১.
আমার যতগুলো প্রিয় উৎসব আছে তার মাঝে সবচেয়ে প্রিয় একটি হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার বললেই চোখের সামনে একটা প্রতিযোগিতার দৃশ্য ফুটে উঠে।
অন্যদের কাছে জানি না আমার কাছে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান মানেই একটা দুঃখের অনুষ্ঠান, আশাভঙ্গের অনুষ্ঠান। একজন দুইজন পুরস্কার পায় অন্য সবার আশা ভঙ্গ হয়। সেই হিসেবে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান একটি অসাধারণ উৎসব। কারণ সেখানে হাজার হাজার কিশোর কিশোরীর সবাই বিজয়ী, সবাই পুরস্কৃত। এরকম চকমপ্রদ অনুষ্ঠান সারা পৃথিবীতে কতোগুলো আছে আমার জানা নেই-খুব বেশি থাকার কথা নয়।
এই উৎসবে সবাই যে পুরস্কার পায় শুধু তাই নয় সেই পুরস্কারটি তাদেরকে দেয়া হয় একটি অসাধারণ কাজের জন্যে, সেটি হচ্ছে বই পড়া। কেউ কেউ মনে করতে পারে বইপড়া আর এমন টা কী বিষয়, এর জন্যে পুরস্কার দিতে হবে কেন? হাই জাম্প লং জাম্প দিয়ে মানুষ পুরস্কার পেতে পারে। কিন্তু বই পড়ে কেউ পুরস্কার পাবে কেন? কিন্তু আমার ধারণা বই পড়া একটা অসাধারণ বিষয়। যত দিন যাচ্ছে আমার সেই ধারণাটা আরো পোক্ত হচ্ছে। ]
আমি জানি না সবাই এই বিষয়টা লক্ষ্য করেছে কী না, আমরা যখন কিছু একটা পড়ি তখন আসলে কাগজের উপর আঁকি-বুকি করে রাখা কিছু ছোট ছোট চিহ্নের দিকে তাকাই (সেগুলোকে আমরা বর্ণ
বা অক্ষর বলি) সেই চিহ্নগুলো চোখের লেন্সের ভেতর দিয়ে (উল্টো হয়ে) রেটিনার উপরে পরে, রেটিনা থেকে সেই সিগন্যাল মস্তিষ্কে যায়। মস্তিস্ক সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে আমরা তখন তার মর্মোদ্ধার করি। তারপর আসল ব্যাপারটা শুরু হয়- যেটা পড়েছি সেটা কল্পনা করি। যার কল্পনা শক্তি যত ভালো সে তত চমৎকারভাবে পুরো বিষয়টা উপভোগ করে। পুরো বিষয়টা আসলে অবিশ্বাস্য রকম উঁচুমানের একটা কাজ, মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে সেটা করা সম্ভব না।
যারা বই পড়ে নিঃসন্দেহে তারা যারা পড়ে না তাদের থেকে ভিন্ন। আমাকে মাঝে মাঝেই অনেকে জিজ্ঞেস করে ভালো লেখক হওয়ার কোনো একটা শর্টকাট পদ্ধতি আমার জানা আছে কী না। আমি সব সময়েই বলি, ভালো লেখক হওয়ার একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে বই পড়া।
যে যত বেশি বই পড়বে সে তত ভাল লিখতে পারবে। আমি এটা জোর দিয়ে বলি কারণ আমাদের পরিবারের হুমায়ূন আহমেদ এই দেশের একজন অসাধারণ লেখক ছিলেন। আর তিনি একেবারে শিশু বয়স থেকে শুধু বই পড়ে আসছেন। আমার মনে হয়, সে জন্য তিনি এতো সুন্দর লিখতে পারতেন।
বই পড়ে সবাই যে সফল লেখক হয়ে যাবে তা নয়। কিন্তু বই পড়লে নিশ্চিতভাবে নিজের ভেতরে একটা পরিবর্তন হয়। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, জীবনানন্দ দাস ট্রামের তলায় চাপা পড়েছেন, মজার ব্যাপার হল তাদের লেখাগুলো এখনো পুরোপুরি জীবন্ত। যখন পড়ি তখন মনে হয় তারা বুঝি সামনে বসে আছেন।
