মুক্তিযুদ্ধের পর ব্যাংকিং সেক্টরের জাতীয়করণ শুরু হয়। সে সময় পাকিস্তান আমলের বড় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের নামকরণ হয় সোনালী ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংক জাতীয়করণের পর থেকে চড়াই উৎরাই পেরিয়েও বরাবরই শীর্ষে থাকা ব্যাংক। তার এই শীর্ষত্ব শাখা, জনবল, পুঁজি, মুনাফা, সেবা সবদিক থেকেই বিবেচিত হতো। কিন্তু এই রমরমা ভাব আমাদের সয় না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেনা শাসনের শুরতেই ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে’ যেতে শুরু করে।
সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে আমার ও আমাদের পরিবারের সম্পর্ক পুরনো। ফলে আমি আমার পিতার কাল থেকেই এর ওঠানামার বিষয়টা দেখে আসছি।
জিয়ার আমলেই অনিয়ম ও জাতীয়করণবিরোধী ধারার শুরু। জিয়াউর রহমান বলতেন, ‘মানি ইজ নো প্রব্লেম। ’ এই নো প্রব্লেম এর মূল মাজেজা ছিল পলিটিক্স বা রাজনীতির জন্য ব্যাংকের টাকা, ঋণের টাকা, ধারের টাকা বা সাহায্যের টাকার অবাধ ব্যবহার। তিনি যে দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর সাত্তার সাহেবের (বিচারপতি এম এ সাত্তার) আমলে সে দুয়ার দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুশমনরা লুটপাট করার জন্য ঢুকে পড়ে।
তখন চার পাঁচটি জাতীয় ব্যাংকের যে কি হাল! তা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে। কাজ নেই কর্ম নেই, একদিকে ইউনিয়নের অনাচার জাল, কর্মীদের বেতন উত্তোলন, ট্রাংকে ট্রাংকে টাকা পাচার- সব মিলিয়ে সে এক বিভীষিকাময় অবস্হা। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সব মিলিয়ে লেজে গোবরে হাল। এখন কেন জানি মনে হয়, এর পেছনেও একটা চক্র কাজ করেছিল। যে চক্রটি এরপর প্রায় দশবছর বাংলাদেশের বুকে চেপে বসে আমাদের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে শেষে জনরোষে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
আমি এখনো ভেবে পাই না, মানুষ কিভাবে এরশাদ জমানার গুণগান গায়। এই এরশাদের কারণে আমাদের যৌবন ছিল রুদ্ধদ্বার। তার ইচ্ছে বা মর্জিমাফিক চলতো দেশ। চলতো অর্থনীতিও। সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের জাতীয়করণকৃত ব্যাংকগুলোর বারোটা বাজানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। গদীতে থাকর জন্য এরশাদ করতে পারতেন না এমন কোন অপকর্ম নেই। যে কোনো আন্দোলন বা দ্রোহকে জন সমর্থনহীন সরকার ভয় পাবে সেটাই স্বাভাবিক। এরশাদ ছিলেন সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন।
সে সময় ব্যাংকের ইউনিয়নগুলো এরশাদের দুর্বলতার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে নেমে পড়ে। অর্থ আত্মসাৎ থেকে শুরু করে ভূয়া কর্মচারীর নামে বেতন উত্তোলন--কিছুই বাদ ছিল না সে সময়। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিপদ বা আপদ ছিল ভালো মানুষ ও সত্যিকার ভালো ব্যাংকারদের অপমান এবং শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া।
