অ্যামস্টারডাম, নেদারল্যান্ডস: বাংলাদেশ দল যে কী ভীষণরকম বাজেভাবে হারতে পারে- বহুবার হৃদয়ে গভীরতর কোনো আঘাতে সে অভিজ্ঞতা লব্ধ হয়েছে। তবে মাঠে বসে সম্যক দর্শনের সুযোগ হয়েছে একবার।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, হল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচটার কথা বলছি, যোগ্যতার বিচারে হল্যান্ডের সেদলটির খেলোয়াড়রা আজকের হংকংয়ের কোমরের উপরে ওঠারও যোগ্যতা রাখে না। দলটিতে হল্যান্ড জাতীয় দলের খেলেছে মাত্র ৩ জন।
বাকি যারা, তারা স্থানীয় একটি ক্লাবের খেলোয়াড়। সম্পর্কে চাচাতো- মামাতো- খালাতো ভাই এবং সবাই পাকিস্তানি অভিবাসী। এদের মধ্যে একজনকে আগের ম্যাচে বলবয় হিসেবে দেখেছিলাম।
মাঠের পাশে যেহেতু অনেক গরু চড়ে বেড়ায়; গরু সরিয়ে বল খুঁজে আনা ছিল তার কাজ। আমাকে অবাক করে পরের ম্যাচে বলবয়ের খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হল! এবং রাখালবালক সর্বস্ব একটি দলের বিরুদ্ধে আমরা ২০১২ সালের জুলাইয়ে হেরে গেলাম।
দর্শকের ধরণ বিবেচনায় আমরা বাংলাদেশ দলের অন্ধ সমর্থকগোষ্ঠী। দলটা মোটেই প্রফেশনাল নয়- সেটা কেইবা না জানে। এদের সমুচিৎ শিক্ষা হতে পারে যথার্থ সমালোচনায়; তাও জানা আছে। কিন্তু গল্পের পরেও তো গল্প থাকে। সে গল্পে আবার পিছুটান থাকে।
সাল ২০০৭। জুন মাস সম্ভবত। আমার মেজো চাচার শরীর খারাপের চূড়ান্ত। আমাদের ছোট শহরে ভালো ডাক্তার নেই। এদিকে ভদ্রলোকের হার্ট এবেলা ঠিক থাকে তো পরের বেলা বিকল হতে গিয়েও হয় না।
আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি। বলি, আলহামদুলিল্লাহ। চাচা ঘরকুনোদের মহারাজা এবং মৃত্যুচেতনায় ভীষণ রকমের আড়ষ্ট। জয়পুরহাটের বাইরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই। আমি কলেজ থেকে ছুটিতে বাসায় এসেছি।
জুন মাসের শেষের দিকের কোনো এক ভরা বৃষ্টির রাত। হঠাৎ করে ভদ্রলোকের কার্ডিয়াক এরেস্ট হল। আমরা এক কাপড়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঢাকার পথে নামলাম। আমার বাবা’রও শরীরের অবস্থা সুবিধার না, সেই বিচারে পরিবারের সবচেয়ে বড় এবং সর্বাপেক্ষা দায়িত্বহীন ছেলেটাকে দায়িত্ব নিতে হলো।
অ্যাম্বুলেন্সে আমি, মা, চাচি আর মেজোচাচা। আমাদের জয়পুরহাট-বগুড়ার রাস্তায় সামান্য জোরে বাতাস হলেই গাছেরা বিনয়ী হয়ে ঢলে পড়ে। সেক্ষেত্রে রাস্তা বন্ধ থাকার জোর সম্ভাবনা আছে। আরও নানা দিক থেকে চিন্তার শেষ নেই। চাচা’র অবস্থাও বোঝার সুযোগ নেই, আমাদের অল্প চিকিৎসা জ্ঞানে সেটা বোঝা সম্ভবও না। শুধু জানি, স্বল্পতম সময়ে ঢাকা পৌঁছানো দরকার।
যমুনা সেতুর ওপার পর্যন্ত কোনো ঝামেলা হলো না। এলেঙ্গা পাড় হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সের চালক হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তার পেছনের একচাকার হাওয়া চলে গেছে! রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি। আশপাশে গ্যারেজ ধরনের কিছু চোখে পড়ে না।
রাতের অন্ধকার আর মনের অন্ধকার- আমরা আলাদা করতে পারি না। গাড়ি চলছে খুব ধীরে, জোরে চালানোর সুযোগ নাই। এক চাকা অকেজো হয়ে আছে। আমার মা অ্যাম্বুলেন্সের জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, মুহুর্মুহু দোয়াদুরুদ পড়েন।
আমি সামনে ড্রাইভারের পাশে বসা, মাথা বরাবরের মতোই দুর্দান্তভাবে ফাঁকা। সতেরো বছর বয়স, পড়ি ক্যাডেট কলেজে। জাগতিক পৃথিবীর সমস্যাগুলোর সঙ্গে এমনিই আমাদের যোগাযোগ কম। মাঝরাতে গাড়ির চাকা বিকল হলে, বিপন্ন পরিবার রক্ষায় কি করা উচিৎ জানা নেই।
হঠাৎ দূরের এক সম্ভাব্য গ্যারেজে ৬০ পাওয়ারের টিমটিমে এক বাল্বের আলোক রেখা দেখা গেল। হাইওয়ে থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে। রাতে মূল সড়ক থেকে নেমে এত ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, সবাই যখন এ ব্যাপার নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত; আমি বললাম, আম্মা চলেন যাই।
এভাবে সারারাত গাড়িতে পার করে দেওয়ার চেয়ে, কি আছে অন্তত দেখে আসা ভাল। আপনাদের গাড়ি থেকে নামার দরকার নেই। আমি গিয়ে দেখে আসবো।
কাছে গিয়ে দেখি, সত্যি সত্যি গ্যারেজ! গ্যারেজে লোক তিন জন। এত রাতে তারা জেগে আছেন; কারণ সেদিন গায়ানায় বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার সুপার এইটের খেলা চলছে!
