গণজাগরণ বড় হয়েছে, বেড়ে উঠেছে। পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশ বিস্তৃত ও প্রসারিত হয়েছে।
মুক্তির স্বপ্নে বিভোর বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় এক হয়েছে। বাঙালি-আদিবাসী হাত ধরেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বেঈমানীর বিচার-অসন্তুষ্ট সচেতন তারুণ্যকে আবেগাকুল করেছে। অগ্নিঝরা কণ্ঠে শাহবাগে জড়ো করেছে।
সকল আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে দেশবিরোধী, স্বাধীনতার শত্রু রাজাকারদের উপযুক্ত বিচার চেয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং পরবর্তী সময়ে সারাবিশ্বের বাংলাদেশিদের মধ্যে একাত্তর চিৎকার করে উঠেছে। শাহবাগ সশব্দে, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়েছে। কথা-কবিতা-সঙ্গীতের তোড়ে আপোসকামিতার সন্দেহ দূর হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্নসম বাংলাদেশ লাখো কণ্ঠে উচ্চকিত হয়েছে। নতুন প্রজন্ম জীয়নকাঠির ছোঁয়া পেয়েছে। মিলিত নেতৃত্ব বাংলাদেশকে মানবতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত বিচার পেতে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। ফলে কারও ফাঁসি হয়েছে, কারও দীর্ঘ কারাবাস। বিচার চলছেই, প্রত্যাশিত প্রক্রিয়ায়।
একটি রায় না মেনে নেওয়া থেকেই শুরু। বাস্তব আর ভার্চুয়াল পরিসরে ক্ষোভ, চাপা উত্তেজনা। অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি সকলের কণ্ঠেই শাহবাগের সুর।
দিন-রাত নেই, ঘন হয়ে এসেছে মানুষ। স্বাধীনতার পর এক সুরে এত দীর্ঘ স্লোগান বাংলাদেশ কখনো দেখেনি, শোনেনি। স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বয়ংক্রিয় সংগ্রামী প্রস্তুতি দেশপ্রেমীদের আনন্দে বিহ্বল করেছে। দেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আতঙ্কিত বোধ করে ষড়যন্ত্রে নেমেছে, বিভেদ ও বিভ্রান্তির। অপশক্তির ভুল তথ্য ছাপানো আর মিথ্যা প্রচারণায় শাহবাগ কিন্তু টলেনি। নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ব্লগারদের নির্যাতন করা হয়েছে, খুনও হয়েছেন একজন।
ধর্মের অপব্যবহার মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়েছে, এখনো। মৌলবাদী ধর্মীয় শক্তি অনলাইনে সুরক্ষিত দুর্গ গড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সাইবার যুদ্ধও শুরু হয়েছে। পশ্চাৎপদ হীনমানসিকতা সম্পন্ন স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী অপপ্রচার চালিয়ে প্রগতিশীল শক্তির চরিত্র হননের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে কোথাও কোথাও খুনোখুনি উসকে দেওয়ার মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টির পায়তাঁরাও তারা করেছে।
গ্রহ-নক্ষত্রের ভেলকিবাজির মাধ্যমে দেশের কিছু জায়গায় সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। বিচার প্রশ্নে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ধর্মকে ইস্যু হিসেবে সামনে খাড়া করা হয়েছে। বিচার কিন্তু থামেনি। মানুষ সুবিচার চেয়েছে, পেয়েছে। হয়তো আরও পেতে যাচ্ছে। বৃত্তের আন্দোলন বহুরৈখিক হয়েছে, থেমে থাকেনি।
সকল অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতীক হয়ে উঠেছে শাহবাগ। ক্রিকেটে বিগ থ্রি’র মোড়লিপনার বিরুদ্ধে শাহবাগ দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে আরো অনেক ইস্যুতে। শাহবাগ ঘুমায় না, জেগে থাকে। শাহবাগ জেগে থাকে বলেই এটা গণমানুষরে আন্দোলন তথা গণজাগরণ। সবাই শাহবাগে একসঙ্গে এসেছে এমনটিও নয়। কিন্তু যখন এসেছে হুড়মুড় করে এসেছে। ভালোবেসে প্রাণের টানে এসেছে, এসেছে দেশের জন্য অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের কাজটি সুনিপুণভাবে সমাপ্ত করার জন্য।
