এক একটি নির্বাচন আসে, সাম্প্রদায়িক হিংসার বলি হয় হিন্দু ধর্মের মানুষেরা। তাদের বাড়িঘরে হামলা হয়, কুপিয়ে, পিটিয়ে হতাহত করা হয়।
পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে তারা ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়া চলে আসছে পাকিস্তান আমল থেকে এবং দুঃখজনক হলো বাংলাদেশ আমলেও নির্বাচন কিংবা অন্য কোন উছিলায় হিন্দুর ওপর নির্যাতন চলছে।
পাকিস্তানে হিন্দুর ওপর নিপীড়ন নিয়ে বলার কিছু নেই। কারণ পাকিস্তান ছিলো সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাকিস্তানে কখনোই হিন্দুদের বিশ্বাস করা হতো না। তাদেরকে মনে করা হতো শত্রু এবং গণ্য করা হতো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে।
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রত্যক্ষ মদদে পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চালানো হতো। অনবরত অত্যাচারে টিকতে না পেরে যেসব হিন্দু পরিবার ভারতে দেশান্তরী হন, তাদের সম্পত্তি পাক-ভারত যুদ্ধের পর ‘শত্রু সম্পত্তি’ গণ্য করা হয়।
কিন্তু, যেদেশ (বাংলাদেশ) বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেদেশে কেন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কাজ করবে? সেদেশে কেন ধর্মের পরিচয়ে নাগরিকদের ভেদাভেদ করা হবে? ধর্মীয় রাষ্ট্রে হিন্দুরা যে বৈষম্যের শিকার হতেন, আধুনিক জাতিরাষ্ট্রেও তাদের প্রতি কেন বৈষম্যমূলক আচরণ?
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পরাজিত ও প্রত্যাখ্যান করেই তো বাংলাদেশ-এর জন্ম, যার মৌল ভিত্তি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। তাই যদি সত্য হয়, তাহলে হিন্দুর প্রতি কেন এত নিগ্রহ? কেন এত বৈষম্য? হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যদি একই বাংলা মায়ের সন্তান হয়, তাহলে হিন্দুর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ কেন?
হিন্দু যদি বাঙালি জাতিসত্তার একটি উপাদান এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর আবশ্যকীয় একটি অংশ হয়, তাহলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ওপর আক্রমণকে কী জাতিসত্তার ওপরই আক্রমণ হিসেবে ধরা উচিত নয়? এবং যারা আক্রমণ করছে তাদেরকে কী বাঙালি জাতির শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়?
সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতিদের কার্যকলাপ থেকে মনে হচ্ছে হিন্দুরা বুঝি বাঙালি নয়, হিন্দু বোধ করি বাংলাদেশের নাগরিক নয়? যারা পুরুষানুক্রমে, শত শত বছর ধরে, হাজার বছর ধরে এদেশে বসবাস করছে, তারা এদেশের নাগরিক না হলে কোন্ দেশের নাগরিক? তাহলে কী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উঠতে পারে না?
হিন্দুকে যদি বাঙালি হিসেবে না দেখে হিন্দু হিসেবে দেখা হয়, তাহলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের বাঙালিয়াত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠবে এবং তাদেরকেও নিজ নিজ ধর্মের পরিচয়ে অভিহিত ও বিবেচনা করা হবে। এভাবে বাঙালি জাতি যদি ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে যায়, তখন বাঙালি জাতিই তো আর থাকে না? সেক্ষত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে?
অতএব, একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই হতে পারে না। বাঙালিকে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান খণ্ড খণ্ডভাবে ভেঙে ভেঙে দেখা চলবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার-এই ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে। আদিবাসীরাও এদেশের নাগরিক, তাদেরকেও একই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দিতে হবে।
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তো কে হিন্দু, কে মুসলমান এসব কথা ওঠেনি, কারো মনেই ছিলো না কে কোন্ ধর্মের অনুসারী। বিনা প্রশ্নে হিন্দু মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছে, মুসলমান হিন্দুকে আশ্রয় দিয়েছে। তখন বাঙালি একদেহ, এক আত্মা হয়ে গিয়েছিলো।
মুক্তিযুদ্ধে বরং হিন্দুদের ওপরই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছিলো। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট কিছুই বাদ রাখেনি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ নিয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে নয়মাস শরণার্থীর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিলো।
এদের অনেকেই ছিল হিন্দু।
এত অপরিমেয় রক্ত, অশ্রু, ত্যাগের বিনিময়ে যে দেশ সবাই মিলে স্বাধীন করলো, সেদেশে হিন্দুদের বাঙালিত্ব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে আবার শুধু ধর্মের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হচ্ছে কেন? কে দেবে এসব প্রশ্নের জবাব? কার কাছে চাইবে তারা এসব প্রশ্নের জবাব?
