ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জীবনের সেকাল-একাল

শৈবাল বড়ুয়া, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৪
জীবনের সেকাল-একাল ছবি : শৈশব / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জীবন চলমান। হোক তার গতি পরিবর্তন, কখনো বা থমকে দাঁড়ানো।

নানা পরিবর্তনের ছোঁয়ায় তবুও জীবন সামনেই চলে। পেছনে ফেলে আসে স্মৃতি। জন্ম, শৈশব, ছাত্রজীবন, গ্রামের কাদামাখা মেঠো পথে চঞ্চলতায় পথ চলা, কলাগাছের ভেলা বানিয়ে বর্ষার গলা পানিতে ভেসে বেড়ানো, জাল দিয়ে মাছ ধরার কথা ভুলে থাকা যায় না।

আমাদের গ্রামীণ জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে। ইট, পাথর, বিটুমিন, বালির কাছে মাটির রাস্তাগুলো গা ঢাকা দিয়েছে। হারিকেন আর চেরাগের আলোকে বিদায় করে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে ডুবে যাচ্ছে আমাদের রাতের পরিবেশ। ডাকহরকরা আজ বাড়ি বাড়ি পদব্রজে বা সাইকেলে করে হাঁক দিয়ে পত্র বিলি করে না। ওরাও বদলে যাচ্ছে। ট্রানজিসটারে প্রতিবেশীরা মিলে একসাথে খবর শোনার দৃশ্যপট খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। টেলিভিশন, এল.সিডি. এল.ই.ডি প্রতিটি ঘরের শোভা বর্ধন করছে। কম্পিউটার, আইপ্যাড, আইফোন না থাকলে নিজেকে যেন সেকেলে মনে হয়। এ যেন এক পারিবারিক মর্যাদা তৈরির সিড়িঁ।

প্রবাসীহীন গ্রাম এখন নেই তাই প্রবাস ফেরত যে কেউ এহেন বৈচিত্রপূর্ণ সামগ্রী দিয়ে জীবনকে পারিবারিক বৈচিত্রের রং দিয়ে সাজাতে সচেষ্ট। শহরের বড় বড় সিনেমা হলগুলো আজ ওই বাক্সগুলোর ভেতরে অবস্থান নিয়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো বাজার দখলের লক্ষ্যে প্রদত্ত বিভিন্ন সুবিধার কারণে এসব পণ্য আজ মানুষের নাগালের মধ্যে ধরা দিয়েছে। এই সুবাদে আজ স্কুল পালিয়ে শহরে সিনেমা দেখতে যেতে হয় না বর্তমান প্রজন্মের। বাঁশের চোঙে পয়সা জমিয়ে মেলা-পার্বনে যাওয়ার আনন্দ একালের শিশু কিশোররা উপভোগ কতটুকু করতে পারে? নাপিত এখন চুল কাটার সময় হলে নিয়মিত ঘরের দ্বারে এসে হাজির হয় না, ওরাও আজ এসি ঘরে থেকে এই সেবা দিয়ে নিজেদের উন্নয়ন জাহির করে।

শৈশবে চার আনা পয়সার জন্য মার কাছে কতো আকুতি? স্কুলে যাওয়ার আগে সন্তানকে গরম ভাত রেঁধে খাওয়ানোর জন্য মায়ের কতো প্রাণপন প্রচেষ্টা? যা এখন দখল করে নিচ্ছে ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো। অঘাট-ঘাট হবে, অমানুষ-মানুষ হবে পূর্বে শোনা বাক্যগুলো সতিকার রূপ এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে।

একসময় পুকুর পাড়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সময় কেউ কি কল্পনা করেছিল যে কারেন্ট জালে মাছ ধরে তাতে ফরমালিন নামক বিষাক্ত কেমিকেল মাখিয়ে মরা মাছকে তাজা করে তাদের খাওয়াবে কিছু অমানুষের দল? মোটা তাজাকরণ ওষুধের গরুর গোশত আর ফরমালিন মিশ্রিত সামগ্রীতে সয়লাব হয়ে যাবে বাজার?

কেউ কি ভেবেছিল যে, হুমনা হু-ম-না শব্দে নববধূকে নিয়ে যাওয়া পালকি যন্ত্রের গাড়ির কাছে পরাজিত হয়ে ঠাঁই খুঁজবে যাদুঘরে? বাড়ির আঙিনায় বিয়ে-মেজবানে সম্মানের সামাজিকতা হারিয়ে শহর, নগর-বন্দর জুড়ে “কমিউনিটি সেন্টারগুলো” এক মেকী সামাজিকতার নিয়ম চালু করবে? বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসার শত শত বৎসরের সভ্যতা ম্লান করে দিয়ে রঙিন ছাপানো পত্র মারফত দাওয়াতের কাল পেয়ে, মুঠো ফোনে দাওয়াত দেওয়ার সহজ সামাজিকতা আমাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আবেগ কেড়ে নেবে?