বাংলাদেশ সময় খেলা চলে গভীর রাতে। আর তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ- দক্ষিণ আফ্রিকার গলা চেপে ধরেছে। ৮৬ রানে ওদের ৫ উইকেট নাই!
আমার বিপদের কথা তাদের অল্প বিস্তর জানানোর সুযোগ হল। বাকিটা গ্যারেজের সেই তিনজন দেখলেন। বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিজয় রাত বলে কথা! মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ি ঠিক হল, আমরা আবার ঢাকার পথে রওনা দিলাম। তবে মাঝের পনেরো মিনিট সেদিন অদ্ভুত কিছু সময়ের সাথে পরিচয় ঘটল।
গ্রামের বেশ খানিকটা বাইরে হাইওয়ের উপকণ্ঠে নিভৃত পল্লীর এক রাত। ১৪ ইঞ্চি টিভির ছোট স্ক্রিনে বাংলাদেশের খেলা চলছে। সারাদিনের ক্লান্তি দূরে রেখে তিনজন মেহনতি মানুষ ধূলা আর রং মাখা মুখে চোখে রাজ্যের স্বপ্নমাখা বিস্ময় নিয়ে টিভির দিকে চেয়ে আছেন! এক একটা উইকেট পড়ে আর ধীরে ধীরে তাদের অভিব্যক্তির বদল ঘটে!
বাইরে বৃষ্টি শেষের পর আষাঢ়ের ঘোলাটে আকাশ। অবিন্যস্ত মেঘেরা অনেক উপরে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে দিলাম। আম্মা আর চাচী বাইরে এসে দাঁড়ালেন। কোথা থেকে যেন একরাশ ভেজা বাতাসের ঝাঁপটা আমাদের পারিবারিক উৎকণ্ঠার মাঝে যেন সাময়িক স্বস্তি হয়ে আসে।
কেন যেন, বারবার মনে হতে থাকে, আজকে বাংলাদেশ জিততে যাচ্ছে। রাত যতই হোক, আর ঝামেলার প্রকার যত রূঢ়ই হোক, এসব কোনো ঘটনাই না। ঢাকা তো খুব বেশী দূরের পথ না। ঠিক পৌঁছে যাব।
আমরা পৌঁছেছিলাম ভোরের আগেই। আর বাংলাদেশও সে ম্যাচ জিতেছিল। সেদিনের সে বিজয়ের সাথে সাথে আরেকটি ব্যাপার ঘটে যায়। আমাদের খুব ব্যক্তিগত পারিবারিক গল্পটির সঙ্গে বাংলাদেশ দল জুড়ে যায়। চাইলেও যাকে আলাদা করতে পারি না। গল্পগুলো ঘুরেফিরে আসে। এবং ভাল করে জানি- এই গল্পগুলো থেকে মুক্তির পথ নেই।
বাংলাদেশের কোনো খেলা হয়েছে, আর আমি ভীষণ রকমের নস্টালজিয়ায় পড়িনি- এমনটা ঘটে না।
এখনকার সময়টা এমন যে- আশার কথা বলতে বলতে যতটা ক্লান্ত হওয়া সম্ভব, আমরা তার চেয়েও বেশী ক্লান্ত। নতুন কিছু বলার খুঁজে পাইনা। ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণের ধারে কাছেও যাব না। শুধু গত মাসের কথা বলি।
গত একমাসে কাজকর্ম কি করেছি জানি না, একুরেসি রেট শূন্য। যাই করি, অর্থহীন মনে হয়। একদম নিরানন্দ জীবনযাপন। তবে এটাও খুব ভাল করে জানি, একটা দুইটা জয় পরিস্থিতি একদম পাল্টে দিতে পারে। খারাপ সময়গুলো মুহূর্তেই দূরে সরে যেতে পারে, দারুণ কোনো এক ফিরে আসায়। অপেক্ষায় আছি।
এই অপেক্ষায় ভালোবাসা যতটুকু আছে, দায় আছে তার চেয়েও বেশী। আমাদের স্কুলের দিনগুলো কতটা অসামান্য ছিল- সেটা আমরা জানি। এটাও জানি যে, বাংলাদেশের যেকোনো জয়ে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার সে দিনগুলো নেহাত সাধারণ কোনো আনন্দ উদযাপনের দিন ছিল না।
সেসব দিনে আমাদের অজান্তেই ধীরে ধীরে হৃদয়ের গভীরতর জায়গায় বাংলাদেশ গেঁথে দেওয়া হয়েছে। হাজারো প্রতিকূলতায় চাইলেই যাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না।
শুভ কামনা বাংলাদেশ। আজও চিৎকার করবো। আর অবশ্যই অফিস পালিয়ে খেলা দেখবো।
চলার পথ তো বন্ধুর হতেই পারে। তাই বলে তো আর পথ চলা থামিয়ে দেয়া যায় না।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৪