ভোটের কথায় ফিরে আসি। কারণ, ভোটের সময়ই তাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে বেশি। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কেন? বলা হয় তারা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাঙ্ক। তাদের অপরাধ নির্বাচন আসলে তারা শুধু আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়। তা এই যদি কথা হয়, তাহলে তাতে দোষের কী হলো?
হিন্দুদের কী তাদের পছন্দ মত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার অধিকার নেই। তারা কাকে ভোট দেবে, এটা তো তাদেরকে কেউ ডিকটেট করতে পারে না। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্গত। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরাই তো বলেছি, ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’।
তাহলে হিন্দুরা যদি তাদের খুশি মত তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে ভোট দেয়, সেটা দোষের হবে কেন? তারা কে কোথায় ভোট দেবে সেটা যদি ব্যক্তি বা দল যদি চাপিয়ে দিতে চায়, সেটা হবে তাদের নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু অনেক আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন-
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী। বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
কাজী নজরুল ইসলাম
-কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!-কৃষ্ণনগর, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩
কিন্তু কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। তার কারণও ছিলো। নজরুল যখন ১৯২৭ সালে এই কবিতা লেখেন, তখনো হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই হয়ে যায় নি। শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শাহ বদিউল আলম, লোকমান খান শেরওয়ানি, ফররোখ আহমদ নেজামপুরী, আলী আহমদ ওলী ইসলামাবাদী, সরদার জালাল আহমদ জগলুল প্রমুখ মুসলিম নেতার সক্রিয় সহযোগিতায় দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্তের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ও বিওসি ধর্মঘট, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের স্মৃতি তখনো মিলিয়ে যায় নি। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত দেশবন্ধু সি আর দাশ তখনো বাংলার আকাশে প্রখর সূর্যের দীপ্তি ছড়িয়ে জ্বলজ্বল করছেন।
তারপর একে একে ঘটে গেল অনেক ঘটনা। প্রথমে মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামের বিপ্লবী যুবকদের সংগঠিত করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ ও দখল করে চট্টগ্রাম থেকে শ্বেতাঙ্গ শাসন উৎখাত করে চারদিনের জন্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন রাখলেন। তাঁর সহযোগিদের মধ্যে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, লোকনাথ বল-এর পাশাপাশি ছিলেন মীর আহমদ, কামালউদ্দিন খান, আফসারউদ্দিন চৌধুরীরা।
মাস্টারদার শিষ্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে আত্মাহুতি দিলেন। নেতাজী সুভাষ বসুর শিক্ষক বেণীমাধব দাসের কন্যা সারোয়াতলীর বীণা দাস (ভৌমিক) দ্বারভাঙ্গা হলের সেনেট হাউসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার সাহেব গভর্নরকে গুলি করে ধরা পড়লেন। রাইটার্সের (মহাকরণ) বারান্দা যুদ্ধে প্রাণ ছিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ। মুক্তির মন্দির সোপানতলে একে একে আরো কত প্রাণ হলো বলিদান।
বাঙালির স্বরাজ সাধনা ও বিপ্লবী আন্দোলনকে হত্যা-নির্যাতন-উৎপীড়নে দমাতে ব্যর্থ-হয়ে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী অনেক বুদ্ধি করে বার করলো- Divide and Rule policy বা ‘ভাগ করা শাসন কর’ নীতি। এই কূটকৌশল ক্লিক করলো-হাজার বছর ধরে যে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ এক মায়ের সন্তানের মতো ভ্রাতৃভাবে পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে, তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর খাড়া হয়ে গেলো।
জিন্নাহ প্রচার করলেন দ্বিজাতিতত্ত্ব-হিন্দু-মুসলমান দুই জাত। ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুললেন। সেই দাবিতে মজে গেলো বাঙালি মুসলমান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাঝে তারা মোক্ষ খুঁজে পেলো। ব্রিটিশ বিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলো। ইংরেজরা তো তা-ই চেয়েছিলো। র্যাডকিফ সাহেব এসে সাম্প্রদায়িক ছুরিতে অখণ্ড বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত এবং অখণ্ড ভারতকে ত্রিখণ্ডিত করে ফেললেন।
