ঢাকা: ১. ২০১১ সালের কথা। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে লম্বা সালাম এবং তারপরে এক নিঃশ্বাসে অভিযোগ- ”আমার লেখা ’ওমুক’ ব্লগে প্রকাশ হয়েছে, ’তমুক’ ব্লগে প্রকাশ হয়েছে, আপনারা আমার লেখা প্রকাশ করেন না … … …!” একটি ব্লগের মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালনের সূত্রে এই ফোন প্রাপ্তি।
স্মৃতিতে এখন যা মনে পড়ে, আমি বিনয়বতার হয়ে বলেছিলাম, সব ব্লগেরই নিজস্বতা আছে। আপনি কোন বই থেকে লেখা হুবহু তুলে না দিয়ে রেফারেন্স টেনে আপনার মতামত লিখুন। স্থানীয় মসজিদ-মাদ্রাসার কোন সমস্যা তুলে ধরতে পারেন নাগরিক সাংবাদিকতা চর্চায় … …। ফারাবী কোন তর্কে না গিয়ে সুবোধ বালকের মত শুনে ফোন রেখেছিল। এরপর কিছুদিন ‘কপিপেস্ট’ লেখার বদলে নিজস্ব কথাবার্তায় ব্লগে পোস্ট করতে দেখা গিয়েছিল ফারাবীকে।
পুরো নাম শাফিউর রহমান ফারাবী। বাংলা ব্লগে এবং ফেসবুকে ’ফারাবী’ অতি পরিচিত নাম। এমন কোন বাংলা ব্লগ নেই যেখানে ফারাবীর ব্লগ এ্যাকাউন্ট নেই। সকল বাংলা ব্লগে এবং ফেসবুক প্রোফাইলে ফারাবী তার ছবিও ব্যবহার করেছে। দ্বীনের বাণী আর নাস্তিক্যবাদ চিহ্নিতকরণ - এই হচ্ছে ফারাবীর ব্লগিং এজেন্ডা।
আপাতদৃষ্টিতে এসব লেখনী দোষণীয় নয়। নিশ্চয়ই ফারাবীরও রয়েছে বাক স্বাধীনতার অধিকার। তবে যারা ফারাবীর লেখার ধরণ অনুসরণ করেছেন তারা বুঝবেন, ফারাবী হচ্ছে খেলাফত রাষ্ট্র গঠনের এজেন্ডা বাহক। ফারাবী ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধেও বিদ্বেষমূলক লেখা লিখেছে। আরজ আলী মাতব্বর, স্যার জাফর ইকবাল, মার্ক জুকারবার্গ- এই সকল ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ফারাবীর রয়েছে প্রবল আক্রোশ।
নিজের যোগাযোগ তথ্য প্রদানে ফারাবীকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে দেখা যায় না। ইমেইল, ফোন নম্বর, ফেসবুক লিংক ইত্যাদি সে নিজেই তার প্রোফাইলে লিখে রাখে, উপরন্তু মন্তব্য ঘরেও দিয়ে আসে। ফারাবীর কিছু ব্যক্তিগত তথ্য, যা সে নিজেই প্রকাশ করেছে, জানা যাক। শাফিউর রহমান ফারাবী নিজেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ২০০৫-২০০৬ সেশনের শিক্ষার্থী হিসেবে দাবি করে। এই পরিচয় সে বেশ কয়েক বছর ধরেই বহাল রাখে ব্লগে। ২০১১’তে ফেসবুকে একটি গ্রুপে ফারাবী একবার লিখেছিল, রাজনীতির কারণে তাকে রিমান্ডে যেতে হয়েছিল এবং তাতে তার লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটেছিল।