যখন চাকরিহীন যৌবনে পা রাখা বাংলাদেশিদের সামনে এক স্বৈরাচারের কঠিন শাসন আর খায়েস ছাড়া কোনো সুযোগ নেই, তখন ব্যাংকগুলোয় এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত অফিসার পদে নিয়োগ করে করে কর্ম সংস্হানের সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি ইউনিয়ন নামের মাফিয়া চক্রের দুর্গে আঘাত হানেন লুৎফর রহমান সরকার। লেখক ও ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার তরুণ তরুণীদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী হবারও সুযোগ করে দেন। হঠাৎ করে খুলে যাওয়া জগতে ঝলসে ওঠা ব্যাংকের এই গণমুখি চরিত্র এরশাদের পছন্দ হয় নি। এ-কারণে তুচ্ছ কারণে লুৎফর রহমান সরকারকে জেলে পুরে রাখা হয়।
সম্ভাবনার নতুন ধারাটিকে গলা টিপে হত্যা করে এরশাদ ও বেশিদিন গদিতে থাকতে পারেন নি। কিন্তু তদ্দিনে ব্যাংকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি ঢুকে গেছে। শুরু হয়ে গেছে রাজনীতিকরণ। যে যখন পাওয়ারে তার দিকে ঝুঁকে পড়া নেতারা কাজ কর্ম বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির দালাল হবার জন্য হয়ে উঠতেন মরিয়া। তখনো আমাদের একটাই টিভি। গভীর রাতে সে-টিভির খবরে হাতে ফুলের গোছা নিয়ে এ দলে ও দলে যোগ দেয়া ব্যাংক কর্মচারী নেতাদের দেখে সাধারণ ব্যাংকাররা ভয়ে গুটিয়ে থাকতেন।
আমার স্বল্প-দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে আমি এদের চরিত্র দেখেছি। কিভাবে কাজ না করে বেতন নেওয়া যায়, কিভাবে ট্রান্সফার-পোস্টিং বাণিজ্যে ফুলে ফেঁপে বড়লোক হওয়া যায় এ যেন তার সার্থক মঞ্চায়ন।
ক্রমে ক্রমে সে দৌরাত্ম্য এসে ঠেকল ঋণ মঞ্জুর বা বিতরণের বেলায়। বাংলাদেশের নব্য ধনী নামে পরিচিত ঋণখেলাপিদের সুবর্ণকালেই মূলত: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাকগুলোর বারোটা বাজার শুরু।
সে-প্রক্রিয়া এখনো চলছে। আজ আমি মূলত সোনালী ব্যাংকের সুড়ঙ্গ চুরি বা ডাকাতির কারণেই কলম ধরেছি।
এটা মানতেই হবে, এখনো নব্বই পার্সেন্ট কর্মকর্তা কর্মচারী আসলে সৎ ও নিরীহ। তারা দু চার দশ টাকা এধার ওধার করার ব্যাপারে জড়িত বা নীরব থাকলেও ব্যাংকের জীবন নিয়ে বা কোটি কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে তারা। সোনালী ব্যাংকে যারা কাজ করেন তারা কোথাও থেকে উড়ে আসেন নি। এরা আমাদের ভাই বোন বা আত্মীয় স্বজন। হঠাৎ করে ডাকাত দলেরও এমন কি বুদ্ধির উদয় হল যে তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে টাকা লোপাটে ঝাঁপিয়ে
পড়লেন? তাই এই সুড়ঙ্গ থেরাপি আমাকে অন্য কিছু ভাবতেই বাধ্য করছে.
এটা নিশ্চিত যে, সোনালী ব্যাংক যেহেতু বড় ব্যাংক, এটির অর্থ আত্মসাৎ বা একে পথে বসাবার পেছনে কাজ করা মানুষগুলোর হাতও বড় আর লম্বা। দেশের রাজনীতিতে অঢেল টাকা খরচের মানুষগুলো মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে নি। আর তাদের ব্যয়ের টাকাগুলোও নিজেদের নয়। সে অর্থ মূলত কোনো না কোনো ব্যাংকের। বা অন্য কোনো উৎসের। প্রশ্ন হচ্ছে, এত লুণ্ঠনের পরও ধস নামাতে ব্যর্থ হবার কারণেই কি এই সুড়ঙ্গ থেরাপি? নাকি এর পেছনে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ধ্বংসের অন্য কোনো নতুন চক্রান্ত?