আমাদের দেশের মানুষের বই পড়ার অভ্যাসটি কম। যত দিন যাচ্ছে মনে হয় অভ্যাসটি আরো কমে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার বাস বা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করার সময় দেখা যায় সবাই একটা না একটা বই পড়ছে ( আজকাল ই-বুক রিডার দিয়েও পড়ে)। খুব যে গভীর জ্ঞানের বই তা নয়, জনপ্রিয় কোনো বই। কিন্তু পড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সেই তুলনায় আমাদের দেশের বাস ট্রেন স্টেশনে গেলে দেখতে পাই মানুষজন খুবই বিরস বদনে কিছু না করে চুপচাপ বসে আছে (আজকাল মোবাইল টেলিফোন হয়েছে, তাই হয়তো মোবাইল ফোনে জোরে জোরে কথা বলছে)। কিন্তু বই পড়ার দৃশ্য খুবই কম। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যদিবা কেউ বই পড়ে সেটি হচ্ছে কম বয়সী ছেলে বা মেয়ে, বড় মানুষ নয়। বড় মানুষেরা পত্রিকা পড়তে পারে বড় জোর ম্যাগাজিনে চোখ বুলায় কিন্তু বই পড়ে খুব কম।
সারা পৃথিবীতেই বইয়ের প্রতিপক্ষ এখন টেলিভিশন। বই পড়া যেরকম একটা অসাধারণ উঁচু মানের মানসিক প্রক্রিয়া টেলিভিশন ঠিক সেরকম নিচু মানের মানসিক প্রক্রিয়া! বই পড়ার সময় মস্তিস্কে যেরকম নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে টেলিভিশন দেখার সময় তার কিছুই হয় না। আমরা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই সবকিছু আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে যায়।
আমি বেশ কিছু কিশোর উপন্যাস লিখেছি, মাঝে মাঝেই টিভির লোকজন আমার সাথে যোগাযোগ করে সেই উপন্যাসগুলো থেকে টিভির উপযোগি নাটক বানানোর অনুমতি চান। আমি কখনো তাদের অনুমতি দেই না। বিনয়ের সাথে বলি যখন কেউ আমার কিশোর উপন্যাসটি পড়ে তখন সে চরিত্রগুলোকে নিজের মত করে কল্পনা করে নিতে পারে। যার কল্পনা শক্তি যত প্রবল তার চরিত্রগুলো তত জীবন্ত।
কিন্তু যখন সেটি থেকে টেলিভিশনের জন্যে নাটক (বা সিরিয়াল) তৈরি হবে তখন চরিত্রগুলোকে সে আর কল্পনা করতে পারবে না, সরাসরি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হবে। একজন শিশু কিশোর যা কল্পনা করল না শিখল তাহলে তার জীবনের পাওয়ার মত আর কী থাকল?
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন জ্ঞান থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনা শক্তি। এর চাইতে খাটি কথা আর কিছু হতে পারে না, জ্ঞান যদি হয় একটা দামী গাড়ি তাহলে কল্পনা শক্তি হচ্ছে পেট্রল। পেট্রল নামের কল্পনা ছাড়া জ্ঞানের গাড়ি নিশ্চল হয়ে এক জায়গায় পড়ে থাকবে, তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না।
যারা টেলিভিশনের জন্যে নাটক তৈরি করতে খুবই আগ্রহী তখন তারা আমাকে বোঝান বই খুব বেশি মানুষ পড়ে না, কিন্তু সবাই টেলিভিশন দেখে। আমি তখন তাদের উল্টো বোঝাই সেজন্যেই বই নামে একটা বিষয়কে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যেন কেউ কেউ সেটা পড়ে অন্য সব সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে বড় হতে পারে।
যারা বই পড়ে তারা অন্য রকম মানুষ এক সময় তারাই দেশ সমাজ কিংবা পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে। এখন আউট বই পড়ার জন্যে তারা তাদের বাবা মা থেকে যতুই বকুনি শুনুক, এক সময় তারাই হবে গুরুত্বপূর্ণ।
