককে (চরিত্র) সুন্নত বলা হয় এবং তা অনুসরণে জোর দেওয়া আমার মতে সাংঘাতিক ধরনের বিদায়াত (গর্হিত কাজ)। ’ (রাসায়েলে ও মাসায়েল, পৃষ্ঠা-২৪৮)।

কোরআন, হাদিসে নবীদের নিষ্পাপ বলেই ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে নারাজ মওদুদী। ইসলামের বদ্ধমূল এ আকিদাকে অস্বীকার করে হযরত মুসা (আ.) সম্পর্কে মওদুদী বলেছেন, ‘নবী হওয়ার পূর্বে মুসা (আ.) এর দ্বারা একটি গুনাহ হয়েছিল। তিনি এক ব্যক্তিকে কতল করেছিলেন। ’ (রাসায়েলে ও মাসায়েল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১)।

১৯৫৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক ভাষণে মওদুদী বলেন, ‘লোকে সাধারণত বলে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ: কালিমা, নামাজ, যাকাত, রোজা এবং হজ। আর এগুলোই ইসলাম। এ ভুল ধারণার মধ্যে তারা অনেকদিন ধরে আছে। আসলে এটা একটা বড় বিভ্রান্তি যা মুসলমানদের পথ এবং কর্মকে ধ্বংস করছে। (সূত্র: কাউসার) অথচ, সহীহ হাদীস সমূহে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি। যথা: কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত। (বুখারী ও মুসলিম)

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মওদুদীসহ ৬০ জন জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম তাদের একজন। মওদুদী ঘোষণা করেছিলেন, বিষাক্ত দুধের মাখন হলো গণতান্ত্রিক নির্বাচন। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে কেউ যদি সংসদে নির্বাচিত হয় তাহলে ইসলাম অনুযায়ী হারাম। এসব নির্বাচন কুকুরের দৌড়। মজার ব্যাপার হলো, এখন এই মওদুদী ও তার ইসলামের নির্দেশ অমান্য করে জামায়াতের নেতারা কুকুরের দৌড়ে শামিল হয়েছেন। জামায়াতের রাজনীতি সবসময় সুবিধাবাদিতার পথ অনুসরণ করেছে।

একটি চিঠিতে মওদুদী লিখেছেন, যে স্বৈরাচার পরিবর্তনের জন্য একজন মহিলার নেতৃত্ব গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় যদি না থাকে, তবে নারী নেতৃত্ব গ্রহণের অনুমোদন শরীয়তে আছে। অথচ ১৯৫২ সালের ‘মাসিক তরজুমানুল কোরআন’ ও ‘মাসিক আল ফুরকান’ পত্রিকায় তিনিই লিখেছেন, ‘নারী নেতৃত্ব কোনো ইজতিহাদী মাসালা নয়’। গোলাম আযমের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘খালেদা ও হাসিনা হচ্ছে দুই শয়তান। একজন বড়, একজন ছোট। তারা শয়তানের সমর্থক বাস্তব কারণে। ‘ তিনি আরো বলেন, ‘কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে যদি কোনো মহিলা সরকার প্রধান হন তাহলে এর জন্য সে মহিলাকে দায়ী করা মোটেই সঙ্গত নয়। ’ অথচ, নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণের জন্য জামায়াতে ইসলামী তাদের স্থায়ী গঠনতন্ত্রে সর্বস্তরের কমিটিতে নারী নেতৃত্ব রাখার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে।

জামায়াতের নেতারা মওদুদীর অনুসারী হলেও তাদের নিজেদের স্বার্থে মওদুদী দর্শনের বিপরীতেও কখনো কখনো অবস্থান নেন। মওদুদী বলেছেন, ‘একজন উকিল কুফরের কাজ করেন। ওকালতি খোদার আইনবিরোধী বিদ্রোহ। উকিলের মুহুরি হওয়া হারাম। উকিলের বাসায় খাওয়া-দাওয়া হারাম। ’ অথচ, জামায়াত প্রতিবছর ৪০ জনকে ব্যারিস্টার তৈরি করছে। তাহলে মওদুদীর ভাষায় আদালতে তার জামায়াতের পাণ্ডার কী-বৃত্তি করছে?
কোরআনে বলা আছে, ‘তোমরা প্রতিমা পূজার অপবিত্রতা পরিহার কর, আর তোমরা মিথ্যা বলাও পরিহার কর’ (সূরা হজ্জ, আয়াত নম্বর-৩০)। কিন্তু এ বিষয়ে মওদুদীর বক্তব্য হচ্ছে, ‘বাস্তব জীবনে এমন কিছু চাহিদা রয়েছে যেগুলোর খাতিরে মিথ্যা বলা কেবল জায়েযই নয় বরং ওয়াজেব। ’ (মাসিক তরজুমানুল কোরআন, ৫০ তম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, শাবান ১৩৭৭ হি., পৃষ্ঠা নম্বর: ১১৮)।

যুদ্ধবন্দী নারীদের ব্যাপারে মওদুদীর মতামত হলো, ‘এমনকি বর্তমান যুগেও যুদ্ধবন্দী মহিলাদের সৈনিকদের মধ্যে বন্টণ করে দেওয়া উচিত এবং সৈন্যদের তাদের (মহিলাদের) ভোগ করার অনুমিত দেওয়া উচিত। ’ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের দোসর জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এই ফতোয়াই দিয়েছিলেন। আমাদের মা-বোনদের ‘গনীমতের মাল’ হিসেবে ধর্ষণ করেছেন তারা।  