গ্রীস্মের প্রচণ্ডি রোদ্দুরে একটু বিশ্রামের জন্য কোন সমাজহিতৈষীর লাগানো বৃক্ষের নীচে একটু সময় কাটানোর কথা এ প্রজন্মের কজনে জানে?
খালী পায়ে হাটার উপযোগিতা ও উপকারিতার কথা আজ কজনে স্বীকার করে? সড়কের জন্য নিজের সামান্য জায়গা ছেড়ে দেওয়ার মতো মহত্ব ভুলে গিয়ে রাস্তার জায়গা দখল করে নিজ নিজ স্থাপনা তৈরি করতে পারলে তাকেই প্রভাবশালী হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। পাড়ার কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে না গিয়ে টিভির পর্দায় হিন্দি সিরিয়াল দেখাটা অনেকের কাছে মুখ্য হয়ে উঠছে। এর কুফল বুঝেও, সবাই কি আর হবে- এই আলস্য ধারণায় গর্বের সেকালকে নিস্তেজ করে দিচ্ছি।

শিক্ষার প্রতি অভিভাবকের আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অধিক আগ্রহ তাদের শহরমুখী করেছে। এই নেশাকে স্বল্প সময়ের জন্য বিরত দিয়ে শেকড়ের সুখ নিতে ঈদ পার্বনে লাখ লাখ মানুষের গ্রামে ফেরার সুযোগে সেবার ঘোষণা দিয়ে পরিবহন ব্যবসার সেবকরা অবৈধ মুনাফার কাছে আত্মসমর্পন করায়, ছুটির আমেজকে ম্লান করে দেয়।

প্রবাস জীবনের ব্যস্ততা ফেলে গ্রামে অবস্থানের সুযোগ দীর্ঘস্থায়ী করতে না পারলেও অবসরের সাথী বাংলা চ্যানেলগুলোর সুবাদে এই পরিবর্তনটা স্পষ্ট নজরে আসে। শিক্ষা ও বিনোদনের লক্ষ্য থাকলেও বাণিজ্য প্রসারের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন আমাদের যেমন বিরক্ত করে তেমনি অধিক গণতন্ত্রের সুযোগে সত্য বলার অযুহাত তুলে শুধু সরকার বিরোধী সমালোচনার কথা শুনতে শুনতে মনে অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। একই মুখের কীর্তিমানদের বারবার সরব উপস্থিতি দেখে মনে কৌতুহল জন্মে, এরা অতিবচন কি কোন শক্তির সাথে গোপন সম্পর্কের কারণে? নাকি ভবিষৎ কোন উচ্চপদ লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টির অভিপ্রায়?

সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার ব্রত নিয়ে অতিবাহিত করছি সময়, দেখছি সময়ের পালাবদল। প্রবাসে দেশের ভাইদের অনেকের কষ্টসাধ্য উত্থান দেখে ভাল লাগে। আবার একশ্রেণির অতিচালাক, অতিলোভী ব্যক্তিদের কারণে নানাবিধ অপকর্ম আমাদের লজ্জ্বা ও দুর্ভাবনায় ফেলে দেয়। সম্প্রতি কয়েকটি দেশে সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণার কারণে সরকারকে দোষ দেওয়ার লোকের অভাব যেমন নেই, এমনিভাবে আজ অন্য সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাদের দোষ দেওয়ার লোকের অভাব থাকতো না। দেশের চলমান রাজনীতির অজ্ঞ সমর্থকদের কারণে যুক্তি, সত্য ধামাচাপা পড়তে দেখে খুব খারাপ লাগে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা দেখেতে দেখতে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের ব্যস্ততায় ডুবে থাকা ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য যা যা করা উচিত তা না করতে পারার কষ্ট মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকে যা অনেকে না দেখে না বুঝে ভুল বুঝে। কমিউনিটির নেতৃত্বে যারা আছেন তারা আন্তরিক, নিঃস্বার্থবান, যোগ্য। সময়ের অপ্রতুলতায় যথাযথ সবার মূল্যায়ন করাটা কঠিন হয়ে পড়ে, তাই সমস্যা ঘনীভুত হয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ বেড়ে সবাই ঘুরপাকে নিমজ্জিত আছি। বিভাজনের কারণে কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে কোন কোন আয়োজনে তা অযথা অপব্যয় হয় না একথা বলা যাবে না, উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে শুভ ফলাফল শূন্য রয়ে যাচ্ছে। আবার স্বদেশি আয়োজনের অভাব সাবলীলভাবে উপভোগ্য করার পাওনাটাকে অস্বীকার করতে পারি না।

জীবনের প্রয়োজন পূরণ করতে কতো অর্থের দরকার? টাকার পাহাড় গড়তে গড়তে হালাল-হারামের ব্যবধানটা কি ভুলে যেতে হবে? বৈধ-অবৈধ এর ব্যবধান কি এক করে ফেলতে হবে? সততা, ন্যায় এর প্রকৃত অর্থ ভুলে যেনতেন উপার্জনের কাছে বন্দি হয়ে গেলে মৃত্যুর পর হিসাব দিতে ভুল হয়ে যাবে না? ভালো মানুষেরা ক্রমে ক্রমে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। নীরব প্রতিবাদ হচ্ছে সত্য, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরব প্রতিবাদের ভাষা হয়ে যাচ্ছে মূল্যহীন এই জন্যই হয়তো অপছন্দের কথা জানাতেই প্রথম পর্যায়েই হরতাল, জ্বালাও পোড়াও? সময়ের পালাবদলে চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিকাশ মেলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আগামীতে এর সুফল কুফল ভোগ করবে আমার উত্তরাধিকারীরা। পরিবর্তন আসুক ভালোর বার্তা নিয়ে। আসুন তাকে সুপথে নিয়ে যাই সুন্দরের ছোঁয়ায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।