ভূমিকা
২০০ বছর ব্রিটিশ, ২৪ বছর পাকিস্তান এবং স্বাধীনতার পরও ৪২ বছর ধরে মানুষ শিক্ষা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করছে। সময় ও প্রেক্ষাপট পাল্টালেও শাসকের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে।
স্বাধীনতার পর সব সরকারই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদেও সর্বজনীন ও অভিন্ন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। পিআরএসপি’র রিপোর্টও (২০০৮) বলা হয়েছে একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও প্রকৃত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর কথা। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ইউজিসি’র রিপোর্টেও মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে গুণগত পরিবর্তনের বিপরীতে শিক্ষাকে করা হয়েছে একটি বাণিজ্যিক পণ্য। বর্তমান সরকারও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার সর্বজনীন সুযোগ ও মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষাখেত্রে সরকার ও নীতি নির্ধারকদের বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা ও নীতির অভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন ব্যাহত হচ্ছে একই সাথে সমাজে অসন্তোষ, অস্থিরতা ও অনৈক্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনিশ্চিত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী-অবিভাবকের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অধিকার, স্বপ্ন ও জীবন।
মানবসম্পদ ও মানবপুঁজির তত্ত্ব (Human Capital Theory) আজ বিশ্ব অর্থনীতির পাঠ্য ও স্বীকৃত বিষয়। এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চমকপ্রদ অনেক গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে শিক্ষার সাথে উন্নয়নের সম্পর্ক। এ মহতী কাজের জন্য আর্থার সোল্জ, গ্রে বেকার, এম ফ্রিডম্যান, অমর্ত্য সেনসহ অনেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার আলোকে এই নিবন্ধে শিক্ষায় বিনিয়োগ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সম্পর্কে কিছুটা আলোচনার প্রয়াস।
শিক্ষা, মানবসম্পদ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন
আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা একটি স্বীকৃত বিষয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। যদিও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে সমাজের বহুমাত্রিক ভাবাদর্শের উপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল অর্থ উপার্জন না ব্যক্তির চরিত্রের বিকাশ, তা এখনও অনেকের বিতর্কের বিষয়। এটাই স্বাভাবিক, সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের মানুষ থাকার কারণে শিক্ষার অর্থ এবং সংজ্ঞায় থাকবে নানা বৈচিত্র্য। চলমান এই বিতর্কের সহজে অবসান না হলেও, এটা নানাভাবে প্রমাণিত যে, শিক্ষা এবং উন্নয়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গী।
তত্ত্বগতভাবে মানবপুঁজির উপযুক্ত ব্যবহার ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন বিশ্বে একটি স্বীকৃত ধারণা। Psacharopoulos এবং Woodhall এর মতে, মানবসম্পদ মূলত একটি জাতির প্রকৃত সম্পদ। উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ হচ্ছে প্রত্যক্ষ উপাদান (Active Agencies), দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পুঁজি হচ্ছে পরোক্ষ উপাদান (Passive Factors)। মানবসম্পদই দ্বিতীয় বিষয়টি মানে, পুঁজি বিনিয়োগ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করে তৈরী করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং তা নিশ্চিত করে জাতীয় উন্নয়নে অগ্রসর হয়। (Human resources constitute the ultimate basis of wealth of nations. Capital and natural resources are passive factors of production, human beings are the active agencies who accumulate capital, exploit natural resources, build social, economic and political organization, and carry forward national development (Psacharopoulos and Woodhall: 1997).
