সম্প্রতি বাংলাদেশে পাকিস্তানের টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত আনন্দের।
তবে দেশে থাকা অবস্থায় দেখেছি ভারতীয় চ্যানেলগুলো কিভাবে আমাদের চ্যানেলগুলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বাড়ির বড়দের সঙ্গে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও হিন্দি সিরিয়াল ও হিন্দি নাচ-গানের ভক্ত হয়ে হিন্দি সিরিয়ালের ঢংয়ে হিন্দিতে অনর্গল কথা বলতে শুনেছি। যে বাচ্চার মুখের বোল এখনো ফুটেনি, সেই বাচ্চাকেও হিন্দি চটুল আইটেম গানের সঙ্গে নাচতে দেখেছি। হিন্দি সিরিয়ালের কোনো এপিসোড কোনো কারণে মিস গেলে এক ভাবীকে আরেক ভাবীর কাছে ফোন করে ঘটনা জেনে নিতে দেখেছি।
অথচ আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতেও বিভিন্ন ধারার মানসম্মত অনুষ্ঠানের অভাব নেই।
ঘরে ঘরে হিন্দি সিরিয়ালের পাশাপাশি হিন্দি মুভির কথা বিশেষভাবে বলার কিছু নাই। হিন্দি মুভি ইন্ডিয়ানরা দেখার আগেই বোধহয় আমাদের দেশের দর্শকরা হামলে পড়েন। মুখে চরম ভারত বিদ্বেষীরাও হিন্দি মুভির ভক্ত। ইদানিং নাকি বাংলাদেশের দর্শকরা তামিল, মালায়লাম এসব মুভিও দেখছে!!!
আমাদের দেশের সব পত্রিকা তাদের বিনোদন পাতাগুলো ভারতের মুভি, নায়ক-নায়িকা এমনকি ভিলেনের খবর দিয়ে ভরিয়ে রাখে। শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকায় তো বলিউড বলে আলাদা একটা সেকশনই আছে। ভারতের মুভি কবে মুক্তি পেল, কত টাকা ব্যবসা করলো, কোন নায়িকা কোন আইটেম ড্যান্স করে কত পেলেন, কার বাড়িতে আগুন লাগলো, কার সর্দি-কাশি হলো এ জাতীয় সবকিছুই সেখানে স্থান পায়!
কিন্তু ভারতের মুভির খবরে আমাদের কি যায় আসে? ভারতের অর্ধনগ্ন নায়িকা ও নায়কের ঘনিষ্ঠ ছবি দিয়ে আমাদের রুচিশীল পাঠকদের জন্য আমরা কেমন বিনোদনের ব্যবস্থা করছি? কোন শ্রেণীর পাঠকের কোন ধরনের বিনোদন দেবার জন্য আমাদের মিডিয়া এসব খবর প্রচার করছে? পত্রিকাগুলো কেন ভারতীয় মুভির প্রচার এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে?
কে না জানে প্রচারেই প্রসার। তাইতো, পর্ণ তারকার মুভিও আজ ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়ছে। উঠতি বয়সীদের পিসির গিগা খেয়ে নিচ্ছে ভারতীয় যত নোংরা ছবি।
ভারতীয় সিরিয়ালের দ্রিম দ্রিম শব্দ দূষণে যখন পুরো দেশ অসুস্থ, ভারতীয় নগ্ন নায়িকার ছবি দিয়ে যখন আমাদের পত্রিকাগুলো কাটতি বাড়াতে মরিয়া, ঠিক এমন অবস্থায় সংস্কৃতি মন্ত্রী হয়ে জনাব আসাদুজ্জামান নূর ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা না করে কেন ভারতীয় ছবির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে বাংলাদেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন বলে ভাবছেন তা সত্যি বোধগম্য নয়।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে হলেও আমাদের বাংলা সিনেমা এখন অনেক পরিণত। অতি সম্প্রতি আমরা মাটির ময়না, ঘেটুপুত্র কমলা, টেলিভিশনের মত আন্তর্জাতিকমানের সিনেমার পাশাপাশি বেশ কিছু হাই বাজেটের সফল বাণিজ্যিক ছবি উপভোগ করছি। দর্শকরাও হলে গিয়ে মুভি দেখছেন। তবে অনেকেই হলে গিয়ে মুভি দেখার ইচ্ছে থাকা সত্বেও দেখতে পারেন না শুধু হলের মানসম্মত পরিবেশ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে।
চোরাই সিডি-ডিভিডি দিয়ে বলিউড ও কলকাতার ছবি আমাদের দর্শকরা দেখছেন, আর এই কারণে নূর সাহেবরা যদি ভারতীয় সিনেমার বাজার খুলে দেবার যুক্তি দেন, তাহলে তো পর্ণ ছবির বাজারও উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। ওইসব নোংরা ছবিও তো চোরাই সিডি-ডিভিডি দিয়ে বাজারে ঢুকছে!
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনকিছু আটকে রাখা মুশকিল বলে যদি কেউ যুক্তি দেখান, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তাহলে ভারত সাংস্কৃতিক দিক থেকে এত শক্তিশালী হবার পরেও বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো প্রচার বন্ধ রেখেছে কোন যুক্তিতে? তারা কি মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবিধা নিজেদের ক্ষতি করে বন্ধ করেছে বলে মনে হয়?
ওরা যদি আমাদের চ্যানেল প্রচারে নিজেদের বাজার পশ্চিমবঙ্গে হারাবে বলে মনে করে ভয়ে বন্ধ রাখে, তবে আমরা কোন সাহসে ওদের চটপটি, যৌন সুড়সুড়ি মার্কা নগ্ন ছবি নিজেদের হলে অবাধে প্রবেশের অনুমতি দেই?
ভারতীয় চ্যানেলগুলো এদেশে ঢুকে আমাদের সংস্কৃতির তো অলরেডি বারোটা বাজিয়েছে, এখন দেখার অপেক্ষা ভারতের মুভি এদেশের হলে হলে প্রদর্শন করে আসাদুজ্জামান নূর সাহেবদের মতে সংস্কৃতির মান ও উত্কর্ষতা কিভাবে বাড়িয়ে তোলে?
প্রশ্ন হলো, এতটুকু দেশপ্রেম যদি অন্তরে লালিত হত, তবে ভারতীয় চ্যানেল ও মুভি প্রচার এদেশে দ্রুত বন্ধ করার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মুভি ও হলগুলো আরো উন্নত করার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারত, তা না করে নিজেদেরকে ভারতের কাছে ইজারা দেয়ার মানে কি?
সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন একটা প্রজন্ম নিজেদের মাঝে হিন্দিতেই কমিউনিকেট করবে। যে উর্দুকে হটিয়ে বাংলাভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, সেই উর্দুর মতই শুনতে হিন্দি ভাষাই এখন অনর্গল আমাদের ঘরে ঘরে বেজে চলছে। আর এর দায় কি ভারতপ্রেমী আমাদের নীতিনির্ধারক, পত্রিকা, সর্বপরি আমাদের দর্শক, সবার নয়?
ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৪