সে জন্যে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি আমার খুব প্রিয় একটি উৎসব। আমি যদি সেখানে যাবার সুযোগ পাই তাহলে হাজার হাজার শিশু কিশোরকে দেখার সুযোগ পাই যারা অন্যদের থেকে ভিন্ন, যারা বই পড়ে। আমি জানি যারা বড় হয়ে তারাই এই দেশকে চালাবে।
ব্ইয়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে টেলিভিশনের সাথে এখন যারা একটি বিভীষন যুক্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটার নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি তৈরি হয়েছিল কম্পিউট বা হিসাব করার জন্য। এখন মাঝে মাঝেই মনে হয় এটি ব্যবহার করে কম্পিউট ছাড়া অন্য সব কাজই করা হয়। সারা পৃথিবীর সকল মানুষের ভেতরে এখন একটা দুর্ভাবনা কাজ করছে, সেটা হচ্ছে আগে যখন তরুণ প্রজন্ম তার সময়ের একটা অংশ পড়ার জন্যে ব্যবহার করতো, বেশীর ভাগ সময়েই সেই পড়া ছিল খাটি পড়া। এখন সেই পড়ার মাঝে ভেজাল ঢুকে যাচ্ছে এখন তারা অনেক সময় নষ্ট করে সামাজিক টেওয়ার্কের অপ্রয়োজনীয় ‘স্ট্যাটাস’ পড়ে।
সেই পড়াটিও ভাসা ভাসা, যেটুকু পড়ে তার চাইতে বেশি দেখে। বিষয়টি নুতন তাই কেউই সঠিকভাবে জানে না এর ফলাফলটি কী হবে। যখন কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না তখন সেটা বিশ্লেষণ করতে হয় কমনসেন্স দিয়ে। আমাদের কমনসেন্স বলে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়, যদি প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করে তখন বুঝতে হবে কোথায় বড় ধরনের সমস্যা আছে। আমার ধারণা সেটি ঘটতে শুরু করেছে। এই ব্যাপারে প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
২
বই নিয়ে শুরু করেছিলাম তাই বই নিয়েই বলতে চাই।
আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারির বইমেলা নামে একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটে। কেউ যেন ভুলও মনে না করে এটা বই বিক্রি করার একটা আয়োজন। এটা মোটও সেটি নয়, আমরা দেখেছি প্রকাশকেরা বিক্রি বাড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে মেলার সময় বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে ঠেলে মার্চে নিয়ে গেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে দর্শকরা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত হই বই করে উৎসাহ নিয়ে মেলায় গিয়েছেন কিন্তু মার্চ মাসে আসা মাত্রই তারা মেলায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
বইমেলায় একটি নিজস্ব চরিত্র আছে, আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করি। অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, শুধু অনুভব করতে পারি। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম ,বই মেলাটি যখন ধীরে ধীরে তার বর্তমান রুপটি নিয়েছে আমি আসলে সেটা সেটি দেখিনি। তবে সম্ভবত প্রথমে উদ্যোগটি আমরা দেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কার্জন হল থেকে হেঁটে হেঁটে টিএসসি যাবার সময় বাংলা একাডেমি উঁকি দিয়ে দেখি কয়েকটা টেবিলে কিছু বই নিয়ে মুক্তধারা নামের একটি প্রকাশনী তার বই নিয়ে বসে আছে।
