একে শিল্পের বিরুদ্ধে বর্বরদের আক্রমণ, মানবতার বিরুদ্ধে দানবিকতার আগ্রাসন কিংবা আলোর বিরুদ্ধে অন্ধকারের আস্ফালন, যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ১৯৯৯-এর ৬ মার্চ এদেশে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের উত্থানের ক্ষেত্রে একটি রক্তাক্ত সূচনা হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে।
এদিন ছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষ রাত্রি।
আমার গুরু শ্রদ্ধেয় যতীন সরকার প্রায়শঃই বলেন, পশু জন্মেই পশু, কিন্তু মানুষ কোনোভাবেই জন্মেই মানুষ হয় না। তাকে মানুষ করে তোলে সংস্কৃতি। মানুষ সভ্য হয়েছে সংষ্কৃতিকে ভর করে, আর সংষ্কৃতি এগিয়ে গিয়েছে সভ্যতার হাত ধরে। একটিকে ছাড়া আরেকটিকে কল্পনা করা দুঃসাধ্য।
কিন্তু চিরকালই সভ্যতা-সংষ্কৃতির বিরুদ্ধে একটি অন্ধকারের শক্তি কাজ করেছে। তাদের পেছনে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে লোভ আর স্বার্থ। সমাজ এগিয়ে গেলে যাদের ক্ষতি তারাই চিরকাল আমদানি করেছে নানা রকম ভণ্ডামি আর জাদু বিশ্বাসের। মানুষ অবাক হতে ভালোবাসে বলে আজীবন খুঁজে বেড়িয়েছে অবাক হওয়ার উপাদান, বিষয়, ঘটনা ইত্যাদি। এটাই ভণ্ডদের জন্য হয়েছে সোনায় সোহাগা।
পৃথিবীতে বহু মহামানবের আগমন ঘটেছে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের পথে, পাশবিকতা থেকে মানবিকতার পথে, বৈষম্য থেকে সাম্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
কিন্তু, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা ব্যবহৃত হয়েছেন শোষক শ্রেণীর হাতে। তাঁদের ভাষ্যকে করা হয়েছে বিকৃত। কোথাও কোথাও সত্যকে মুছে ফেলে যোগ করা হয়েছে নতুন ভাষ্য, নতুন ব্যাখ্যা। এ ক্ষেত্রে ‘হিং টিং ছট’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি- ‘ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট পালট’ কৌশলটি ব্যবহৃত হয়েছে।
অন্যদিকে, সমাজ সভ্যতার নির্মোহ ছবি এঁকে, মানুষের হৃদয়ের আনন্দ বেদনার সত্য সুর সেধে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভিঘাতে উৎসারিত মানুষের সহজ প্রাণের বাণীকে ছন্দোবন্ধনে প্রবল শক্তিমান করে শিল্প নিত্যই মানুষকে করে চলেছে অধিকতর শিক্ষিত, অধিকতর সচেতন, অধিকতর মানবিক, অধিকতর ঐক্যবোধসম্পন্ন। শিল্প-সংষ্কৃতির শক্তি এখানেই। আর একারণেই শিল্পীরা এবং তাবত শিল্পকলা অন্ধকারের শক্তির আক্রমনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
এ কারণেই উদীচী আক্রান্ত হয়, বাউলরা আক্রান্ত হন, সিনেমা হলে বোমা পড়ে, ছায়ানটের নববর্ষ অনুষ্ঠানে হামলা হয়, নাট্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়, যাত্রা প্যান্ডেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়, মেলায় আক্রমন হয় ইত্যাদি। শিল্প-সংষ্কৃতির নানা সমাবেশে বর্বর শক্তির পাশবিক তাণ্ডবের ঘটনা ঘটে।
এরা কারা? কারা এই অন্ধকারের শক্তি? এদের আসল স্বরুপটা কী? এরা কি ধার্মিক? কেউ বলেন ধর্মান্ধ। কোনো ধর্মেই কি বোমা মেরে নিরীহ মানুষকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে? নিরীহ শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা বলা হয়েছে? নির্বিচারে গাছ কাটার কথা বলা হয়েছে? কখনো নয়। এরা কাজ করে ধর্মের বিরুদ্ধে, মানবিকতার বিরুদ্ধে, আর সেটা করে ধর্মের নামে। সেই কথাতেই ফিরে আসতে হয়- ‘ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট পালট। ’
ইসলামের ক্ষেত্রে এটি ঘটেছে যখন থেকে ইসলাম রাজতন্ত্রের হাতে চলে গিয়েছে। অথচ সবাই হানেন যে, ইসলাম রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। কিন্তু যারা রাজতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে, তারা তো রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চাইবেনই। তাই শুরু হলো দ্বন্দ্ব। তৈরি হলো নানান ‘ফেরকা’, দল-উপদল। একই ধর্ম, কেবলমাত্র ব্যাখ্যার ভিন্নতায় হয়ে গেল বহুধা বিভক্ত এবং এতে অপরের প্রতি খড়গহস্ত। নিজের ধর্মের সামান্য মতদ্বৈধতাকে যারা সহ্য করে না, তারা অন্য ধর্মকে পৃথিবী থেকে মুছে দিতে চাইবে, এতো স্বাভাবিক।