ফারাবীর তথ্যমতে সে নটরডেম কলেজ থেকে পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফারাবীর বাবা ইন্তেকাল করেন। ফারাবীর তথ্য মতে তার পিতা ফেরদৌসুর রহমান একজন সরকারি কর্মকর্তা (মৌলভীবাজার জেলার B.R.D.B. এর উপ- পরিচালক তথা ডেপুটি ডিরেক্টর) ছিলেন। পিতার মৃত্যু নিয়ে লেখা পোস্টে ফারাবী এও উল্লেখ করেছিল, তার পিতা শেখ হাসিনার সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েও দেখা করেছেন। ফারাবী পরিবার ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া নিবাসী হলেও পিতার চাকরির কারণে তাদের সিলেট থাকতে হয়। ফারাবীর পোস্ট থেকে পাওয়া সূত্রমতে তার বোন অসম্ভব মেধাবী। পিতার মৃত্যুর শোক নিয়েও ফারাবীর বোন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় সারা দেশে ১১৮০ তম হয় এবং সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়।
২০১১ সালে জনৈক নারী ব্লগারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি বাংলা ব্লগে ফারাবীর ব্লগ এ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়। জানা যায়, ফারাবী একই ধরনের বিবাহ প্রস্তাব একাধিক নারীকে ফেসবুক ম্যাসেজ বক্সে প্রেরণ করে। ফারাবী বাংলা ও ইংরেজিতে প্রেরিত বিবাহ বার্তায় নিজের বয়স ২৬ বছর জানায়। ফারাবী নিজেকে ইসলামি চিন্তক ও পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়কারী হিসেবে জানায়। ব্যক্তিগতভাবে অচেনা নারীদের কাছে প্রেরিত বিবাহ বার্তায় ফারাবীর বক্তব্য ছিল – “ I wish to pass my whole Life with you. So, pls Marry me. my cell- 01942447658”। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফারাবী যথেষ্ট হাসির খোরাক হলেও ফারাবী তাতে লজ্জিত না হয়ে নিজেই সাফাই বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছিলো, “আপনারা সামান্য একটি বিষয় নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। … … … আর মানুষ তো বিয়ে করার সময় অনেক মেয়ে দেখে তো তাতে দোষ কি? …”।
প্রকৃতপক্ষে ফারাবীকে নিয়ে ব্লগে-ফেসবুকে হাসিঠাট্টা হয়েছে প্রচুর। তাকে পাগল, অপ্রকৃতস্থ, জামাতি এমন সব নামেও বিশেষায়িত করা হয়েছে। অতঃপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফারাবীকে ’গন কেইস’ ঠাউরে ’ইগনোর’ করা হয়েছে।
যে ফারাবীকে ইতিপূর্বে তুমুল তার্কিকরূপে আবির্ভূত হতে দেখা যায়নি, সে ফারাবী ২০১৩ থেকে হুমকিদাতারূপে আবিভূর্ত হয়েছে। কখনও সে ব্লগারদের হুমকি দিচ্ছে, কখনো রাজীব হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটককৃত নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে প্রচারণা করছে। ফারাবীর নিজের নামে ফেসবুক এ্যাকাউন্টে ১৪ হাজারেরও অধিক ফলোয়ার। নিজ নামে তার একটি ফেসবুক পাতাও আছে যেখানে এক হাজারেরও অধিক লাইক রয়েছে। হুমকি প্রদানের কারণে ফারাবী আটক হয়েছিল এবং ছাড়াও পেয়েছে। ফারাবীকে জিজ্ঞাসাবাদে তার আচরণে সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পাননি কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? ফারাবী নিজেই তার যত ব্যক্তিগত তথ্যদি প্রচার করেছে তার সত্যতা কতটুকু? কোন দলীয় রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে ইতিপূর্বেও ফারাবীকে রিমান্ডে যেতে হয়েছিল?