বাঙালির অবিভাজ্য সত্তাকে দুই টুকরো করে পূর্ব ও পশ্চিমে বঙ্গে জুদা (পৃথক) করে দেয়া হলো। পূর্ববঙ্গ হলো প্রথমে পাকিস্তানের প্রদেশ, পরে কলোনি; পশ্চিম বঙ্গ হলো ভারতের অঙ্গ রাজ্য। ততদিনে ৪৬-এর দাঙ্গায় কলকাতার বুকে প্রবাহিত হলো বাঙালির রক্তের নহর; চট্টগ্রামের প্রতিবেশী নোয়াখালীতেও হিন্দু-মুসলমান একে অপরের বুকে ছুরি বসাতে লাগলো।
ভাইয়ের রক্তপানের নেশায় উন্মত্ত হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাকারীকে থামাতে আসলেন মহাত্মা গান্ধী। প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার ও দাঙ্গাবিরোধী সংস্কৃতিকর্মী সোমেন চন্দ প্রাণ দিলেন। ঢাকায় প্রাণ দিলেন একজন কবি, যাঁর নাম এই মুহূর্তে আমি স্মরণ করতে পারছিনা।
কিন্তু সাম্প্রদায়িক দৈত্য ‘কংস’কে বধ করার জন্যই যেন গোকুলে বেড়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের সাহিত্যিক মাহবুবুল উল চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আড়াই মাসের মধ্যেই তাঁরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই যেন বের করলেন সীমান্তহীন সাময়িকী ‘সীমান্ত’- তাৎপর্যপূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক দেশভাগের বিরুদ্ধে সাহিত্যই প্রথম প্রতিবাদী হলো। পূর্ববঙ্গ তখনো সাম্প্রদায়িক ‘আফিমে’ বুঁদ হয়ে ছিলো।
সর্বত্র পাকিস্তানিকরণ, ইসলামিকরণের প্রবল উচ্ছ্বাসে সাহিত্যে জোর করে আমদানি হতে লাগলো আরবি-ফারসি শব্দ, ইরান-তুরানের রূপকথার কল্পকাহিনী। পাকিস্তানর স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে-এই ঘোষণা দিয়ে বুঝিয়ে না দেয়া পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান বুঝতে পারেনি যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে তারা ঠকেছে। প্রতিবাদ করলেন ছাত্ররা।
পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে অস্বীকার করে ১৯৪৮ সারের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যে ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন তাতে তিনি বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো’টি নেই। ’
১৯৫২ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রথমবারের মতো অত্যন্ত জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়। তারও আগে ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোডস্থিত হরিখোলা মাঠে (বর্তমানে মৈত্রী ভবন) পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলনে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, যা’ পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সংগ্রামের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করে।
ওদিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক হলাহল পান করে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়ে গেলেন বাপুজি। তবু সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ ইংরেজরা রোপন করে গেছে, তা ডালপালা ছড়িয়ে আজো বাংলাদেশ ও ভারতে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মানুষের হৃদয়।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের রক্ত ভেজা মাটিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হয়। চুয়ান্নর নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের জয়ে বাঙালি বিজয় জাতীয়তাবাদের প্রথম বিজয় সূচিত হয়। এর মধ্যে ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। পরে কাগমারী সম্মেলনে ন্যাপ-এর জন্ম হয়। ৫৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে পৃথক নির্বাচনী প্রথা বাতিল করে যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করে।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিকশিত হয় এবং সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি অসহযোগ আন্দোলন করে এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ-এর অভ্যুদয় ঘটে।
বাংলাদেশ সংগ্রামের এই সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র এঁকে আমি যেটা দেখাতে চাইলাম, সেটা হলো- জিন্নাহর দ্বিজাতিত্ত্বে বাতিল করেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- এর ভিত্তি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। যা পূর্ববঙ্গের ভূমিখণ্ডকে আশ্রয় করে এখানে বসবাসকারী একই ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি জাতির সম্মিলিত ইচ্ছা থেকে নির্মিত।
লেখক- নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ, চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৪
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর