মৃত্যুপথ যাত্রী অথবা মূমুর্ষু রোগীর জন্য কোরামিনের প্রয়োজন হয়। কোরামিন না হলে সে বাঁচে না।
শাপলার ঘটনায় অন্য দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অংশগ্রহণ, শেখ হাসিনার বডিগার্ডরা এ দেশের সন্তান নয়, এমন সব আজগুবি উদ্ভট মিথ্যাও বিফলে গেছে। সরকারি ও বিরোধী দল উভয় তকমা বঞ্চিত হবার পর বিএনপির আকাশে এখন কালো মেঘের ঘনঘটা। নেতা ও নেতৃত্বশূন্য সিনিয়র নেতাদের অপারগতা, অনীহা আর চক্রান্তের জাল বন্দি দলটির প্রয়োজন কোরামিন।
লন্ডনে অবস্হানরত যুবরাজ তারেককে দিয়ে সে চেষ্টাই করিয়েছে তারা। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেখালেখি বা আলোচনাও এখন তুঙ্গে। ব্যাপারটা যে পরিকল্পিত এবং সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রের ফল সেটা তাদের নেত্রীর প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট।
তারেকের মুখের কথা মাটিতে পড়ার আগেই তরঙ্গ থেকে তা লুফে নিয়েছেন খালেদা জিয়া। একে প্রতিধ্বণি না বলে ধারাবাহিকতা বলাটাই সমীচিন। বলা উচিৎ চোরের মায়ের বড় গলা। সে জায়গাটিকে এবং নতুন এই কু-বিতর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার কাজটিও থেমে নেই। এ নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিএনপির প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলের লেখাটির জবাব দেয়া তাই জরুরি মনে করছি।
একটি অসময়োচিত সত্য ও মতলবি বিতর্ক শিরোনামের লেখাটি সময়ের স্রোতে খড় কুটোর মত ভেসে যেতে বাধ্য। তবে জনাব সোহেল মিতভাষায় মিনমিনে কলমে ইনিয়ে বিনিয়ে যে কথাগুলো বলতে চেয়েছেন তার মূল উদ্দেশ্য আমাদের জাতীয় জীবনে আরো একবার অযথা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়ে বিএনপি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের মনোবল চাঙ্গা রাখা। তিনি লিখছেন ‘মানলাম, পাঠক বা ঘোষক যাই হোক সেটা জিয়া, আর কেউ নন। তিনিই স্বকণ্ঠে, সদম্ভে, জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে ওই সময়ে সেটা করেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা এভাবেই করতে হয়, শত্রু-মিত্র, বিশ্ববাসী সবাইকে শুনিয়ে। গুপ্তপন্থায় বা চিরকুট দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা হয় না। ’
তার কথাই যদি মানি, ৭ মার্চের ভাষণের কথা ভুলি কিভাবে? স্বাধীনতা একটি জন্মপ্রক্রিয়া। তার জন্ম কোন মুহূর্ত বা মিনিটের ব্যাপার হতে পারেনা। ধারাবাহিক আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ সব কিছু বাদ দিয়ে জিয়ার মত তখনকার এক সাধারণ মেজর কোন রেডিওতে কি বললেন তাতেই সারা দেশের মানুষ উজ্জীবিত হয়ে গিয়েছিল এ ধারণার প্রচার আর কতকাল?
স্বকণ্ঠে মানলাম, কিন্তু সদম্ভে মানে কি? যে জাতি তার মুক্তিযুদ্ধের প্রস্ততি লগ্নে অসহায় তার সামনে ঘোর র্দুদিন, ডানে বাঁয়ে পাকিস্তানি সেনা, তার কণ্ঠে তেজ থাকতে পারে, কিন্তু দম্ভ আসে কোথা থেকে? আমি জানিনা সে সময়কালে মারুফ কামাল সোহেল কত বড়টি ছিলেন বা তার আদৌ জন্ম হয়েছিল কিনা? কে তাকে বলেছে চিরকুটের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল? এবং তা গুপ্তপন্হায়?
