ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নারী নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার ইন্টারনেট

আফসানা ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৪
নারী নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার ইন্টারনেট

প্রযুক্তির প্রসারের ফলে মোবাইল, ইন্টারনেটসহ যোগাযোগের অত্যাধুনিক মাধ্যম আজ আমাদের হাতের নাগালে। যোগাযোগ, আনন্দ ও বিনোদনে ইন্টারনেট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।



কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে পরিধি বেড়েছে হুমকি, চাঁদাবাজি ও নারী নির্যাতনের মত অপরাধের। মূলত দুষ্কৃতির নব্য হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে ইন্টারনেট। ১৯৯৬ সালে  আমাদের দেশে ইন্টারনেটের আবির্ভাবের পর বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধের মাত্রা, যেখানে বেশির ভাগেই নারীকে উপজীব্য করা হয়।

সহজলভ্যতার কারণে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠছে অনেক সাইবার সেন্টার। বিশেষ করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা সাইবার ক্যাফেগুলোতে সময় কাটাতে যায়। এদের অনেকে চ্যাট করে ও পর্নো ওয়েবসাইট দেখে সময় কাটায়। পাড়া মহল্লায় মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠা এসব সাইবার ক্যাফের গোপনীয়তা কখনো কখনো কিশোরদের সাইবার অপরাধ সংগঠনে আকর্ষণ করছে। কিশোর বয়সেই তারা জড়িয়ে পড়ছে বিবেক বিবর্জিত অপরাধে, হচ্ছে নৈতিকতার অবক্ষয়। বয়ঃসন্ধিকালে যখন সঠিক নির্দেশনা প্রয়োজন, তখন তারা অতিরঞ্জিত পর্নো ওয়েবসাইট থেকে তথ্য পায় যা কিনা তাদের কৈশোর তথা ভবিষ্যৎকে সংকটাপন্ন করে তোলে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং বন্ধুমহলের প্ররোচনা।

এটা কিশোর বয়সের অবুঝ অপরাধ নয়, জেনে বুঝে প্রচারণা, ফটোশপ এডিটিং, সাইট হ্যাকিং ও নানা কোলাজের চাতুরিতে জড়িয়ে পড়ছে বিকৃত ধ্যান ধারণার কিছু মানুষ। নীতি-নৈতিকতার অভাবে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার নারী, তার অভিভাবকরা নানারকম সঙ্কটে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে নারীরা এ ধরনের সাইবার ক্রাইমের গিনিপিগ হয়ে ওঠেন। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় প্রেমের সম্পর্ক, যৌনসম্পর্ক, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি মোবাইল ফোনে বা গোপন ক্যামেরায় ধারণ ও প্রেমের সম্পর্কে অবনতি ঘটলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার নোংরামি চলে।

মোবাইলে অশ্লীল বার্তা প্রেরণ,একজনের মুখের ছবিতে অন্যের আপত্তিকর ছবি জুড়ে দেয়া, ফেসবুক ও ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি-ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের সাইবার অপরাধ হয়ে উঠছে নারী নির্যাতনের সহজ মাধ্যম। ভুয়া অ্যাকাউন্ট, পাইরেসি, অশ্লীল ছবি পোস্ট করা, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করা, ইভটিজিং, পর্নোগ্রাফি এখন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে।

সম্প্রতি এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায় ফেসবুকে, বিবাহযোগ্য পাত্রী শিরোনাম দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ছবি দিয়ে খোলা হয়েছে কিছু পেজ। অনেকসময় বন্ধুমহলে নিছক দুষ্টুমিও হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ। কেননা কখনোবা মেয়ে বন্ধুদের ছবিগুলো এক প্রোফাইল থেকে অন্য প্রোফাইলের খারাপ হাতে চলে যায়। আর এভাবেই প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে, হচ্ছেন নির্যাতিত।

বিদ্যমান আইনের সঙ্গে পরিচিতি না থাকা আর এর প্রয়োগ না হওয়ায় অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে, ঘটিয়ে যাচ্ছে নিত্য নতুন অপরাধ।

ভদ্রতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মেনে চলার চর্চা পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রে কার্যকর করতে হবে এবং নারীর প্রতি সম্মান পরিবার থেকেই শিখতে হবে। আর সচেতনতার জন্য প্রত্যেকেরই জানা চাই সাইবার ক্রাইম সম্পর্কিত আইনগুলো। আর এইভাবেই  রুখতে হবে প্রযুক্তির অভিশাপ ।

সাইবার মাধ্যমে নারী নির্যাতন বিষয়ক বিদ্যমান কিছু প্রাসঙ্গিক আইন রয়েছে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ এ আইন অনুযায়ী- ৮ অধ্যায়ের (১) নং ধারায় বলা হয়, কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের উদ্দেশে কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে প্রলোভন দিয়ে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির, ভিডিও বা চলচ্চিত্র ধারণ করলে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে। (২) যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে কারও সম্মানহানি করে বা কাউকে ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় করার চেষ্টা চালায় তবে বিচারক ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদি কারাদণ্ড আরোপ করতে পারবেন এবং তদুপরি, ১ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করতে পারবেন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৯ (সংশোধিত)-এর ধারা (৫৭) অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থার বিবেচনায় কেউ পরলে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কার্য হবে একটি অপরাধ।   তথ্যপ্রযুক্তি আইনে পরোয়ানা ছাড়াই অপরাধীকে গ্রেফতার এবং সাত থেকে ১৪ বছরের দণ্ড হতে পারে।

সর্বপরি এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে সবার আগে প্রয়োজন মানুষের নৈতিকতার বিকাশ এবং সচেতনতা। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ  মাধ্যমে নারী নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। পিতা মাতাকে আরো সচেতন হতে হবে। উঠতি বয়সের সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারে অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। নারীদের সচেতন হতে হবে ইন্টারনেট ব্যবহার ও মানুষের প্রতি বিশ্বাসের জায়গা থেকে। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোর মত ‘নেট ন্যানি’ বা ‘সেফ সার্চ’ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহারও দিতে পারে  অনৈতিক ছবি ও পোস্ট এ ধরনের অপরাধ রুখতে। আর প্রশ্রয় নয় দরকার প্রতিরোধ।   আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রচার-প্রচারণাও।

আফসানা ইসলাম: অতিথি শিক্ষক, শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, আজিমপুর, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।