ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলা ভাষা ও বর্তমান প্রজন্ম

আদনান সৈয়দ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪
বাংলা ভাষা ও বর্তমান প্রজন্ম

বেশ কদিন আগে ঢাকায় এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধুটির সাথে আড্ডার এক ফাঁকে দূর থেকে লক্ষ্য করছিলাম একটি পাঁচ/ছয় বছর বয়সী শিশু আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

ইশারায় কাছে ডাকতেই শিশুটি ধীরে ধীরে আমার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল,  ‘আংকেল, হাউ ইস আমেরিকা!’ কি অবাক কাণ্ড! বাঙালি রক্তের একটি শিশু আমার সাথে কথা বলছে ইংরেজিতে? আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।

বন্ধুটিকে বললাম, ‘কিরে দোস্ত, তোর ছেলে কি বাংলায় কথা বলতে পারে না?’ এ ধরনের কথা শুনে বন্ধুটি প্রথমে তার ভ্রূ কুঁচকালো তারপর যথাসম্ভব মুখে একটি গর্বের হাসি ফুটিয়ে ধীরে ধীরে বললো, ‘ দোস্ত, ছেলেটা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ার কারণে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশ ভালো কথা বলতে পারে। জানিস তো, ইংরেজিটা জানা থাকলে এর কদরই কিন্তু আলাদা। ’

বন্ধুটি আপন খেয়ালে তার কথা বলেই চলছিল। যোগ দিলেন বন্ধুপত্নীও। ‘ভাই জানেন তো , আমাদের কমল (নামটা কাল্পনিক) ইংরেজির পাশাপাশি দুর্দান্ত হিন্দিও কিন্তু বলতে পারে। ’ বন্ধুপত্নী ততক্ষণে নিজপুত্রের ভাষা জ্ঞানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর আমি ভাবছিলাম অন্যকথা।   বন্ধুপুত্রের জন্যে একুশের বইমেলা থেকে কিনে আনা বাংলা ভাষায় লিখিত বিভিন্ন রং-বেরং বইয়ের প্যাকেটটি যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করলাম।

প্রসঙ্গক্রমে এবারের শহীদ দিবসের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। প্রভাতফেরীতে হাজারো মানুষের ঢলের মাঝে ছোট্ট একটি শিশুকে আবিষ্কার করি। কে যেন ওর গালে আদর করে শহীদ মিনার এঁকে দিয়েছে। পরনে বাংলার স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণে সমৃদ্ধ ছোট্ট এক তাঁতের শাড়ি।   তাতেই ওর আনন্দের শেষ নেই। বেশ বোঝা যাচ্ছে মা-বাবার তর্জনীকে আশ্রয় করেই সে চলে এসেছে এই ভোর সকালে ঢাকার শহীদ মিনারের সামনে। সেই শিশুটির চোখে এক পাহাড় পরিমাণ বিস্ময়! এত লোক চারপাশে! নির্ঘাত কোনো উৎসবের সকাল!! তা না হলে তার বাবা-মা সুন্দর পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে সেজেগুঁজে এখানে আসবে কেন? শিশুটিকে যতই দেখছিলাম ততই ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এইোতো সেই একুশের প্রাণ! আমার প্রিয় বাংলা ভাষা! আমার অস্তিত্বের ঠিকানা! যে একুশের ওপর ভর দিয়ে আমি একটা ভাষা পেয়েছি, একটা জাতি পেয়েছি আর একটা দেশ পেয়েছি। একুশ আমার অহংকার!

কিন্তু হঠাৎ করেই কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার বন্ধুর ইংরেজিতে বক বক করে যাওয়া সন্তানটির কথা ভেবে মনটা এক অজানা ভয় আর আশঙ্কায় শিউরে উঠলো। কল্পনায় দেখতে পেলাম শিশুটি যেন আমার চোখের সামনেই লাউয়ের ডগার মতো তিরতির করে বড় হয়ে গেল।   কি চমৎকার করেই না সে কথা বলছে! কিন্তু সে কোন ভাষায় কথা বলছে? মোটেও তা বাংলা ভাষা নয়। তবে শুনতে বাংলার মতই কিছুটা। কি আশ্চর্য আর ভয়ানক কথা— সে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি সব খিচুড়ি করে এক কিম্ভুতকিমাকার ভাষায় কথা বলে চলছে! স্পষ্ট দেখতে পেলাম শিশুটির সেই  বাবা মা তার পাশেই দাঁড়িয়ে দেতো হাসি হাসছেন। কিন্তু হাসছেন কেন? জিজ্ঞেস করতেই তাদের একজন বললেন, ‘দেখলেন আমাদের মেয়ে কি সুন্দর করে বাংলায় কথা বলছে?’ আবারো শিউরে উঠলাম। তাহলে বাংলা ভাষা অদূর ভবিষ্যতে এমন ভয়ানক এক ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে?

এই তো সেদিন বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইয়ের দোকানে এক অনুষ্ঠানে খুব আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে দিলেন, ‘বাংলা ভাষা যদি টিকে থাকে তাহলে তা বাংলাদেশেই টিকে থাকবে। ’ কথাটা শুনে সেদিন মনটা খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল। আর এমন সুন্দর কথা শুনলে কার না ভালো লাগে? ‘বাংলাদেশেই টিকে থাকবে’—  কথাটার ভেতর কোথায় যেন একটা ‘অধিকার’-এর ঘ্রাণ খুঁজে পেলাম। তাই তো! ৫২তে প্রাণ দিয়ে এই ভাষাকে তো আমরাই উদ্ধার করেছিলাম। সেদিন ঢাকার রাজপথ রফিক, সালাম, জব্বারের মতো আরো অনেকের রক্ত একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল আর সেই রক্তবীজ থেকে জন্ম নিয়েছিল বাংলা নামের একটি ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার। অর্জিত সেই প্রাণের ভাষাটি তার চারপাশে ডাল পালা ছড়িয়ে আপন মনে আনন্দের সাথে নাচতে নাচতে বাংলাদেশের প্রতিটা ইঞ্চি জমিতে আজীবন ছোট্ট কিশোরীর মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াবে এইতো স্বাভাবিক। এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

আঠারো দশকের আমেরিকার কবি রাফ ওয়ালডো এমারসন বলেছিলেন, ‘ÓLanguage is a city to the building of which every human being brought a stone’— খুবই সত্য কথা। যে জাতি মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার জন্যে রক্ত দিতে পারে, বাংলাদেশ নামের নতুন একটা দেশের জন্ম দিতে পারে সেই জাতি নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে বাধ্য। আচ্ছা আমরা সবাই মিলে কি প্রতিদিন একটা একটা বাংলা শব্দ কাঁধে বয়ে আমাদের ঘরে নিয়ে আসতে পারি না? বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির যথাযথ লালন আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি না?

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, লেখক এবং সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।