সেই বইমেলা এখন কত বিশাল একটা জাতীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠক লেখক প্রকাশক সবাই এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ভালো ভালো লেখকেরা শুধুমাত্র বই মেলা উপলক্ষে বই লেখার বিষয়টা একেবারে পছন্দ করেন না, এর মাঝে সৃজনশীলতার অংশটি কম, কুটির শিল্পের অংশটা বেশি।
আমি যেহেতু ভালো লেখকদের দলে নই (বাচ্চা বাচ্চাদের জন্যে লেখার মহা সুবিধে,কেউ সিরিসয়ালি নেয় না, যা খুশি করা যায়। ) তাই আমি বইমেলা উপলক্ষে লিখি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যদি ফেব্রুয়ারির বই মেলা না থাকত আমার লেখালেখি বলতে গেলে হতোই না। পৃথিবীর সারাদেশে একজন লেখক তিন চার বছর সময় একটা বই লিখেন আর আমাদের দেশের লেখকদের প্রতি বছর তিন চারটা বই লিখতে হয়।
অন্যদের কথা জানি না, আমার যে লিখতেই হবে আমি সেটা নিশ্চিতভাবে জানি না, আমার পাঠক বাচ্চাকাচ্চা, তাদের কথাটা আসলে সরাসরি হুমকির মতো! তাদের জন্যে কিছু একটা লিখে ফেললে তারা যে ভালোবাসাটুকু দেখায় সেটা এতো আন্তরিক হয় আমার সেটাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই! তাই বিদগ্ধ খাটি লেখকেরা আমাদের মতো মৌসুমী লেখকদের নিয়ে যতই হাসি তামাশা করেন না কেন আমি এই বইমেলার প্রতি কৃতজ্ঞ।
আমার লেখালেখি হয়েছে এই বই মেলার জন্য। বইমেলায় পাঠক, লেখক প্রকাশক সবারই নিজস্ব একধরনের ভাবভঙ্গি থাকে। বড় লোকের ছেলে-মেয়েরা মা-বাবাকে নিয়ে আসে যেটা কিনতে চায় সেটা ঝটপট সেটা কিনে নেয়। আবার দরিদ্র মা তার সন্তানকে নিয়ে এসেছে বাচ্চটি একটা বই উল্টে-পাল্টে দেখেছে, লোভাতুর দৃষ্টি, মা টাকার হিসেব করে ম্লান মুকে বাচ্চটিকে মাথা নেড়ে নিষেধ করছে দেখে বুকটা ভেঙে যায়।
অস্বীকার করার উপায় নেই এই দেশের মানুষের জন্য আমাদের দেশের বইয়ের দাম অনেক বেশি। আমার কাছে যখন কেউ এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলে আমি তাদের সাথে একমত হই সাথে সাথে তাদেরকে আরেকটা কথা বলে আমি তাদের হচ্ছে কেউ যদি মনে করে সে যদি শুধুমাত্র বই কিনে পড়বে তাহলে কিন্তু সে খুব বেশি বই পড়বে না। কোনো একটা সখের বই কিনে সংগ্রহে রাখতে পারে কিন্তু বই তাকে পড়তে হবে না কিনে! লাইব্রেরি থেকে এনে কিংবা পরিচিত বন্ধু-বান্ধবীর কাছ থেকে নিয়ে। শৈশবে আমাকে যদি বই কিনে পড়তে হতো তাহলে আমি আর কয়টা বইটা পড়তাম?
৩
কম দামে বই পড়ার এবং সংগ্রহ করার একটা সুযোগ এসছে যদিও সেটা সবাই সমান আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেনি। সেটা হচ্ছে ই-বুক। বইটি কাগজে ছাপা বই নয়, বইটি ইলেকট্রনিক এবং সেটি পড়বে ল্যাপটপে, ট্যাবলেটে কিংবা ই-বুক রিডারে। এমন কী ভালো স্মার্টফোনেও এই বই পড়া সম্ভব। আমি জানি অনেকেই আমার কথাটা শুনে নাক কুচকে ফেলেছেন, হতাশভাবে মাথা নাড়ছেন এবং বলেছেন একটা বই যদি হাত দিয়ে ধরতেই না পারলাম, তাহলে সেটি আবার কিসের বই?