প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব অনুযায়ী প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সাথে জড়িত হয়ে শিক্ষা জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। যেমন শিক্ষায় প্রচুর বিনিযোগ করে হংকং, দ. কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার এইদেশ গুলো হতে পারে বড় উদাহরণ। মানবপুঁজির উন্নয়নে শিক্ষায় বিশাল বিনিয়োগ তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হয়েছে। শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতার ফলেই চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তর করে শিল্পায়নে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করেছে।
১৯৯৯ সালে অমর্ত্য সেন তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে অন্যতম প্রধান বিষয়/শর্ত.. যেমন, অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জাপানের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের শিক্ষার হার ও মান ছিল অতি উঁচু। ” সঙ্গতই বলা যায় শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ একটি জাতির অবস্থা কিভাবে পাল্টে দেয় তার একটি সফল গল্প হচ্ছে আমাদের এশিয়ার দেশ জাপান। বহু আগে জাপান শিক্ষাকে বিশাল পুঁজিতে রুপান্তরিত করেছে। শতভাগ শিক্ষিত জাপানিদের অর্থনৈতিক সম্পদের মধ্যে ১ শতাংশ প্রাকৃতিক পুঁজি, ১৪ শতাংশ ভৌত বা বস্তুগত পুঁজি এবং ৮৫ শতাংশ শিক্ষা সংক্রান্ত মানবিক ও সামাজিক পুঁজি।
শিক্ষায় বিনিয়োগে Rate of Return অধিক। শিক্ষিত শ্রমশক্তির আয় অধিক হয় বিধায় সব অবিভাবকই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠান। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার Rate of Return ১৮ শতাংশ বা তার উপর। মালয়েশিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছরের বাড়তি শিক্ষায় একজন কৃষক ২ থেকে ৫ গুণ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন। কারণ অধিকতর শিক্ষায় কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গী উন্নত হওয়ার কারণে তারা সৃজনশীল হয়, নতুন পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী হয়। ৪ বছরের অধিক শিক্ষিতরা কৃষিক্ষেত্রে সার ও প্রযুক্তি ব্যবহারে তুলনামূলকভাবে বেশি আগ্রহী হন যারা ১ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত শিক্ষা নিয়েছে তাদের থেকে।
শিক্ষায় বিনিয়োগের কারণে ব্যক্তি, সমাজ ও সমগ্র বিশ্ব লাভবান হয়। মোটকথা শিক্ষা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ ও হাতিয়ার। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিক নোবেল বিজয়ী থিওডর ডব্লিউ সোলজ “মানবপুঁজির” ধারণাকে পরিচিত করেন এবং এই তত্ত্বের সম্প্রসারণ ঘটান আরেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিক গ্রে বেকার। তাদের মতে ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা এবং জ্ঞান শ্রমবাজারে তাদের মূল্য বৃদ্ধি করে। শিক্ষায় বিনিয়োগের অনেক পরোক্ষ ইতিবাচক (positive externalities or spillover benefit/effects) উপকার ও প্রভাব আছে। যেগুলোকে আমরা ভোগ করতে পারি এবং নানাভাবে এ থেকে লাভবান হতে পারি। নোবেল বিজয়ি ধ্রুপদী অর্থনীতিক মিল্টন ফ্রিডম্যান ১৯৬২ সালে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু Spillover Effects এর ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, নাগরিকদের একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে কিছু অভিন্ন ন্যূনতম শিক্ষা, জ্ঞান ও মূল্যবোধ ব্যতিরেকে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ গড়া অসম্ভব, শিক্ষা সেই কাজটি করে থাকে। একে কেবল অর্থনীতির চালিকা হিসেবে নয়; বৃহত্তর বিবেচনায় তা নৈতিকতা, মানবতা, দক্ষতা, সামর্থ্যের গুণাবলিও অর্জনের কারণ (রহমানঃ ২০০২)।
বিশ্বে উন্নয়নের মডেলঃ বাংলাদেশ কোন পথে?
পৃথিবীর যেসব দেশকে আজ আমরা সভ্য, গণতান্ত্রিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে উদাহরণ হিসেবে গণ্য করি, সেসব দেশের উন্নয়নের ইতিহাস আমরা কতটা জানি। এই দেশগুলো আজকের মতো এমন উন্নত ছিল না; তাদেরও নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্যে দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানত যে বিষয়গুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে: ১. মানবসম্পদ ২. প্রাকৃতিক সম্পদ ৩. শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। আধুনিক অর্থনীতির উন্নয়নের এই ধারণা ও তত্ত্বকে প্রয়োগ করে বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে উন্নত হয়েছে। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তিনভাগে ভাগ করতে পারি।
প্রথমতঃ মানবসম্পদের এই তত্ত্বকে ব্যবহার করে যেসব রাষ্ট্র উন্নত হয়েছে, জাপান, দ. কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া এই শ্রেণিভুক্ত। এক সময় এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ছিল সীমিত।
দ্বিতীয়তঃ প্রাকৃতিক সম্পদের এই তত্ত্বকে ব্যবহার করে যে সব রাষ্ট্র উন্নত হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে সৌদি আরব, ইরান, কাতার, লিবিয়াসহ তেল সমৃদ্ধ দেশসমূহ। এদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ ছিল সীমিত।
তৃতীয়তঃ জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ও প্রাকৃতিক সম্পদ এই তত্ত্বকে ব্যবহার করে যে সব রাষ্ট্র উন্নত হয়েছে তাদের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি; এদের মানবসম্পদ ছিল খুব সীমিত।
