সকালে খবরটা দেখেই মেজাজ গেলো বিগড়ে। বাচ্চাদের নিয়ে এই প্রহসন আর ভণ্ডামী চলছে যুগ যুগ ধরে।
দু:সহ দু’কারণে: প্রথমত সকালের খাবার না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, অত:পর গরমে ঘেমে নেয়ে বাহ্যক্রিয়া বন্ধ রেখে আইয়ূব খান দর্শন। যিনি এসেছিলেন তিনি গাড়ি থেকেও নামেন নি। আপেলের মত লাল চেহারার খান সাহেব গাড়ি থেকে হাত নেড়েছিলেন। আর আমরা তারস্বরে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলাম।
বলা বাহুল্য, আমরা জিন্দাবাদ বললেও খান সাহেবের আমল দীর্ঘ হয়নি। অচিরেই পালিয়ে বেঁচেছিলেন তিনি। লাভের লাভ তখনকার সময়ে দুস্প্রাপ্য লাল জিলিপি আর খাসা কচুরীর একটি ঠোঙ্গা ও কাগজের কাপে এককাপ টলটলে পানি। কাল বদলেছে। আমাদের দেশের নামও বদলে গেছে। আমরা পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ করেছি, স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু ট্র্যাডিশন বদলায়নি।
ভুল বললাম, কিঞিৎ বদলেছে। এখনও বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো নীরিহ স্কুল টিচার ও ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরি বা বেতের ভয়ে রক্ত চোখের চাউনী, বদলি হয়রানি বা বেতের বাড়ির ভয়ে লাইনে দাঁড়ায়। তবে হাতে হাতে ঠোঙ্গা বা খাবার দেয়া হয় না। দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবের স্বর্ণযুগে সোনার নৌকা দিলেও জিলিপি বা কচুরি দেয়ার টাকা থাকেনা কারো পকেটে। কারণ, ইহা সম্প্রদানকারক। ইহাতে রিটার্ন নাই।
তেমনি একটা দু:খ করার মত খবর দেখলাম আজ সকালে। নব নির্বাচিত প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের হাতে সোনার নৌকা তুলে দেয়ার ছবি ছাপিয়ে গভীর গোস্বা প্রকাশকারী মিডিয়াকে একতরফা ধন্যবাদ বা বাহবা দিতে পারলেই ভালো লাগতো।
বিশেষত যারা অতি উৎসাহে এই খবরটির শিরোনাম পর্যন্ত শুদ্ধ করে লিখতে পারেনি। অন্তত: অনলাইনে তা দেখছি। বলে রাখি, এই প্রক্রিয়ায় বাচ্চাদের ধরেবেঁধে লাইন দিয়ে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা নেতা-নেত্রীদের সংবর্ধনার অপসংস্কৃতি বন্ধ না হলে শিশু মনস্তত্ত্বের ঘা শুকোবে না. তারা কোনদিনও আধুনিক উদার নৈতিক বা বড় হয়ে উঠতে পারবে না। প্রকৃত গণতন্ত্রের দেশে এ জাতীয় আচরণ চিন্তার বাইরে। বরং আমি যা দেখেছি বা দেখছি তা শুনলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা এরশাদের মত নেতারা ভিমরি খেয়ে হাসপাতালে দৌড়াবেন।
উন্নত বা মেনে চলবার মত অগ্রসর দেশগুলোর মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেন না এ কথা বলি না। তবে সামাজিক বা নিজের সমাজ ও জনগণ নিয়ে এ ধরনের প্রহসনে নেই তারা। এগুলো এখানে অচল ও বহুকাল আগে পরিত্যাজ্য। উল্টো কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেরিতে আসা বা মিনিট কয়েক বিলম্বের জন্য নেতা মন্ত্রীদের মাফ চাইতে দেখেছি। আমাদের সন্তানদের সাথে এদের কথা বলার ধরন ও ঠাট্টা-তামাশা দেখে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবাও অসম্ভব।
কথোপকথনের মজা আর চমৎকার ইংরেজী বলতে পারার কারণে আমাদের মত বয়সীদের চেয়ে নতুন প্রজন্মের সঙ্গেই তাদের সখ্য অধিক। যে কথা বলছিলাম, বহুল প্রচলিত প্রিন্ট মিডিয়া ফলাও করে শাহরিয়ার আলমের সোনার নৌকা গ্রহণের নিন্দায় আমার সমর্থন ব্যতীত দ্বিমত নেই। থাকবার প্রশ্নও ওঠেনা। কিন্তু এই যে কয়েকদিন আগে আরেক মন্ত্রী বীরেন শিকদার সোনার নৌকা ও সিংহাসন ফিরিয়ে দিলেন, বাংলানিউজের মত জনপ্রিয় পোর্টাল সেটা তুলে ধরতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু যারা এটা না করে শাহরিয়ারের সোনার নৌকার খবর ছাপায় আহ্লাদিত তারা জনগণের একাংশের মনে আবারো প্রশ্ন আর সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে রাখলেন। যে কারণে, বাচ্চাদের লাইন ধরিয়ে অভুক্ত রেখে সোনার নৌকা গ্রহণের মত বিবেক বর্জিত কাজটিও সবার ঘৃণা বা নিন্দা কুড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।
