ঢাকা: নগরায়ন ও পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় যৌথ পরিবার ভেঙে সৃষ্টি হচ্ছে একক পরিবার। এই সকল পরিবারে নবজাতকের পরিচর্যার পুরো দায়িত্ব বর্তায় মা-বাবার উপর।
নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ও পরে উদ্ভুত বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একজন স্ত্রীর পাশে তার স্বামীর উপস্থিতি অতি প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে একক পরিবারগুলোতে। নবজাতকের জন্মের সময় বাবার সান্নিধ্য একজন মায়ের মানসিক শক্তিকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগের ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত দেশগুলোর সারিতে হলেও পিতৃত্বকালীন ছুটি ভোগের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক রাষ্ট্রেই পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কর্মজীবী বাবাদের জন্য রয়েছে পূর্ণ বেতন-ভাতাদিসহ বিভিন্ন মেয়াদী পিতৃত্বকালীন ছুটি। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরেদের জন্য ১৯৯৯ সালে হতে এই ছুটি ভোগের ব্যবস্থা চালু আছে। ২০০৪ সাল হতে পার্শ্ববর্তী নেপালে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে।
এই বিষয়ে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, অতিরিক্ত সচিব আ.ক.ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর মতামত হলো, বিদ্যমান সরকারি ছুটি বিধিমালায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পরিমিত ছুটির বিধান রয়েছে। পিতৃত্বকালীন ছুটি হিসাবে কোন অতিরিক্ত ছুটি সংযুক্ত করা হলে কর্মক্ষেত্রে জনবল সংকট দেখা দিতে পারে। তবে কর্তৃপক্ষ বিকল্প জনবলের সংস্থান রেখে উক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অর্জিত ছুটি হতে সমন্বয়ের মাধ্যমে ছুটির সুযোগ দিতে পারেন।
সরকারি কর্মক্ষেত্রে পিতৃত্বকালীন ছুটির যথেচ্ছ ব্যবহারের ঝুঁকি থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ে এই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কর্মস্থলে নিজের কাজে ও বাসায় নবজাতকের যত্নে অংশ নিতে যেয়ে বাবার ক্ষেত্রে দুই দিকেই গুণগত ঘাটতি দেখা দেয়। মা ও নবজাতকের জন্য সময় দিতে না পারায় বিবেকের দংশনে ভোগেন অনেক বাবা। তার মধ্যে জন্ম নেয় তীব্র মানসিক চাপ ও দ্বন্দ্ব। এই চাপ ও দ্বন্দ্ব মোকাবেলায় কখনো কখনো দাম্পত্য জীবনেও অশান্তি তৈরী হয়। নতুন শিশু জন্মের মত উৎসবমুখর একটি ঘটনা তখন ম্রিয়মান হয়ে যায়।
শিশু মনস্তত্ত্ববিদ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ এই প্রসঙ্গে জানান, শিশুর জন্মের ঠিক পর-পরই মায়ের পাশাপাশি বাবার সাথেও তার আত্মিক সম্পর্ক (attachment) তৈরি হওয়া জরুরি।
আর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে বাবাকে নবজাতকের কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন। পিতৃত্বকালীন ছুটি-এই কাছাকাছি থাকার প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করতে পারে।
‘সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব একা মায়েরই’ এই সনাতন চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে আজকের বাবারা। সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে না থাকার কথা ভাবতেই পারেন না এ সময়ের একজন দায়িত্ববান স্বামী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব পিতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন এভাবে- দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিধি বিস্তৃত হওয়ায় কর্মজীবী মায়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বহুলাংশে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ফলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটেছে।
পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোতে জেন্ডার সমতায়নের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক সংস্থানের পাশাপাশি নবজাতকের লালন-পালনের ক্ষেত্রেও বাবার দায়িত্ব পালন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষিতে পিতৃত্বকালীন ছুটির সুযোগ তৈরি হলে সময়োপযোগী parental care দেওয়া সম্ভব হবে। যা পরবর্তীতে শিশুর সামাজিকীকরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হবে।
নবজাতকের যত্নে বাবার অংশীদারিত্বমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করতে, কর্মজগৎকে আরো কর্মীবান্ধব করতে এবং নবজাতক শিশুকে অধিকতর নিরাপদ রাখতে- মায়ের প্রসবকালীন ও তৎপরবর্তী জটিল সময়টুকুর জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করাটা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
* হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ। ই-মেইল: zakiimed@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৪