উন্নয়ন মডেলের এই ৩টি ধারার প্রথমটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য; কারণ আমাদের আছে মানবসম্পদের প্রাচুর্য আর তাকে ব্যবহার করেই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। আর মানবসম্পদ ব্যবহারের সাথে সম্পর্ক উপযুক্ত শিক্ষার; যে শিক্ষার সাথে দেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি পরিকল্পিত সংযোগ থাকবে।
বাংলাদেশের প্রকৃতিক সম্পদ খুবই সীমিত। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়ন নির্ভর করছে মূলত দক্ষ জনশক্তির উপর। বিশ্বব্যাংক (২০০০), ইউএনডিপি (২০০০), ইউনেস্কো (১৯৯৯) সালে তাদের সবার রিপোর্টেই বলেছে মানবসম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নের আর কোনো পথ খোলা নেই। সব রিপোর্টেই বলা হয়েছে, দেশের এই অধিক জনগোষ্ঠীকে অতি জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার মাধ্যমে বিশাল শ্রমবাজারের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কথা।
শিক্ষায় বিনিয়োগই নিশ্চিত করতে পারে টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন
অর্থনীতির সূত্র, তত্ত্ব ও গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব ও অনিবার্যতা। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে মানবসম্পদের উন্নয়নের সাথেই নিজেদের উন্নতির প্রশ্নটি যুক্ত। সরকারের বিভিন্ন রিপোর্ট ও বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং তাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ইত্যাদি কথা জানতে পারি। তা কি কেবল জনসন্তষ্টি লাভের আশায়? এর সাথে যুক্ত ভোট, ক্ষমতা ও দাতাদের আস্থা অর্জনের বিষয়টি। কারণ উচ্চশিক্ষার অর্থায়নে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে এই সন্দেহ শতভাগ উস্কে দেয়। সুতরাং উচ্চশিক্ষার আর্থিক দায় কার, আজ এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী মঞ্জুরি কমিশনের কৌশলপত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব ধরণের ভর্তুকি তুলে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০ বছর মেয়াদী (২০০৬-২০২৬) দীর্ঘ এই পরিকল্পনা চারটি ধাপে (২০০৬-২০০৭ প্রাথমিক, ২০০৮-২০১৩ স্বল্পমেয়াদী, ২০১৪-২০১৯ মধ্যমেয়াদী, ২০২০-২০২৬ দীর্ঘমেয়াদী) বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় থেকে সেই অর্থের সংস্থান করার কথা বলা হয়েছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যয়ের ৫০ শতাংশ আসতে হবে তাদের নিজস্ব আয় থেকে। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে আর যে ঋণের মহাজন হবে দাতাসংস্থাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক। এক শ্রেণির শিক্ষক, বণিক ও রাজনীতিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র পাল্টে তাকে মুনাফা তৈরির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে তৎপর! তারই অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বৃদ্ধি ও সান্ধ্য কোর্সের ঘোষণা, এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ.. এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা.. যুদ্ধবিরতি..! কিন্তু আসল প্রশ্নটি জিইয়েই রাখা হলো!
নীচের সারণিতে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয়, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপি (%) এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় একজন শিক্ষকের মাসিক বেতনের চিত্র উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশের চেয়েও দরিদ্র দেশ ইথিওপিয়া; জিডিপি অনুসারে যাদের অবস্থান ১৬৯। তাদেরও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ৪.৭% এবং একজন শিক্ষকের বেতন ৮৬৪ ডলার এক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচের সারিতে।
দেশের নাম মাথাপিছু আয় (ডলার) শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপি % শিক্ষকের বেতন
বাংলাদেশ ৭৫২ ২.২ ১৫০
ইথিওপিয়া ৪৫৪ ৪.৭ ৮৬৪
কেনিয়া ৯৪৩ ৬.৬ ২২০০
নেপাল ৬৯০ ৪.৭ ৫৫০
ভারত ১৪৮৯ ৩.১ ৩৯৫৪
কিউবা ৬০৫১ ১৩.১ ---
২০১২-২০১৩ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়ছে ২১,৪০৮ কোটি টাকা, এখান থেকে ৯,৮২৫ কোটি টাকা যাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এবং ১১,৫৮৩ কোটি টাকা যাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এটা সমগ্র বাজেটের ১১.২ যেখানে তার আগের বছর এর অনুপাত ছিল ১১.৮ ভাগ; যা জিডিপি’র ২.২ ভাগ। মজার বিষয়, এই বরাদ্দের ৬৮ শতাংশ বিভিন্ন অনুন্নয়ন খাতের ব্যয়, বাকিটা যাবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা-সুযোগ-সুবিধা-অবকাঠামো-ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে; খুব সামান্য ০.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে শিক্ষার সক্ষমতা অর্জনের জন্য। সঙ্গতই বলা যায়, এই দুর্বল বরাদ্দ ও ব্যয়ের খতিয়ান টেকসই উন্নয়নের অভিলাষ নিছক স্বপ্নই থেকে যাবে; লক্ষ্য অর্জন হবে অসম্ভব।
একই বছর (২০১২) টিআইবি(Transparency International, Bangladesh) বাংলাদেশের সেবাখাতের দুর্নীতির উপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশের সেবখাতের (সেখান শিক্ষাসহ ১৪ টি উপখাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে) দুর্নীতি হয়েছে ২১,৯৫৫ কোটি টাকা। যেটি জাতীয় বাজেটের ১৩.৬ শতাংশের সমান এবং জিডিপি’র ২.৪ শতাংশ। (এখানে কেবল সেবাখাতের দুর্নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এর সাথে অন্যান্য খাত যুক্ত করলে এই অংক আরও বাড়বে) যে অংকটি জাতীয় বাজেটে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের বরাদ্দেরও অধিক!
