প্রত্যাশার ঘাটতি কখনোই ছিল না নতুন প্রজন্মের। বরং প্রত্যাশার ফুলন্ত বেলুনে বারংবার সূঁচের আঘাতে হতোদ্যম না হয়ে আজো যে স্বপ্নজগতে প্রত্যাশার পারদ বাড়তেই থাকে।
৫২-তে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা করতে বর্বর-অস্ত্রসজ্জিত হানাদার বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দিকে দ্বিধা করেনি সেই-সময়কার তারুণ্য। শিক্ষা ও বর্ণমালা রক্ষার জন্য বলিষ্ঠ চিত্তে ৬২-তে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী ও শাসকদের নীপিড়ন সহ্য, শোষণের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ পূরণের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ ৬৬-এর ছয়দফা, শোষক ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ৬৯ এর উত্তাল গণ আন্দোলন, দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির জয়গানে সুর মেলানোর বাসনা থেকেই ৭০-এর নির্বাচনÑ ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় পাতায়, প্রতিটি অধ্যায়জুড়ে, একের পর এক মাইল পলক রচিত করেছে আমাদের দামাল তারুণ্য।
গালিভারের সামনে লিলিপুট, কামানের বিপরীতে লাঠি, মচমচ করা পৈশাচিক বুটের সামনে সরলা লুঙ্গি-গেঞ্জি, সসস্ত্র দানবের বিপরীতে নিরস্ত্র মানব হয়েও শুধুমাত্র অদম্য চেতনা ও হার না মানা মানসিকতার জোরেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে বিজয় অনিবার্য করে তুলেছিল শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদাসোচ্চার এই তারুণ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছেন তারুণ্যের নেতৃত্বকে। মাত্র আঠারো বছর বয়সে সরাসরি জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে দেশগড়ার কাজে স্বকীয়ভাবে অংশগ্রহনের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি তারুণ প্রজন্মকে। মনে ও মননে, চিন্তায় ও চেতনায় আরো বেশী শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অধিকারী করে তারুণ্যকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি।
যে জাতির পাহাড়-পর্বত, সমতল-জলাশয়, নগরের কোলাহ- নির্জন বিরানভূমি, এমনকি যানবাহনের শনশন শব্দ থেকে প্রতিধ্বনি হতে আসা বাতাসেও তারুণ্যের উল্লাস, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও স্বপ্নছোঁয়া-অদম্যতার শ্লোগান শোনা যায়, সে জাতির সমসাময়িককালের তরুণ প্রজন্মের সন্তান হয়ে যখন বহুমুখী সংকট দেখতে পাইÑ আমরা মুষরে যাই না। সাময়িকভাবে আমাদের বোধ-চেতনা স্থবির হয়ে যায় হয়তো। কিন্তু! হতাশার চাদর আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলার আগেই ঐতিহাসিক স্বভাবের স্বাভাবিক নিয়মেই অদম্য স্বপ্নসাধ আবার জাগিয়ে দেয় আমাদেরকে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়েই আমরা খুঁজতে থাকি স্বপ্নের সোনালী দ্বার। আজো এবং এখনো এপর্যন্ত সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছি আমরা। আমাদের ঘুমের ঘোরেও আধুনিক ও উন্নত সোনার বাংলার তরতাজা স্বপ্ন।
৭১’এর পিশাচ, খুনি-ধর্ষক-নিপীড়ক-লুটেরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন করার জন্য তারুণ্যের শ্লোগানে যে রব উঠেছিল- তার সাথে একাত্ম না হয়ে থাকতে পারেনি সময়ের সবশ্রেণীর বিবেকবান-সুস্থ্য ও জীবিত সব প্রজন্ম। তারুণ্য! তাই আকাঙ্খার পারদ বাড়তে থাকে তড়তড় করে আবারো। তরুণ্যের কাছে জাতির প্রত্যাশা আকাশসম, তারুণ্যের কাছে তারুণ্যের প্রত্যাশাও অকল্পনীয়। দেশ এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে ইদানীংকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক তরুণ পেশাজীবী, উদ্যোক্তা, গবেষক, রাজনীতিবিদ, নেতা-নেত্রী, এমপি, মন্ত্রী, প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক, খেলোয়ার, শিল্পী-সাহিত্যিক- প্রতিটি জায়গা তারুণ্যের নেতৃত্বে মুখরিত। নেতৃত্ব ও সফলতায় তারুণ্যের যে ঢল নেমেছে তাতে আরো বেশী উৎসাহিত হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। আমাদের চোখের সামনে এখন সুন্দর ও শান্তির বাংলাদেশের একরাশ ডানা মেলা স্বপ্ন।