খুবই খাটি কথা। কিন্তু যখন আমি আবিষ্কার করি সারা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় বসে, পৃথিবীর প্রায় যেকোনো বই আমি মুহূর্তের মাঝে নামমাত্র মূল্যে কিনে ফেলতে পারব এবং সেটা বই পড়ার মতো পড়তে পারব, তখন আমার হাত দিয়ে স্পর্শ করার এবং নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেবার সুযোগ না থাকাটা মেনে নিতে এমন কোনো অসুবিধে হয় না। আগে যখন কোথাও গিয়েছি আমার ব্যাগে একটা বা দুইটা বই থাকতো। এখন যখন কোথাও যাই আমার ই-বুক রিডারে শ’খানেক বই থাকে, প্রয়োজনে আরো কয়েক হাজার বই থেকে যেকোন বই কিনে ফেলার সুযোগ থাকে। কেউ বিষয়টা মেনে নিক আর নাই নিক নতুন পৃথিবী কিন্তু খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।
আজ থেকে কয়েক বছর পর কাগজের বইয়ের পাশাপাশি এই অদৃশ্য ই-বুক জায়গা করে নেবে। লেখা পড়া জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণার জগতে এটা আসলে ঘটে গেছে, বিশেষ কিছু বইয়ের বেলায় কাগজের বই এখন অর্থহীন, প্রায় সব জার্নাল এখন ইলেক্ট্রনিক। আমরা যারা পুরোনো আমলের মানুষ তারা এখনো কাগজের বই আঁকড়ে ধরে রেখেছি, কিন্তু নতুন প্রজন্মের মাঝে কোনো গোড়ামি নেই, তারা ঝটপট নতুন স্টাইলের বই পড়া শুরু করবে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ভবিষ্যতে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নতুন বই না দিয়ে একটা ট্যাবলেট দেয়া হবে, সেখানে সকল পাঠ্যবই ডাউনলোড করে দেয়া হবে। বিষয়টা কিন্তু খুবই অসম্ভব কল্পনা নয়, প্রতি বছর প্রায় তিরিশ কোটি নতুন বই ছাপানো থেকে এটা লক্ষগুণ সহজ কাজ। ছোট শিশুরা নতুন পদ্ধতিতে ঝটপট অভ্যস্ত হয়ে যায়, কাজেই ঠিক করে পরিকল্পনা করে একটা দু’টা পাইলট প্রজেক্ট হাতে নিলে এই বিপ্লবটি করে ফেলা যেতেই পারে।
কাজেই সবাইকে মাথায় রাখতে হবে বইয়ের জগতে নতুন একটি পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। যারা পরিবর্তনটুকু গ্রহণ করতে রাজি তারা এগিয়ে থাকবে। অন্যরা পিছিয়ে যাবে।
আমাদের দেশেও কিন্তু এই উদ্যোগটি নেয়া শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছর আমার কাছে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা এসেছেন, আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন, তারা আমার একটি দু’টি বই ই-বুকে পাল্টে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও শুরু করেছেন। বিষয়টা ঠিক কিভাবে অগ্রসর হবে আমরা জানি না। যারা প্রযুক্তিবিদ তারাই কী প্রকাশক হয়ে যাবেন কী না সেটা নিয়েও অনেকের মাঝে সন্দেহ রয়েছে।
আমার ধারণা প্রযুক্তিবিদ যদি শুধুমাত্র প্রযুক্তির একটা ভিত্তি তৈরি করে দেন আর প্রকাশকেরা কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক বই ছাপানোর দায়িত্ব নিয়ে নেন তাহলেই এই নতুন বিষয়টা ঘটে যেতে পারে। আমরা অনেক কম খরচে অনেক বই পড়া শুরু করতে পারব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতি বছর আমাদের আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি টাকার বই কিনতে হয়। বিদেশি একটা বইয়ের দাম দশ পনের হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আইসিটি ইনস্টিটিউট তৈরি হচ্ছে তার লাইব্রেরির জন্য প্রায় তেরো হাজার বই কেনার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। গড়ে একটা বইয়ের দাম পড়েছে মাত্র চল্লিশ টাকা। কারণ বই গুলো ই-বুক।
ইনস্টিটিউট তৈরি শেষ হয়নি, লাইব্রেরির দেওয়াল ওঠেনি, শেলফ কেনা হয়নি। তেরো হাজার বই যেকোন দিন চলে আসবে, বইগুলো কোথায় রাখা হবে সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। বইগুলো উইয়ে খেয়ে ফেলবে কী না সেটা নিয়েও আমার দুশ্চিন্তা নেই। কোনো দুষ্টু ছেলে বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলবে কী না সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই।
আমাদের ডাটা সেন্টারের সার্ভারের হার্ড ড্রাইভে তেরো হাজার বই রাখতে কিংবা সংরক্ষণ করতে আমার এক চিমটিও বাড়তি জায়গা লাগবে না।
ভবিষ্যতের লাইব্রেরি কেমন হবে সেটি কী সবাই কল্পনা করতে পারছে?
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৪