লাখ লাখ বাঙালিকে সামনে রেখে জাতির জনক স্পষ্ট বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। অন্ধ বধির ও মতলববাজরাই এত বছর পর সে ঘোষণাকে পাশ কাটিয়ে কোন এক মেজরের পাঠকে আসল বলে চালাতে চায়। সোহেল কি এটা জানেন না মুক্তিযুদ্ধ কত বড় আর বিশাল? নয় মাস ধরে কত প্রক্রিয়া কত দূতিয়ালি আর টানাপড়েন?
ইন্দিরা গান্ধি, নিক্সন, ব্রেজনেভ, চৌ এন লাই, কেনেডি কত নেতার কত ধরনের মধ্যস্হতা আর সংগ্রাম। সেদিন তাজ উদ্দীন আর সৈয়দ নজরুলের নেতৃত্বের বাইরে মোশতাকের মত খুনিও ছিল সঙ্গে। কিন্তু তার সাধের জিয়া কোথায়? লাপাত্তা এই সেনা অফিসার কোন এক সেক্টর সামলাতে ব্যস্ত আর আজ কিনা তিনি হয়ে গেলেন প্রথম ঘোষক, প্রথম রাষ্ট্রপতি? বিশ্ববাসীকে শোনানোর কথাই যদি বলা হয় সেটা কি জিয়া করেছিলেন, না তাজ উদ্দীন সরকার? আরো একটা জায়গায় বড় গোলমালে পড়ে গেছে বিএনপি। হঠাৎ করে ইতিহাসকে নিজেদের দিকে টানার আসল জায়গাটাতে কিছুতেই আসতে পারছে না । সে কথায় পরে আসছি।
সোহেল লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমানের ঘোষণা অস্বীকার করলে স্বাধীনতার যুদ্ধকেই অস্বীকার করা হয়, এর ইতিহাস বিকৃত ও ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়। জিয়া নিজেকে তার ঘোষণায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণা বৈধ হলে, প্রবাসী সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও তিনিই বৈধ ছিলেন। তার এই ঘোষণাকে আর কোনো ঘোষণা মারফৎ কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ কখনো রদ বা রহিত করেনি। ’
যদি তার এই বক্তব্য সত্য মানি সরকার গঠনে অস্হায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল আসেন কিভাবে? এবং কি উপায়ে জিয়া এদের অধীনে যুদ্ধ করতে রাজী হন? আসলে বৈধতা যে কোথায় এবং সে বৈধতার কিরূপ তা আমরা স্বাধীনতার পর পরই দেখেছি। না ছিলেন ঘোষক না কোন রাষ্ট্রপতি সে কথা সোহেল নিজেও জানেন। জানেন বলেই কোন বক্তব্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে খালি প্রশ্নবোধক কথা বলছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দেখা আমরা এখনো বেঁচে আছি। জিয়ার যদি সে সাহস ও নেতৃত্ব থাকত দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাকশালে যোগ দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সামনে মোড়ায় বসে নিজের অধীনতা প্রমাণের চেষ্টাও করতেন না। নয়মাসের বিপুল ঐশ্বর্য আর সংগ্রামে এক তিল জায়গার একজন সৈন্যকে অস্হায়ী রাষ্ট্রপতি বলার জন্য যে জিভ খসে পড়ছে না এটাই কলিকালের উপহার। সে উপহার ভোগ করে জনাব সোহেলরা মনগড়া কাহিনি ও যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি আকাশে মিলিয়ে যাওয়া বিমানের মত বিএনপির মিলিয়ে যাবার দূর্ভাবনা থেকে নিজেদের কবর খোঁড়ার এই অপপ্রক্রিয়া আসলেই হাস্যকর। কিছুদিন আগে আমরা অষ্ট্রেলিয়ার মিডিয়াগুলোয় একাত্তরের সময় কাল দেখলাম। ইমরান নামের এক যুবক এ নিয়ে গবেষণা করছেন। তখনকার অষ্ট্রেলিয়ান কাগজে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও খবরে আমাদের ইতিহাস জ্বলজ্বলে। এমনটা আমি কম্বোডিয়া সহ নানা দেশেই দেখেছি। বিলেত আমেরিকা এমনকি বিএনপির সাধের দেশ পাকিস্তানের কর্তারাও এই থিওরি শুনে মূর্চ্ছা যাবেন। কারণ যুদ্ধের নয় মাস তারা জিয়া নামের কোন অদৃশ্য মানুষের ছায়াকেও মোকাবেলা করেনি। তাদের সামনে ছিল বঙ্গবন্ধু আর মগজে তাজ উদ্দীনের প্রবাসী সরকার।
