যে কোন আন্দোলন যখন চলমান কিংবা সফলতার মুখ দেখে তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়। আমাদের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে।
প্রতিবাদ করেছি সকল প্রকার শোষণ, নিপীড়ন ও অসমতার বিরুদ্ধে। আর এই প্রতিবাদের ভাষা কখনো আমরা এঁকে দিয়েছি মিছিল, মিটিংয়ের মাধ্যমে, কখনোবা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। আর এসব সংগ্রামের মাধ্যমেই রচিত হয়েছে আমাদের অন্যায়ের প্রতিবাদের ইতিহাস।
এসব আন্দোলন চলার সময় এবং চুড়ান্ত সাফল্য পাওয়ার জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় যেমন দিতে হয়েছে তেমনি দিতে হয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। তবুও প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। যেখানে কোনো অসামঞ্জস্য কিংবা অন্যায় হয়েছে সেখানেই এই জাতি প্রতিবাদ করেছে।
আমাদের প্রতিবাদের এই যে ঐতিহ্য রয়েছে তার সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি। যখন মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা হয়। ফাঁসির রায় না হওয়া এবং এরপর ওই আসামির ‘ভি’ চিহ্নিত প্রতীক গণমাধ্যমে দেখে এই দেশের তরুণ সমাজ ঘরে বসে থাকতে পারেনি। তাদের মনে হয়েছে এই রায় ওই কুখ্যাত আসামির জন্য যথেষ্ট নয়। আর যদি যথেষ্টই হবে তাহলে আসামি কেন ভিক্টরি সাইন দেখাবে? অর্থাৎ ওই আসামি নিজেকে বিজয়ী মনে করেছিল। এই দেশের বর্তমান প্রজন্ম যেটি মেনে নিতে পারেনি।
তৈরি হয় আমাদের প্রতিবাদের আরেকটি অধ্যায়। এই প্রতিবাদ প্রথম রচিত হয়েছিল এই দেশের তরুণ প্রজন্মের দ্বারা। এর পরের সব অধ্যায় রচিত হয়েছে এ দেশের আপামর জনগণের দ্বারা। যে প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিলো ৫ ফেব্রুয়ারি, সেটি কিন্তু এখনো চলমান। শুরুতেই বলেছি যেকোনো প্রতিবাদ যখন চলমান থাকে, এটিকে চালিয়ে নিতে এবং সাফল্যের দিকে ধাবিত করতে রয়েছে অনেকের ত্যাগ এবং নিঃস্বার্থ অংশগ্রহণ। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা রকম প্রোপাগাণ্ডা বা অভিযোগ।
এই লেখার মূল বিষয় হচ্ছে একটি আন্দোলন যখন চলতে থাকে তখন অনেককেই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, আবার অনেককে অনেক রকম হয়রানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এর মাঝে হয়তো কিছু কিছু ত্যাগ বা হয়রানির কথা আমরা পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্যে জানতে পারি। আর অনেক ত্যাগের কথা হয়তো আমাদের আর জানা হয়ে ওঠে না। যে কোন আন্দোলনের ক্ষেত্রেই আসলে এটি হয়। অনেক বড় পরিসরে যদি একটি আন্দোলন হয় সেখানে সবার সব কিছু আপনি জানবেন এটি আসলে আশা করা ঠিকও নয়।
শাহাবাগের জমায়েত ৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচারসহ ৬ দফা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে, সেখানে অনেক তরুণ রয়েছে যারা সরাসরি রাজপথে শামিল হয়েছে আবার এমন অনেকেই রয়েছেন যারা নানামুখী ব্যস্ততা কিংবা অন্যান্য ঝামেলায় হয়তো সব সময় রাজপথে থাকতে পারেন নি, কিন্তু লেখালেখির মাধ্যমে কিংবা ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ করে গেছেন। এছাড়া আরও অনেক ভাবেই যে যেভাবে পেরেছেন হয়তো এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। আর সত্যি কথা বলতে কি এটি তো সাধারণ মানুষের আন্দোলন। তাই অনেকেই অনেকভাবে এই আন্দোলনে যেমন সম্পৃক্ত হয়েছেন তেমনি করেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ।
এই প্রতিবাদী মানুষগুলোর অনেকেই হয়তো এর আগে রাজপথে নেমে এসেছে, নয়ত তাদের লেখনীতে সেভাবে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে সবাই হয়েছে প্রতিবাদী। তবে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন বা করছেন যা আমরা হয়তো জানি না ।
প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল মানুষগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকিতো রয়েছেই। তবে সেটি আমরা সবাই জানি এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চরিত্র ও তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত। এর বাইরে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন গত ৫ ফেব্রুয়ারির পর।
৫ ফেব্রুয়ারির পর অনেকেই হয়তো রয়েছেন যাদের হয় চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে, নয়তো চাকরিটি চলে গেছে। আবার অনেকেই রয়েছেন যারা চাকরি করে যাচ্ছেন। তবে হয়তবা প্রাইভেট চাকরি করার কারণে অফিসের বসের কাছে অনেক কিছু শুনতে হচ্ছে এই বলে যে ‘এই সব ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার? অফিসের কোন ক্ষতি হতে পারে। আর এসব ঝামেলায় জড়াবেন না’।
অনেকেই আছেন যাদের পরীক্ষা মিস হয়ে গেছে। ইয়ার ড্রপ হয়ে গেছে। এছাড়া আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। সংখ্যা না বাড়িয়ে যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে এরা প্রত্যেকেই ত্যাগ স্বীকার করেই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে এবং এদের অনেকের কথা হয়তো আমরা জানি না। যেহেতু একটা আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়, তাই এরা এটি মাথা পেতে নিয়েছেন। তবে এদের এই ত্যাগকে কিন্তু সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর কিন্তু আজও আমরা শুনি কোন একজন মুক্তিযোদ্ধা জীবন যুদ্ধে হেরে গেছেন কিংবা উনি যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সেটিই কেউ জানে না। এই রকম আরও অনেক খবরই আমরা শুনতে পাই। শাহাবাগ আন্দোলনকে একটা সময় বলা হয়েছে নতুন একটি মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সেই রকম কিছু। এই আন্দোলনটির প্রাথমিক সাফল্য আমরা দেখছি, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার মাধ্যমে। হয়তো একটা সময় এই আন্দোলনটি সফল হবে। তখন যেন এই যোদ্ধাদের আমরা ভুলে না যাই।
শাহবাগ আন্দোলনের এক বছর পূর্তি বুধবার। একটি লড়াইয়ে অনেকগুলো পক্ষ তৈরি হয়, থাকবে ভিন্ন মত। সব পক্ষের সব কাজের দায়ভার যেমন কারো পক্ষে নেওয়া সম্ভব না, ঠিক তেমনি সব পক্ষের মতামত ও তাদের অবদানকে স্বীকার করতে হবে। ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে “হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ”। আমাদের “অন্যায়ের প্রতিবাদের” ইতিহাসটি ঘুরে ফিরে আসুক। আর ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পতিত হোক বিভাজন ও অস্বীকৃতির ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস হবে ঐক্য, সম্মান ও স্বীকৃতির ইতিহাস। আর এই ইতিহাস ফিরে ফিরে আসবে আমাদের অনাগত দিনগুলোতে।
আমিনুল ইসলাম: সহকারি অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় , tutul_tuk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ০০০১, ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪
মুক্তমত
শাহবাগ আন্দোলন ও প্রত্যাশা
আমিনুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।