এতো বিষয় থাকতে হঠ্যাৎ কেন আমার এতো এতো তারুণ্য তারুণ্য! সেটাই বলছি। সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনাই আমাকে শেষ পর্যন্ত তাড়িত করলো নিস্তব্দতার দেয়াল ভেঙ্গে আওয়াজ তোলার জন্য।
ঘটনাটি আমাদের আমাদের রাজনীতি এবং নেতৃবৃন্দর সাথে সম্পর্কিত। সম্প্রতি উপহার হিসেবে পাওয়া সোনার নৌকা ফিরিয়ে দিয়েছেন প্রথমবারের মতো প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া একজন তরুণ সাংসদ। গত ২৪ জানুয়ারী, রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় দলের নেতাকর্মীরা তরুণ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে সোনার নৌকা উপহার দিয়ে সংবর্ধিত করেন। উপহার গ্রহন করার পর তরুণপ্রজন্মের এই নেতৃত্ব তা এক স্থানীয় প্রতিবন্ধী শিশু সংস্থায় দান করার ঘোষণা দেন এবং অনুষ্ঠান শেষ হবার পর সোনার নৌকাটি বিক্রি করে সেই অর্থ ‘প্রত্যাশা’ নামক (সেখানকার স্থানীয়) প্রতিবন্ধী শিশু সংস্থার উন্নয়নের জন্য দিয়ে দেন। সেই সাথে এধরণের উপহার ভবিষ্যতে না দেয়ার জন্যও অনুরোধ জানান তিনি। এই না হলো তারুণ্য- আমাদের অহংকার করার মতো তরুণ প্রজন্ম।
তরুণ প্রজন্ম মাঝে মাঝে হোঁচট খেলেও আবার কিন্তু তারাই স্বপ্ন দেখায়। এখন যেমন স্থানীয় পর্যায়েও সুন্দর রাজনীতির স্বপ্ন দেখতে ভালোই লাগে। শুধুমাত্র জাতীয় নেতাদের দায়িত্বশীল আচরণই তৃণমুলের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন ও দায়িত্বশীল করে তুলতে পারে- নচেত তৃণমুলের অর্থ-প্রভাব ও পেশীশক্তির এলোমেলো রাজনীতি কখনোই কোন মানবিক কাঠামোতে দাঁড়াতে পারবে না।
আরেকটি প্রসঙ্গ দিয়েই আজ শেষ করব। প্রসঙ্গটি খুব আবেগঘন এবং গুরুত্বপূর্ণ।
একটি নেতিবাচক ধারা থেকে এখনই বের হয়ে আসতে হবে আমাদেরকে। রাজনীতিবিদদের সংবর্ধনায় শিশুরা কেন? স্কুলের বাচ্চারা কেন? সঠিক শিক্ষা পেলে আজকের এই শিশুরাই একদিন বাংলাদেশ চালাবে। আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে আরো বেশী স্বপ্নময় করে তুলবে। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস শিক্ষা দিয়ে রাজনীতি সচেতন করে গড়ে তোলা হোক আগামী প্রজন্মকে। নতুন দিনের কা-ারীদের ইতিবাচক রাজনৈতিক-মানসিক গঠনের জন্য স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে ভালো ফলাফলের জন্য তাদেরকে সংবর্ধিত করে আসুন আমাদের এমপি-মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতারা। তাদেরকে আপনাদের জন্য দাঁড়া করিয়ে রাখবেন না। রাস্তার রোদে তাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়া করিয়ে রাখা কিন্তু একধরণের ঔপনিবেশিক আচরণের ধারাবাহিকতা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটি আমাদের দেশে একধরণের ট্রেডিশন হয়ে গেছে- ব্যাপারটি খুব কষ্টদায়ক। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সরকারের আমলের এমপি-মন্ত্রীদের সংবর্ধনা শীর্ষক সংবাদগুলো ঘেঁটে দেখলাম। শিশুদের দিয়ে ফুল ছিটিয়ে নেয়ার কী দরকার! আপনারা কি আপনাদের সন্তানতুল্য শিশুদের জন্য ফুল নিয়ে যেতে পারেন না! ঘোষণা দিয়ে বলুন, শিশুদেরকে আর কোন রাজনৈতিক সংবর্ধণায় স্কুল থেকে আনা হবে না। ফুল আর বই দিয়ে সংবর্ধিত করুন আগামীর ভবিষ্যতকে। তাহলেই স্বপ্নের সোনার বাংলা খুব বেশী দূরে নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের মাইলফলক তখন আর স্বপ্ন নয়। দারিদ্র ও কুসংস্কারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং সারাক্ষণ রাজনীতির পি-ি চটকাতে ব্যস্ত একশ্রেণীর নতুন প্রজন্মকে আধুনিক বাংলাদেশের সুন্দর রাজনীতির সাথে জড়াতে আপনাদের সহযোগিতাই যথেষ্ঠ। তাহলে সুযোগ্য উত্তরসূরীর উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠবে বাংলার বাতাস, শুধু কাঠামোতে নয়, মনে-মননে এবং চর্চায় প্রতিফলিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের আশীর্বাদ। সেই আশার পারদ বাড়িয়েÑ আমরা চেয়ে আছি আপনাদের দিকে, জাতির স্বার্থে তারুণ্যের গঠনে আরো বেশী মনোযোগী হবার জন্য আপনারা প্রস্তুত তো !
-আলীম হায়দার, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
বাংলাদেশ সময় ১৩৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