সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, সেমিনার, টকশো ও নানা বৈঠকে যে কথাগুলি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ১৮ দলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার বিষয়টি অন্যতম।
সরকার প্রধান ও তাঁর পারিষদবর্গ বেশ জোর দিয়ে বলছেন, বিএনপি তার জোট থেকে জামায়াতকে বের করে দিলে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনার দরজাও খুলে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী একটি ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল। ‘রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ভিত্তি ধর্ম’ -এই লক্ষ্য-আদর্শে গঠিত রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও গোষ্ঠীর তৎপরতা এখন দুনিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশেই দেখা যায়। তারা ভালো কি খারাপ, সেই বিতর্ক এখানে নিষ্প্রয়োজন। তবে এই উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু কথা বলা হয়তো বাহুল্য হবে না।
বৃটিশ রাজত্বের অন্তিমকালে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ নামে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। এর আগেই মুসলিম লীগ ভারতে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলে।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামী হিন্দ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চায় নি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে দলটি মুসলিম লীগকে সমর্থন করে নি। তবে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতীয় মওদুদী পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। জামায়াতে ইসলামীও ভারত ও পাকিস্তানে দুই অংশে বিভক্ত হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান মুসলিম পারিবারিক আইন প্রণয়ন করেন। জামায়াতে ইসলামী এই আইনের বিরোধিতা করে। এই কারণে সরকার ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি দলটির কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। আটক করা হয় মওদুদীসহ ৬০ জনকে। পূর্ব পাকিস্তানে আটক ১৩ জনের মধ্যে গোলাম আযম ছিলেন।
আইয়ুব খানের সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ১৯৬৫ সালে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামী ঐ জোটে অংশ নেয়। তবে ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও মওলানা ভাসানীর ১১ দফার তীব্র বিরোধিতা করে তারা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াত পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের ৬দিন পর গোলাম আযম ঢাকা রেডিও থেকে দেয়া এক ভাষণে বলেন, ‘ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানিদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ... আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না। ’
স্বাধীনতার পর জামায়াতসহ কয়েকটি দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। জামায়াত যুক্ত হয় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে। ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সব রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন গোলাম আযম। ১৯৭৯ সালের মে মাসে গঠন করেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। নব্বইয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে দলটি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন ও ২০০৮ সালে ২টি আসন পায়। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর আইন অনুসারে শাসনতন্ত্র কায়েম করার কথা বলা হয়। কিন্তু ‘ ২০১২ সালে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য দেয়া গঠনতন্ত্রে আল্লাহর আইন ও ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি কয়েকটি ইসলামী সংগঠনের ২৫ জন সদস্য জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন। কোর্ট জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ ও নির্বাচন কমিশন সচিবকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলেন। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেন। এরপর বিভিন্ন ফোরাম থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি উঠতে থাকে।
সম্প্রতি নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে অনেকে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। হতেই পারেন। কিন্তু ‘ একথা স্বীকার্য যে, সাম্প্রদায়িক স্বার্থের কারণে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিল।
সামন্তবাদী প্রভাব বলয়ের মধ্যে দেশভাগের পর হিন্দু জমিদার, মহাজন, রাজনীতিক, উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীরা তাদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং ভবিষ্যতে উন্নতির সম্ভাবনা না থাকার আশংকায় ভারতে চলে যান। পিতৃভূমি আঁকড়ে থাকেন অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ। পরবর্তীকালে তাদের আশংকার প্রমাণ পাওয়া যায়। অমুসলিমদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বৈরী মনোভাব শুরু থেকেই পরিলক্ষিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষে কুঠারাঘাত করলেও মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয় নি।
ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মানা হয় না। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের মারণমন্ত্রে দীক্ষিত একদল উন্মত্ত মানুষ দাপিয়ে বেড়ায়। প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হলেই কি ওরা ঘরে ফিরে যাবে? সন্দেহ নেই জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সুযোগসন্ধানী, সংখ্যালঘু। বড় কোন শক্তির আশ্রয় না পেলে অস্তিত্ব বিপন্নের আশংকা।
মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও বিভিন্ন সূত্রে মানুষের মতামত পেয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর দলটি তাণ্ডবে মেতে উঠে। এর ফলে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। সরকার পতনের আন্দোলনে ২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ব্যর্থ হলে ১৮ দলীয় জোট হরতাল-অবরোধের পরিবর্তে উপজেলা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেয়।
এর পূর্বে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি অতি দ্রুত রদবদলের কথা বলেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই কাজটি আজও হয় নি। সম্প্রতি রাজবাড়ীর জনসভায় খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচনের পর আবারও সরকার পতনের জন্য আন্দোলনের ডাক দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সংঘাত-সংঘর্ষ হলেও সেই আন্দোলন অহিংস বলেই হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী উপজেলা নির্বাচন ও বর্ষার কারণে অক্টোবরের আগে সরকারের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ আন্দোলন করা সম্ভব হবে না। ফলে এখন আর জামায়াতকে ১৯ দলীয় জোটে রাখার প্রয়োজন নেই বলে অনেকে মনে করেন। পরবর্তী পর্যায়ে অভিন্ন কর্মসূচিতে যুগপৎ আন্দোলন করা যেতে পারে।
রেজাউল করিম খান: সাংবাদিক, e-mail: rezaul.natore@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৪