ফারাবীর একটি ব্লগ এ্যাকাউন্টে পরিষ্কার করে লেখা আছে, ”হ্যা আমিই শাফিউর রহমান ফারাবী, থাবা বাবা ওরফে … … ব্লগার রাজীবের জানাজার ইমামকে হত্যার হুমকি দেয়ার কারনে আমার নামে ডিবি পুলিশ কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(১) ধারা ও পেনাল কোড ৫০৬ ধারায় মামলা হয়েছিল। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে দীর্ঘ ৬ মাস কারাভোগের পর আমি হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পাই“। এ ধরনের আত্মপরিচয় প্রদান কি ঔদ্ধতপূর্ণ নয়? “বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আসলে কতটুকু স্বাধীন” এই শিরোনামে ফারাবীর লেখা রয়েছে ব্লগে এবং তার ফেসবুক পাতাতেও পাওয়া যাবে এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য। ফারাবী অতিসম্প্রতি রকমারি ডটকমে লেখক অভিজিৎ রায় সম্পর্কে কটূক্তি করে এবং অনলাইন বই বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান রকমারি ডট কমের কর্তৃপক্ষকে এই লেখকের গ্রন্থ ডিসপ্লে থেকে সরিয়ে নিতে ইঙ্গিত প্রদান করে।
অনলাইনে ফারাবীর মত একজনের এই উন্মুক্ত বিচরণ কি ৠাব-পুলিশের নজরদারির আওতা বহির্ভূত ? বিভিন্ন সময় হত্যা ও অপরাপর হুমকি, আটককৃত সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের সমর্থন প্রদান, রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে উস্কানি প্রদান – এসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আমলে কেন আসছে না? ফারাবীকে পরিচালনা করছে কারা? একজন ফারাবীর কথায় যদি রকমারি ডট কম এর মত একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত অভিজিৎ রায়ের বই বিক্রির বিজ্ঞাপন থেকে তুলে নিতে হয়, তবে ভ্রুকুটি করে বলতে হয়, এ রাষ্ট্রে সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে ইতোমধ্যে।
২.
রকমারি ডট কম লেখক অভিজিৎ রায়ের বই তাদের বিজ্ঞাপন থেকে তুলে নেয়ায়, এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোপের মুখে পড়েছে। অনেকে এখন পরযন্ত রকমারি ডট কম থেকে বই কেনার পাই পাই লেনদেন জানিয়ে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। ফারাবীর বদলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধান আসামির কাঠগড়ায় রকমারি ডটকম। অনেকেই প্রসঙ্গক্রমে বাক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে এর পুরো দায় চাপাচ্ছেন রকমারি ডট কম এর ঘাড়ে। অর্থ্যাৎ একে তো ফারাবীর প্রচ্ছন্ন হুমকি, তারপর অনলাইন গোষ্ঠীর হম্বিতম্বি, রকমারি ডটকম এর সমুখে দু’ধারি তলোয়ার!
রকমারি ডট কম তরুণ, মেধাবীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ফারাবীর হুমকিতে বিব্রত না হয়ে যদি প্রতিষ্ঠানটি অভিজিৎ রায়ের বই বহাল রাখতো তাদের বিক্রির তালিকায়, তাহলে আমরা তাদের স্বাগত জানাতেই পারতাম, তবে এই প্রতিষ্ঠান যদি তাদের কর্মীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তো এজন্য এই প্রতিষ্ঠানটিকে হেনস্তা করাটা সমুচিত নয় মোটেও।
অভিজিৎ রায়ের বই নিষিদ্ধ নয়। তারমানে আজিজ সুপার মার্কেটে গেলে, প্রকাশকের কাছে গেলে লেখকের বই সংগ্রহ করা যাবে ঠিকই। ফারাবী কী সকলকে অভিজিৎ রায়ের বই বিক্রি বন্ধে হুমকি দিতে সক্ষম? প্রকৃতপক্ষে ফেসবুকে বাগাড়ম্বর নয়, বিষয়টির একটি আইনি ফয়সালা হওয়া জরুরি। রকমারি ডটকম নয়, অপরাধ করেছে ফারাবী। লেখক নিজে অথবা শুভাকাঙ্ক্ষী সমেত আইনের শরণাপন্ন হলে ভাল হয়। এই বিষয়গুলোকে আইনি যুক্তিতর্কে এনে আইনি সুরাহা হলে সকলের হাতে একটি দৃষ্টান্ত থাকবে। তাহলে আগামীতে কোন প্রকাশনা, বই বিক্রেতা, সংবাদপত্র এবং লেখক এ ধরনের হুমকিতে অবদমিত হবে না। এ লড়াইটি হোক কাঠমোল্লা গোত্রীয় ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত মুক্তচিন্তার লড়াই এবং বস্তুনিষ্ঠ যুক্তিবিদ্যার উপাখ্যান আমাদের মানবিক-নাগরিক-রাষ্ট্রীয় অধিকার নিশ্চিতকরণে।
লেখক: ব্লগার, কবি ও অ্যাক্টিভিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৪ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৪