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪, শিক্ষক সংখ্যা ৯৭১৫, ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১,৭৭৮৫৭ জন। ২০১১-২০১২ সালের হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারী বরাদ্দ ১,১২৯ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। একই বছর কেবল ডেসটিনি গ্রুপই ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা যা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪ বছরের খরচের সমান। এবং যে অংককে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী খুব একটা স্পর্শকাতর বিষয় মনে করেন না। আর জাতির বিবেক, আশ্রয় ও জ্ঞানের আধার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খরচ মেটানোর জন্য মাথায় আসে নানা ফন্দি। সমাজ থেকে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ছেঁটে ফেলার এই কুৎসিত যড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের রুখে দাড়ানো অনিবার্য দায়িত্ব।
কেবল সেবাখাতের দুর্নীতির পরিমাণই শিক্ষাখাতে সরকারের জাতীয় বাজেটের বরাদ্দের চেয়েও অধিক! একটি গ্রুপের জালিয়াতির টাকায় দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরের খরচের সমান। নীতি নির্ধারকরা যদি একটু দেশের দুর্নীতির, সামরিক খাতের বরাদ্দ ও সমরাস্ত্র ক্রয়, বহুজাতিক কোম্পানির জ্বালানি খাতের ভর্তুকি, ডেসটিনি-হলমার্কসহ বিভিন্ন অর্থ কেলেংকারি, খেলাপি ঋণ, এমপি-মন্ত্রীদের অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এই জায়গাগুলোতে একটু মনোযোগ দেন, যৌক্তিক ও নৈতিক অবস্থান গ্রহন করেন তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা খুব কঠিন কাজ নয়। শিক্ষা, মানবসম্পদ ও উন্নয়ন প্রশ্নে সরকার তার সংবিধান-অর্পিত দায়িত্ব এড়িয়ে অন্য কোনো পথের সন্ধান করলে তা হবে আত্মঘাতী ও গৃহযুদ্ধের সামিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ধরন সে কথাই বলে, তাকে ছড়িয়ে দেবেন না সবখানে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন একটি ঘটনা ও দৃষ্টান্তও নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ কোনো শাসক জিতে এসেছে।
উপসংহার
সরকার আসলে বাংলাদেশের উন্নয়নে কোন মডেল অনুসরণ করতে চায়, তার একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তৈরী করা জরুরি। সেখানেই মীমাংসা হবে উচ্চশিক্ষার অর্থায়নে সরকারের নীতি কি হবে। প্রয়োজনে তার জন্য গণবিতর্কের আয়োজন করা হোক। বর্তমানে, পোশাক শিল্প ও অদক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানির যে দুটি খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় সেই খাত দীর্ঘস্থায়ী হবে সেই নিশ্চয়তা কোথায়। তথ্য-প্রযুক্তি বিকাশ, বিশ্বায়নের প্রভাব, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয় যে কোনো সময় সব হিসেব-নিকেশ এলোমেলো করে দিতে পারে। নীতি নির্ধারকরা অবচেতন মনেও একবার কি ভেবেছেন সেকথা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তাদের সময় লেগেছিল মাত্র ৫ বছর, তারা তাদের জিডিপিকে ফের আগের অবস্থানে মানে যুদ্ধপূর্ব অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল তাদের দক্ষ মানবসম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কারণে; যা তারা অর্জন করেছিল দীর্ঘ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধারাবাহিকতায়। ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে জাপানের বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ, শিল্প ও বাণিজ্য চীন থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। যারা টেকসই উন্নয়ন, জিডিপি, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়ার কথা শোনাচ্ছেন, তারা কিন্তু বলছেন না মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির কথা! পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে মানুষকে বোকা বানিয়ে সাময়িক কৃতিত্ব ও আনন্দ পাওয়া যায় কিন্তু তাতে লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। বাংলাদেশের উন্নয়ন যে গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাকে একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এর মূলসড়কে তোলার কাজটিই সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত নীতি ও শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। এই অমীমাংসিত বিষয়ের ফয়সালা হওয়া দরকার এখনই।
ড. মঞ্জুরে খোদা টরিকঃ লেখক, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, জাপান
বাংলাদেশ সময়: ১১৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