প্রেস সচিবের কাজ হচ্ছে নিজের দল ও দলের মতামত তুলে ধরা। সেদিক থেকে জনাব সোহেল তার দায়িত্ব পালনে কসুর করেননি।
সবশেষে লিখেছেন, ‘বিএনপির ওয়েবসাইটে প্রথম না বলে জিয়াউর রহমানকে সপ্তম প্রেসিডেন্ট বলা হয়েছে। কাজেই তারেক রহমান যা বলেছেন এবং তাকে সমর্থন করে বেগম জিয়া যা বলেছেন তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে, এমন কুযুক্তিও তুলেছেন কেউ কেউ। ’
এখন তাকে আমি একটা ছোট ধন্যবাদ দেব। ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির গাঁটছড়া সব সময়ই শক্ত। তারপরও তিনি তার লেখায় উদাহরণ হিসেবে মহাভারতের কথা টেনেছেন। এটাই বিএনপির স্ববিরোধিতা। তারা বাঙালিকে আমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি বা ইতিহাস কাহিনীর বেলায় মুসলিম বানিয়ে রাখতে চাইলেও নিজেরা সময় সুযোগ পেলেই সে সব সম্পদের এস্তেমালে আগ্রহী। এদের নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট চিকিৎসক বি চৌধুরীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষ ছড়ানোয় পারদর্শী চৌধুরী সাহেব টিভি উপস্হাপকও ছিলেন একদা। এক অনুষ্ঠানে জ্বালাময়ী স্বজাত্যবোধের কথা বলার পর তাকে একটি গান গাইতে অনুরোধ করা হয়েছিল। বি চৌধুরী তখন ইমোশোনাল। ফলে বাস্তবতার ফাঁক গলে গেয়ে উঠলেন ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে বললাম...: বাহ কি মধুর হেমন্ত প্রীতি। এখন তারা বলবেন এতে দোষের কি? আরে আমরাও তো সেটাই বলছি, দোষ কোথায়? মনে যা মুখেও তাই বলুন। মুশকিল হল সেটা তারা বলবেন না। যে ওয়েব সাইটটি দলীয় তা কি গবেষণা ব্যতিরেকে এমনি এমনি করা? সেখানে প্রথম না বলে সপ্তম বলার বলার কারণ কিন্তু পরিষ্কার করলেন না প্রেস সচিব।
জনাব সোহেল লিখেছেন- তারা আওয়ামী লীগারদের ষড়যন্ত্র বোঝেন। কেন এই কথা নিয়ে হৈ চৈ তাও নাকি জানেন। আমরাও আপনার মত কিছু কিছু বুঝি। আওয়ামী লিগার না হবার পরও সাধারণ মানুষ হিসেবে বুঝি আপনারা ইতিহাসকে টেনেহিঁচড়ে পঁচাত্তরের পর থেকে শুরু করতে চান খুনি মোশতাকের কালো অধ্যায়ের দায়-দায়িত্ব সরিয়ে জিয়ার আমল থেকে ইতিহাস হলে তিনি যে প্রথম সেটাই তো ঠিক তাই না? এভাবে কি আর হয়?
শুরুতেই বলছিলাম কোরামিন দিতে চাচ্ছেন দিন। কিন্তু ওভার ডোজ যেন না হয়। প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ বেছে নেয়া দলটি প্রথম নিয়ে তর্ক শুরু করেছে শেষ বাংলাদেশের অন্তিম পেরেক ঠোকার আশায়। জাতি সাবধান। সাবধান হে তারুণ্য। এরপর নিজের দেশ বা মুক্তিযুদ্ধ বলেও কিছু থাকবে না। আমরা বিএনপি’র মত জনসমর্থনপুষ্ট দলের কাছে দেশপ্রেম ও সঠিক ইতিহাস ভিত্তিক রাজনীতি আশা করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তারা কি আসলেই তা করতে পারবেন?
অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৪