গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণার পর বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমরা দেখতে পেয়েছি। আর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা তো কিছুদিন আগেই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- এ দেশে এখনো একটা গোষ্ঠী রয়েছে যারা প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যাদের কোন বিশ্বাস নেই।
এ সব সহিংসতায় আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য ও তাঁদের পাশে দাঁড়াতে যখন একদল তরুণ সেখানে যাচ্ছে; তখন তাঁদের উপরও হামলা হচ্ছে। এ সব তরুণ কোন রাজনৈতিক দলে জড়িত না; আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো এবং এ থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেটি খতিয়ে দেখাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। অথচ আমরা দেখতে পেলাম এদের উপরও ককটেল, পেট্রোল বোমা হামলা হয়েছে। এমনকি তাঁদের সঙ্গে থাকা প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাও এ হামলা থেকে রেহাই পাননি। যদিও এ সব কোন কিছুই তাঁদের দমাতে পারেনি।
সাম্প্রদায়িক কিছু হামলা এবং এর পরিবর্তী ঘটনা প্রবাহের ফলে হঠাৎ করে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেলো। শিক্ষকতা করার সুবাদে দেশ বিদেশের বিভিন্ন সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ আমার হয়েছে।
সেইবার ইতালির মিলান গিয়েছি এক সেমিনারে। সেমিনার শেষে সেখানে থাকা এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছি। তাঁরা বললেন- ভেনিস থেকে ঘুরে আসতে! আমি পরের দিন ট্রেনের টিকেট কেটে ভেনিস রওনা হলাম। ভেনিসকে বলা হয় পর্যটকদের শহর। চমৎকার এই শহরে প্রচুর সংখ্যক বাঙালি রয়েছে।
অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। কেউবা আবার রাস্তায় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেন। দুপুর হয়ে গিয়েছিলো। আমি খুঁজে পেতে একটা পিজার দোকানে ঢুকলাম। পিজার জন্য বিখ্যাত ইতালিতে এসে যদি পিজাই না খেতে পারি তাহলে কেমন দেখায়। যে কোনো পর্যটন শহরে যেমনটা হয়, জিনিস পত্রের দাম থাকে চড়া; ভেনিসও এর ব্যতিক্রম না। তাই অনেক দেখে শুনে একটা কম দামি পিজার অর্ডার দিলাম। বেশ তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শেষ করে যখন টাকা দিতে যাবো, লোকটি বললো-
-তোমাকে বিল দিতে হবে না
-কেন? তোমাদের কি কোন স্পেশাল দিবস নাকি আজ?
-না, আমাদের এখানে যে পিজা বানায় তিনি ভেতর থেকে বলে দিয়েছে তোমার কাছ থেকে টাকা না নিতে
-আমি কি তাঁর সাথে কথা বলতে পারি?
-হ্যাঁ,নিশ্চয়ই একটু অপেক্ষা করো।
আমি দেখলাম ভেতর থেকে আমাদের মতো গায়ের চামড়ার একজন বেরিয়ে এলেন। পরিষ্কার বাংলায় বলেলেন-
-আমি বাঙালি, এখানে আমি পিজা বানাই, মূল শেফ আরকি।
-ও আচ্ছা, খুব ভালো লাগলো আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। কিন্তু আমি যে বাঙালি সেটি বুঝলেন কি করে?
- আপনি মনে হয় মোবাইলে আপনার আত্মীয় বা অন্য কারও সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিলেন। ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম।
-আমি না হয় বিলটা দিয়েই যাই।
-না না। দিতে হবে না। আপনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন, দূর থেকে বাংলা কথা শুনে কেমন যেন মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিলো।
তাকে ধন্যবাদ দিয়ে যখন বেরিয়ে আসছিলাম তখন বার বার মনে হচ্ছিলো এই মানুষটি তো জানতে চায়নি আমি হিন্দু নাকি মুসলমান, আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি! শুধু আমার মুখের ভাষা আর আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে তাঁর মাঝে ভালো লাগা কাজ করছিলো। আমাকে পিজার টাকাটা পর্যন্ত দিতে দেয়নি। এ রকম হাজারও ছোট ছোট ভালোবাসার সমষ্টি-ই তো আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
আজ অনেকদিন পর ওই ঘটনার কথা মনে পড়ে যাবার কারণ, দেশের এ সব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। বার বার মেলাতে চেষ্টা করছি কোনটি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নাকি ওই নিখাদ ভালোবাসা?
আমিনুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক(সমাজ বিজ্ঞান), আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় , tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৪