অসহিষ্ণু, বর্বর, প্রতিশোধ পরায়ণ, হিংস্র আরব জাতিকে মানুষ করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) শান্তির ধর্ম ‘ইসলাম’ প্রচার করেছিলেন। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাঁর মৃত্যুর পর তারা আবার ফিরে গিয়েছিল আদিম হিংস্রতায়। ইতিহাসের পাতা জুড়ে রয়েছে এর বহু বিস্তৃত তথ্য।
অসহিষ্ণু তারাই হয়, যারা কম জানে, অন্যের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না কিংবা তর্কে হেরে যায়। তারা গায়ের জোরে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যুক্তি দিয়ে নয়, কারণ যুক্তি তাদের জানা নেই। মুসলমানের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগেও এই অজ্ঞানান্ধ মানুষেরা মুসলিম দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকদের বিরুদ্ধাচরণ করতে কার্পণ্য করেনি। নানাবিধ ফতোয়া জারি করে তাদেরকে হেনস্তা করেছে।
কবি নজরুল ইসলাম তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন-
“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখনও বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজছি
ফেকাহ্ ও হাদিস চষে। ”
মহা সম্ভাবনাময় মনুষ্যজীবনকে যারা কেবলমাত্র পাশববৃত্তির সংকীর্ণ গণ্ডীতে আবদ্ধ রাখতে চায় এবং এভাবে জীবনপাত করাকেই মানবজন্মের একমাত্র লক্ষ্য বলে যারা স্থির করে নিয়েছে, তাদের মানুষ করবে কে?
বলছিলাম অসহিষ্ণুতার কথা। সেই অসহিষ্ণুতার আগুনে ঘি ঢেলেছে অষ্টাদশ শতকের ওহাবী মতবাদের পুনরুত্থান। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক সৌদি রাজতন্ত্র। ওসামা বিন লাদেনের জন্মও এদের হাতে। ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রমই এদের লক্ষ্য। এই কট্টর মৌলবাদী শক্তিকে সৌদি রাজতন্ত্র তাদের তেল রপ্তানীর আয় থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে থাকে তাদের এই মতবাদকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। যার ফলশ্রতিতে বিশ্বে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ১৯৭৬-এ কয়েক শত থেকে বেড়ে ১৯৮৩ সালে দশ হাজার এ দাঁড়িয়েছে (সূত্র: উইকিপিডিয়া)।
এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম সৌদি রাজতন্ত্রের যতটা না দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার যুক্তরাষ্ট্রের (বিন লাদেনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে বিশ্ববাসী অবগত)। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ তার দখলে থাকা জরুরি। পাশাপাশি এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধ লেগে থাকলে তার অস্ত্রের ব্যবসাও জমবে ভালো।
বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় সুফীবাদী ইসলামের দেশ। এখানে ওহাবী ইসলামের আমদানি এবং বিস্তারের প্রধান শক্তি জামায়াতে ইসলামী। এখানেও সায় রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের। তাই এই সন্ত্রাসী দলটিকে তারা ‘মডারেট’ ইসলামী দল আখ্যা দিতেও কার্পণ্য করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারেও আমরা তাদের নাক গলাতে দেখেছি। তার কারণ মোটেও ইসলামপ্রীতি নয়, তার কারণ বাংলাদেশের মাটির নিচের তেল-গ্যাস-প্রীতি, বন্দর প্রীতি। তাই, বাংলাদেশের সরকারকে সবসময় ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে, সন্ত্রস্ত রাখতে হবে, অশান্ত রাখতে হবে। তবেই না নানাবিধ অসম চুক্তির বেড়াজালে উন্নয়নগামী দেশটাকে বেঁধে ফেলা যাবে। তাই, উদীচী সম্মেলনে বোমা হামলার কাজটি অনেক লম্বা হাতের কারসাজি।
লেখক: সহ সভাপতি, কেন্দ্রীয় সংসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৪