বহু মানুষ আছেন যারা পারলে যে কোনো ব্যাংকের সমুদয় অর্থ লুটে নিতে দ্বিধা করবে না। কোন চক্র কেন এই খেলায় মেতেছে সেটা বের করাই এখন জরুরি। সোনালীর পর রুপালী, জনতা, অগ্রণী, পূবালী ও অন্য যে কোনো ব্যাংক যে ডাকাতি প্রক্রিয়ার শিকার হবে না তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়? দেশের অর্থনীটি ও ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর যাদের বদ নজর আছে, যারা আমাদের জাতীয়করণের ঘোর বিরোধী তাদের কথা বিবেচনায় রাখাটাও জরুরি। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। খোলনলচেসহ ব্যাংকিং না পাল্টালে এই অপপ্রক্রিয়াও বন্ধ হবে না।
ব্যাংকিং বিষয়টা এখন একেবারেই পাল্টে গেছে। উন্নত দেশগুলোর ব্যাংকিং আর আমাদের দেশের ব্যাংকিংএ দূস্তর ব্যবধান! আধুনিক সমাজের মানুষ ব্যাংকের শাখায় যায় বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে। আগের মত টাকা তোলা বা দৈনন্দিন ব্যাংকিংএ তাদের ব্যাংক মুখো না হলেও চলে! কার্ড ইন্টারনেট ইলেকট্রনিক মাধ্যম, এটিএম কম্পিউটার সব মিলিয়ে লেনদেন করার ব্যাপারটা যার যার নিজস্ব প্রায়। ঘরে বসে গাড়িতে বসে চলতে ফিরতে যে কোনোভাবে করলেই চলে। আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা সবে আধুনিকায়নের পথে পা বাড়িয়েছি। বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার এই সময়কালে আমাদের কাঁধে আছে ষোল কোটি মানুষের ভার।
এখনো মানুষ লেখাপড়া, বিদ্যা-বুদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে। এমন দেশ ও সমাজে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চাইলেই আধুনিক হতে পারে না। তা ছাড়া যে কোনো
উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকিং মূলত দু ধরনের। একটি ম্যাস বা গণ ব্যাংকিং, আরেকটি ক্লাশ বা অভিজাত ব্যাংকিং। অভিজাত ব্যাংকিং আমাদের দেশেও আছে। বলা উচিৎ জাঁকিয়েই আছে। ইদানিং তারা মফস্বলেও পা বাড়াচ্ছে।
কিন্তু সে পদযাত্রার মূল উদ্দেশ্য মুনাফা। যখন কোনো ব্যাংক রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে তখন মুনাফাই তার একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। কিছু সামাজিক দায় দায়িত্ব পালনেও তার ভূমিকা থাকে. সেটা আধুনিক কালের স্পনসরশিপ বা নিজেদের প্রচারের জন্য গানের অনুষ্ঠান, কবিতাপাঠ কিংবা নাটকের স্পন্সর হওয়া নয়... কোনো বড় খেলার টিকেট বিক্রি কিংবা এ জাতীয় কাজ ও ব্যাকিংয়ের গণমুখি চরিত্রের পরিচয় বহন করে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ হয় এমন কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রাখার পাশাপাশি মুনাফা অর্জনে নিজেদের বড় করে তোলার নাম ই গণব্যাংকিং.. আমেরিকার সর্বগ্রাসী ভূমিকা ও বাজার অর্থনীতিএ রমরমা’র কালে বোঝা না গেলেও একসময় এ জাতীয় ব্যাংকিং ছিল সারা বিশ্বে আদৃত। সেকালে যেসব দেশ নিজেদের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সবল করে নিয়েছিল তাদের অবস্হাই আজ চোখে পড়ার মত ভালো।
সোনালী ব্যাংকের এই ভয়াবহ অবস্হা উড়িয়ে দেয়ার মত কিছু নয়. সরকারকে এর বিহিত করতেই হবে। না হলে পস্তানো আর সর্বনাশের বিকল্প কিছু থাকবে বলে মনে হয় না।
অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২৯১৪