ব্যক্তি বা দলের র্স্বাথে নয়। রাজনৈতিক দলের মানুষ এসেছে, কিন্তু দলের হয়ে নয়। কেউ কেউ আসেই নি, কেউ এসেও চলে গেছে। দুর্ভাগা তারা। শাহবাগকে বুঝতে পারেনি। চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ একঝাঁক দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধার সৃষ্টি করেছে। কিছু রাজনৈতিক দল আদর্শগত কারণে শাহবাগের অংশ হতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ কেউ বিচারের দাবিতে একমত পোষণ করলেও শাহবাগে আনাগোনা ধীরে ধীরে কমিয়ে দিয়েছে।
আর্থিক অস্বচ্ছতা কিংবা নেতৃত্বের মালিকানা নিয়ে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব হয়ে থাকতে পারে কেউ কেউ এমন ধারণাও পোষণ করেন। কিন্তু বহুমুখী নেতৃত্বের এত বিশাল এবং কর্মতৎপর মানুষের হঠাৎ জাগরণ দিনক্ষণ নির্ধারণ করে থামিয়ে দেওয়া তো নিশ্চয়ই দুষ্কর। কেউ প্রথমে এসেছেন কেউ দ্বিতীয় কিংবা পঞ্চম দিনে। তাতে কি এসে যায়! দম ফাটিয়ে চিৎকার করে দাবি আদায়ের মহান এই অহিংস আন্দোলনে সশরীর সচেতন একাত্ম হওয়াই তো বড়। যে লড়াই শুরু হয়েছে সেটা তো ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই। রাজনৈতিক অপশক্তি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিশ্চিহ্ন করার লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নসম। ঘুম ভেঙে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের লড়াইয়ে গণমানুষের অবস্থানই গণজাগরণ মঞ্চ। এই মঞ্চের কুশীলবরা ভীষণভাবে বাস্তব এবং ব্যস্ত। প্রযোজক পরিচালক নেই। সবাই নায়ক। খলনায়ক অনুপস্থিত, মানবতা বিরোধী। কিন্তু দুই পক্ষই লড়ছে। কেউ ভালোর পক্ষে, কেউ কালোর পক্ষে। কিন্তু সত্যের জয় অনিবার্য। চেতনার মৃত্যু নেই। দেশপ্রেমিকরা হারে না। তারা জিতেছে, আরও জিতবে। ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শনকারী যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার নিশ্চয়তাও মিলেছে। কিছু ভুলের অভিযোগ যে ওঠেনি, এমনটি নয়।
দেশবিরোধী অপশক্তির নাস্তিক আখ্যা পাওয়া কয়েকজন ব্লগারকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। সে বিচারে শাহবাগের চেতনায় কষ্টের আচঁড় লেগেছে। অভিমানও জেগেছে। সে যাই হোক, সর্ববিচারে সরকারের সদিচ্ছা গণমানুষের চাহিদাকে বঞ্চিত করেনি বা ফাঁকি দেয়নি এটাই বড় কথা। গণজাগরণ মঞ্চ জিতেছে। জাতি কম কিছু পায়নি। তারুণ্যদীপ্ত নেতৃত্ব, সৃষ্টিশীল স্লোগান, একই সময়ে বিশ্বের নানা স্থানে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, পতাকা উত্তোলন, বেলুন ওড়ানো, জাতীয় সঙ্গীত উচ্চারণ, আমাদের মস্তিষ্ককে শাণিত করেছে।
একাত্তর ঘিরে মানুষের আবেগ অচলায়তন ভেঙে দুর্বার গতিতে মুক্তকণ্ঠে প্রবাহিত হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শাহবাগকে উদ্ভাসিত আলোয় আলোকিত করেছেন। বুকের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, মাথায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার আর্তি গণজাগরণ মঞ্চের প্রাণ।
সাইবার যোদ্ধারা নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষার জয়গানের মাধ্যমে জাগরণের গান শোনাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। প্রজন্ম চত্বরের গর্বের বিষয় হচ্ছে হাল আমলের মানুষদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চিনিয়ে দেওয়া। যেটা ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের মানুষের জেগে উঠবার এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অনুঘটকের নাম-গণজাগরণ মঞ্চ। গণমাধ্যম আরো সচকিত হোক। শাহবাগ জেগে থাক। জেগে থাকার প্রেরণা আলো। মোমের আলো, নিয়ন আলোয় ইতিহাসের জঘন্যতম কালিমালিপ্ত অধ্যায়ের পরসিমাপ্তি হোক, ফুটুক ভালোবাসার আলো- আসুক নতুন ভোর!
লেখক :: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