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম তার সিরাতুন্নবী সংকলনে (পৃষ্টা ১০) লিখেছেন, ‘নবী করীম (সা.) আমাদের মতই একজন সাধারণ মানুষ। তবে পার্থক্য শুধু একটি বিষয়ে, তা হচ্ছে- তাঁর কাছে ওহি আসতো, কিন্তু আমাদের কাছে আসে না। ’ অথচ হযরত মুহাম্মদের (সা.) তুলনা তিনি নিজেই। তার মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্তত ২৭টি ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। তার রূপ তিনটি। যথা: সুরতে বাশারী বা মানবীয় রূপ; সুরতে মালাকী বা ফেরেস্তার রূপ এবং সুরতে হাক্কী বা আল্লাহর সিফাতি রূপ (সূত্র : তাফসীরে রূহুল বয়ান)।

মওদুদী লন্ডনে দেওয়া এক ভাষণে (লন্ডনের ভাষণ, পৃষ্ঠা ১১) বলেছেন, ‘নবীজী অপরের কল্যাণ-অকল্যাণ তো দূরের কথা, নিজেরও কোনো কল্যাণ-অকল্যাণ করতে অক্ষম। ’ অথচ, হাদীস শরীফে এসেছে, রোজ-হাশরে নবী করীম (সা.) এর শাফায়াত ব্যতীত কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। সে কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে ‘শাফিউল মুজনাবিন’ খেতাব প্রদান করেছেন।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দেলওয়ার হোসেন সাঈদী বলেছেন, ‘ইসলামে শব-ই বরাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। ইহা সম্পূর্ণ বিদআত। শরিয়তে শব-ই বরাতের কোনো গুরুত্ব ও জায়গা নেই। ’ (সূত্র: ১৯৯৪ সালের মার্চের ১৩ তারিখের দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর উক্তি)। অথচ, কুরআন-হাদীসে আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শব-ই বরাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কুরআনে একে ‘লাইলাতুল মুবারক’ তথা বরকতময় রাত নামে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) এর বাণী, ‘যখন শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতের (শব-ই বরাতের) আগমন হয়, তখন তোমরা ঐ রাত্রিতে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। ’ (ইবনে মাজাহ)

ধর্মের লেবাসে ধর্ম নিয়ে কেবল এভাবে বিভ্রান্তিই ছড়াচ্ছে না, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শৈশব থেকে সন্ত্রাসের মানসিকতা গড়ে তুলছে। প্রচারণা চালাচ্ছে এক বিকৃত জিহাদের।

আনন্দময় কৈশোর কিংবা যৌবনের উত্তাল-উচ্ছ্বল সময় অতিবাহিত হওয়ার আগেই কিশোর-যুবকদের হাতে তুলে দেওয়ার হচ্ছে নৃশংসতার চাবিকাঠি। পেট্রোল বোমা, ককটেল বোমা নিয়ে জীবনহানি খেলায় মাতিয়ে তুলছে আমাদেরই সন্তানদের। সাধারণ অনুভূতি ও ধর্মীয় অনুভূতির ওপর দুর্বলতা তৈরি করে নৃশংসতার কাজে আমাদের ভাই-ছেলে-বাবাকে জড়িত করা হচ্ছে। ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’- এরকম প্রলোভনে সহজ-সরল মনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমাদের নিকটজনেরা। অসহ্য উন্মাদনায় এরা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। মাদরাসা আর এতিমখানার সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত নিরীহ-শান্ত
শিশুগুলোকে নিয়ে ওরা যুগ যুগ ধরে ধর্ম ব্যবসা করে যাচ্ছে।

মওদুদী পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির নানা সুবিধাবাদী চরিত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ধর্মকেন্দ্রিক যত সহিংসতা হয়, সেখানে জামায়াতের কোনো নেতার সন্তান আছে বলে কি খবর পেয়েছেন? জামায়াতের নেতারা তাদের সন্তানদের কোনো বিপদের মুখে ফেলতে চান না। সব সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। ’

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলে মারা যাওয়া আবদুল কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদের জামায়াতের পরামর্শে তার স্ত্রীকে লেখা সর্বশেষ চিঠিতে কথিত ‘জান্নাতের টিকিট’ নিয়ে তরুণদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। একাত্তরে তার জঘণ্য অপরাধকে আড়াল করে রাষ্ট্র ও জনগণকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন।

২০১০ সালে বাংলাদেশে মওদুদীর লেখা সকল বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু নিষিদ্ধ হয়নি সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট, গোলাম আযমের বই। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করার কারণে দেশের সকল লাইব্রেরি ও মসজিদ থেকে মওদুদীর বই সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন ফুটপাথে অনেক ধর্মীয় বইয়ের সঙ্গে এখনও মওদুদীর বই পাওয়া যায়। কাঁটাবনসহ অনেক ধর্মীয় লাইব্রেরিগুলোতেও মওদুদীর বই পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর ওয়েবসাইটে মওদুদীর বিভিন্ন লেখা সংকলিত রয়েছে। এসব বই ও সাইটগুলো সরিয়ে ফেলতে ইসলামী ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে আইন করে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে।

হাবীব ইমন: শিক্ষক, কবি ও রাজনৈতিক কর্মী, emonn.habib@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ২১২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।