এ প্রবণতাই আমাদের কাল। যেকোন ভালো বা খারাপ কাজকেই আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাগ করে ঝগড়ায় মেতে উঠি। একদিকে ঝুঁকে পড়ি। এখন আমাদের উচিৎ শাহরিয়ার আলমের মত মন্ত্রীদের সাবধান করার পাশাপাশি সোনার নৌকা ফেরত দিতে বাধ্য করা এবং শিশু, স্কুল টিচার বা সরকারি- বেসরকারি কর্মচারীদের নিয়ে সংবর্ধনা নামের প্রহসন চিরতরে রদ করে দেয়া। সে জায়গায় কাজ করতে হলে বীরেন শিকদার যে দলের হোক না কেন তাকে উদাহরণ হিসেবে নিতেই হবে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মনে বঙ্গবন্ধু বা তাঁর ইমেজ কিভাবে কাজ করে জানি না। এদের অনেকে তাঁকে দেখেন নি। না দেখেও যে আন্তরিক শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা রাখা সম্তব তার চর্চা আমাদের রাজনীতিতে নেই। কন্যা জায়া জননীর কাছে আবেগ বর্জিত প্রশংসা বা মূল্যায়ন চাওয়াটা অনেক সময় অরন্যে রোদন।
পাশের দেশে দেখুন। তাঁরা যতবার গান্ধীর কথা বলে ততবার নেহেরুর কথা বলে না। এমনকি ইন্দিরাও ততটা আলোচিত নন। ফলে জাতির পিতা হয়ে ওঠেন আদর্শিক আর সর্বজনগ্রাহ্য। স্তুতি আর বিরোধিতার বেড়াজালে আমরা তা পারি না। একদিকে সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ, আরেক দিকে তাঁর বিরুদ্ধে অকারণ মিথ্যাচার। যে কারণে তিনি তাঁর মত করে প্রভাবও ফেলতে পারছেন না।
শুরু করেছিলাম শৈশবে ধরে-বেঁধে লাইনে নিয়ে গিয়ে, প্রেসিডেন্ট দর্শনের অপস্মৃতি দিয়ে শেষ করব। প্রথম যৌবনে নিজের ইচ্ছেয় আরেক রাষ্ট্রপতি ও শ্রদ্ধাভাজন বিরল জন্ম মানুষকে দেখার স্মৃতিকথা বলি। আমরা তখন কলেজের ছাত্র। মাত্র কলেজে ঢুকেছি। নেতা আসবেন নেতা আসবেন এই আনন্দে শহর মাতোয়ারা। আজকের তরুণ আওয়ামী লীগাররা হয়তো জানেন না- তখনো মানুষ উপহার দিতো। প্রত্যন্ত অঞল থেকে উপহার-উপঢৌকন নিয়ে ছুটে আসতো মানুষ। তবে তা সোনা দানা নয়, আন্তরিক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় মোড়ানো বাগানের ফসল ক্ষেতের লাউ-কুমড়ো কেউবা রাত জেগে বানানো পিঠে পুলি নিয়ে আসতো টিফিন বাক্সে ভরে। গলার গামছা, হাতের চুড়ি, মাফলার-শাল খুলে দিতো কেউ। প্রয়োজন আছে কি নেই,কাজে লাগবে কি লাগবে না, উপহারটা সামান্য না বড়,তারচেয়ে অনেক বেশি ছিলো অন্তরের আহবান। নেতাও সে আহ্বান বুঝতেন সাড়া দিতেন।
সাধারণ মানুষকে গলায় জড়িয়ে কিছু দিতে না পারা বা নিতে না পারার কষ্টে চোখের জলে একাকার হয়ে যেতেন। আমি তা নিজের চোখে দেখেছি।
সেবার আমাকে কেউ জিলিপির লোভ বা বেতের ভয়ে নিয়ে যায়নি। এপ্রিলের গরমে নিজের টানেই ছুটে গিয়েছিলাম। নেতা আসতে এত বিলম্ব আর রোদের এত তেজ, মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখে প্রায় মূর্চ্ছা যাবার মত অবস্হা। তারপরও ফিরিনি। বঙ্গবন্ধুকে একঝলক দেখা ও তাঁর কথা শোনার এমনই আকর্ষণ ছিল মানুষের- সে দলের নেতারা সোনার নৌকা আর বাচ্চাদের নিয়ে সংবর্ধনার প্রহসন করেন। কি লজ্জা কি লজ্জা।
জানি কেউ কারো কথা শোনে না, শুনবেনও না। তবু বন্ধ হোক এই হীন প্রক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন, "নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে না যেন করি অপমান"। আত্মঅপমানের পথ বন্ধ করো হে অন্ধ রাজনীতি। আমাদের সুস্হতা দাও, ডিজিটালের নামে তুঘলকী কারবার কখনোই কাউকে নিরাপদ রাখেনি, রাখবেও না.
অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক, dasguptaajoy@hotmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৪