বাংলানিউজে প্রকাশিত একটি নামী জনপ্রিয় দেশী পোশাক ব্র্যান্ডের জমকালো রেড কার্পেট শো এর নিউজের সঙ্গে দেয়া ফ্যাশন শো এর ছবিতে হঠাৎই চোখ আটকে গেল। হাঁটু পর্যন্ত হরেক রকম পোশাকে মডেলরা পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
সিনেমা/নাটকের অভিনেত্রীদের জন্য যদি তৈরি করে থাকে তবে ভিন্ন কথা। কারণ অনেক নায়িকাই আজকাল গর্বভরে বলে থাকেন, চরিত্রের খাতিরে নাকি নগ্ন হতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই! আর পয়সা দিয়ে যেহেতু মানুষ বিনোদন কিনতে যায়, কাজেই নারীর নগ্ন শরীর যদি সেই পয়সা উসুল করার বন্দোবস্ত করে দেয়, তাহলে মন্দ কি? তারা শরীর দেখিয়ে আয় করে করুক, কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমাদের দেশের তথাকথিত আধুনিক মেয়েরা কি এখন এসব পোশাক পরছে? আমরা নারীরা কি তবে আধুনিকতার নামে শরীর দেখানোতেই আজকাল বেশি আগ্রহী?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে বাঙালি নারীর চলনে, পোশাকে। নারীর পোশাকের এই পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে বাঙালি নারী বেছে নিয়েছে নিজের পছন্দমত পোশাক।
যেখানে একসময় শাড়ি ছিল বাঙালি নারীর প্রধান পরিধেয়, কালক্রমে তা দখল করে নেয় সালোয়ার-কামিজ-ওড়না। দৈনন্দিন কাজকর্ম করার সুবিধা, সস্তা ও শালীনতার কারণে গ্রামেগঞ্জে সর্বত্রই সালোয়ার কামিজের একচেটিয়া ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
বাঙালি নারীর চিরন্তন পোশাক "শাড়ি" আজকাল অকেশনাল পোশাক হয়ে উঠেছে। কোনো অনুষ্ঠান বা বিশেষ দিবসে আজকাল আধুনিক শহুরে মেয়েরা শাড়ি পরে থাকে। নারী ইদানিং শাড়ি কম পরে বলে নারীর চেয়ে বাঙালি পুরুষদেরই কেন যেন হা-হুতাশ বেশি করতে দেখা যায়!!! এই হা-হুতাশ কি বাঙালি নারীর স্বকীয়তা নষ্ট হচ্ছে এই কারণে, নাকি নারী দেহের সৌন্দর্য দর্শনে বঞ্চিত হচ্ছে সেই কারণে- তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
"নারী সুন্দর শাড়িতে" যতই বলি না কেন, সে সৌন্দর্য কিন্তু নির্ভর করে শাড়ি পরার ধরনের উপর। অনেকেই বলে থাকেন শাড়ি হলো সব চেয়ে উত্তেজক পোশাক। ব্লাউজের ডিজাইনের উপর এবং সেইসঙ্গে শাড়ির ফেব্রিকের উপর নির্ভর করে শাড়িতে নারী কতোটা আবেদনময়ী। ইমপোর্টেড পাতলা জর্জেট কিংবা স্লিভলেস, পিঠখোলা ব্লাউজের সঙ্গে দেশি জামদানি/তাঁতের শাড়ি আদৌ কোনো শালীন পোশাক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
ইদানিং শহর ও মফস্বলে অল্প বয়সী মেয়েদের দেশি ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে এক বিচিত্র পোশাকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফ্যাশনেবল পোশাক বলে এগুলোকে গণ্য করা হয়। সেই সঙ্গে মাথায় হিজাব বা ওড়না পরা নারীর সংখ্যাও বাড়ছে সমানতালে। পুরুষের লালা থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই হোক, পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনেই হোক, বিভিন্ন ডিজাইনের হিজাব/বোরখা পরা নারীর উপস্থিতি বাড়ছে সর্বত্রই।
আর বাড়ছে বাঙালি নারীর পোশাক নিয়ে তর্ক-বিতর্ক।
বোরখা/হিজাব পরিহিত অনেক নারীর ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে এই পোশাক পরিহিতারাও নানা সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। উষ্ণতা প্রধান এই দেশে আপাদমস্তক আবৃত এই পোশাক নারীর জন্য কতটা আরামদায়ক সে প্রশ্ন নিয়ে অন্তত ফতোয়াধারী লালাবাজেরা যে ভাবেন না তা বলাবাহুল্য। নারীকে খোলসে আবৃত করে নিজেদের লালা নিয়ন্ত্রণের জন্যই তারা মূলত বেশি উদগ্রীব থাকেন!!
নারীবাদী অনেকেই দাবি করছেন হিজাব/নেকাব আমাদের বাঙালি নারীর পোশাক নয়। এই পোশাকের আধিক্য কেবল নারীর অগ্রগতিকেই টেনে ধরবে। তাদের দাবিটি আংশিক সত্য। কারণ এই পোশাক আসলেই খেলাধুলাসহ অনেক পেশার বেলাতেই নারীকে সীমাবদ্ধতা দিয়েছে।
ছাত্রজীবনে আমার অনেক বন্ধুকেই দেখেছি আপাদমস্তক ঢাকা বোরখা পরার কারণে অনেক খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে নি, পারেনি সাইকেল চালাতে। হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেলেই বোরখাওয়ালি কেন সিনেমা দেখবে এসব নিয়ে অন্যদের টিকা- টিপ্পনিও হজম করতে দেখেছি। অনেকেই অনেক কিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল শুধু পরিধেয় পোশাকটির সম্মান রক্ষার্থে।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে, হিজাব পরা বা নেকাবে ঢাকা আমার পরিচিতারা কেউ আনস্মার্ট ছিল। বরং অনেক আধুনিক পোশাকে সজ্জিত অনেক মেয়েদের চেয়েই তারা অনেক বেশি স্মার্ট ছিল।
পোশাক সে আরব দেশ থেকেই আসুক, আর পাশ্চাত্য থেকে কিংবা উপমহাদেশ থেকে, নারীর পোশাক হোক শালীন। শরীর যে যত দেখাতে পারবে সে তত আধুনিক, কিংবা হিজাব-নিকাব পরিহিত কেউ আনস্মার্ট এমনটি ভাবা মোটেও উচিত নয়।
নারীর ভেবে দেখা দরকার, হরেক ডিজাইনের হিজাবই হোক আর স্লিভলেস টপস-জিন্সই হোক যে পোশাক সে পরছে তা কি পুরুষকে আকর্ষিত করার জন্য? যদি আশপাশের তাবত পুরুষকে নিজের শরীরী সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা নারী নিজেই করে দেয়, তাহলে সেটা অবশ্যই সেই নারীর নিজস্ব অভিরুচি।
পুরুষরা নারীর পোশাক নিয়ে কে কি বলল তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, নিজেকে পণ্য হিসেবে নাকি শালীনতার মোড়কে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী হিসেবে উপস্থাপন করব তা আমাদের নারীকেই ঠিক করে নিতে হবে।
তবে অবশ্যই মনে রাখা দরকার, শরীরকে উন্মুক্ত করার নাম কখনই আধুনিকতা নয়, আধুনিক হতে হবে মেধায়-মননে।
ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ১১৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৪