গত কয়েক সপ্তাহে আমার বেশ কিছু মন খারাপ করা অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন মায়ের সাথে দেখা হয়েছে যিনি তার মেয়েকে নিয়ে সব সময়েই এক ধরনের আতংকে থাকেন।
মেয়েটি মাত্র স্কুলে পড়ে। এই বয়সে ছেলেমানুষি কল্পনা করেই সময় কেটে যাবার কথা। মেয়েটির বেলায় তা খাটেনি কারণ সে কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে সেটি নিয়ে তার বাব-মা তার ওপর এমন চাপ দিয়েছে যে তার পক্ষে সে চাপ সহ্য করা সম্ভব হয়নি। হঠাৎ করে তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। মা এখন মেয়েকে নিয়ে এক মানসিক ডাক্তার থেকে আরেক মানসিক ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে আবিস্কার করছেন একটা কমবয়সী কিশোরী মেয়ে নিজের ভেতরে দুর্ভেদ্য একটা দেওয়াল তুলে রেখেছে, সেই দেওয়াল ভেদ করে কেউ এখন ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।
আমি আরেকটি মেয়ের কথা জানি যে তার মায়ের প্রচণ্ড চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করল সে আর বাড়িতে থাকবে না, তাই একদিন সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। এটি একটি ভয়ংকর গল্প হতে পারত, শেষ পর্যন্ত হয়নি। কারণ মেয়েটিকে বহু দূরের একটা এলাকা থেকে সময়মত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। মেয়েটি এখন কেমন আছে আমি জানি না।
মাত্র কয়েকদিন আগে আমার অফিসে একটা ছেলের সাথে দেখা হয়েছে। বাবার পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারেনি তাই বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ছেলেটি এখন আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিত মানুষের করুণার উপর নির্ভর করে কোনভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলেটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে সে এখন কী করবে। আমি বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম তাকে বাস্তব এবং কার্যকর কোনো উপদেশ দেওয়ার মত আমি কিছু খুঁজে পাইনি।
এগুলো হচ্ছে মাত্র গত কয়েক সপ্তাহের উদাহরণ। আমি যদি আরো আমার অভিজ্ঞতার কথা মনে করার চেষ্টা করি তাহলে এরকম অসংখ্য ঘটনার কথা বলতে পারব। বাবা- মায়ের নির্দয় ব্যাবহারে মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যাবার উদাহরণ যেরকম আছে ঠিক সেরকম বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজের নাম পল্টে দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একেবারে নতুন করে একা একা জীবন শুরু করার উদাহরণ আছে।
কেউ যেন মনে করে আমি বলার চেষ্টা করছি আমাদের সব বাবা-মায়েরাই বুঝি এরকম, আমি যে উদাহরণগুলো দিয়েছি সেগুলোর সংখ্যা আসলে খুবই কম। কিন্তু তার পরেও এরকম উদাহরণ যে কম হলেও আছে সেটাই দুশ্চিন্তার কারণ। দুশ্চিন্তাটা একটু বেশি কারণ যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনে হচ্ছে এরকম উদাহরণের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক বাবা-মা সহজ একটা বিষয় বুঝতে পারেন না। তাদের ছেলে মেয়েরা যতই ছোট হোক, তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তাদের নিজেদের বিচার বুদ্ধি আছে এবং তাদের উপর নিজেদের কোনো একটা সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিলে তার ফল কখনো ভালো হতে পারে না।
কয়েক বছর আগে টেলিভিশনের একটা চ্যানেল আমাকে একটা নিয়মিত অনুষ্ঠানে কিছুদিনের জন্য উপস্থিত হতে রাজি করিয়েছিল। শক্রবার সকাল বেলা আমি কিছুক্ষণের জন্য টেলিভিশনে ‘লাইভ’ বাচ্চাদের সাথে কথা বলতাম। বাচ্চারা আমার কাছে তাদের প্রশ্নগুলো পাঠাতো, আমাকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হতো। সে সময় আমি এক ধরনের বিষ্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম এই দেশের শিশু কিশোরদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে তারা যে বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করতে চায় সেখানে তাদের বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে কী না!
আমাকে খুব সাবধানে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। আমি তাদেরকে বলতাম তাদের বাবা-মায়ের বয়স যেহেতু বেশি তাই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বেশি। সেই অভিজ্ঞতার কারণে তারা কিছু কিছু বিষয় জানেন যেগুলো শিশু কিশোররা এখনো জানে না, তাই তাদের বাবা-মায়ের যুক্তিগুলো তারা শুনতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনটা কীভাবে গড়ে তুলবে সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদের নিতে হবে। আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি। আমার ছেলে মেয়ের বেলায় তারা কী নিয়ে লেখাপড়া করতে চায় সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দিয়েছি। আমি মনে মনে আশা করি সবারই জীবনে এই স্বাধীনতাটুকু থাকুক। বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের একটা সুন্দর জীবন দেখতে চান। কিন্তু সে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার জন্য তারা কতোটুকু বাড়াবাড়ি করবেন সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
বাবা মা’দের বাড়াবাড়ি কী পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুল কলেজে এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন হয়। (যখনই সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে
কথা হয় তখন কেউ না কেউ বলে, ‘কিন্তু আপনি কী জানেন, এখন সৃজনশীল প্রশ্নের গাইড বই বের হয়ে গেছে? আগে ছেলে-মেয়েরা শুধু নিজের পাঠ্যবই মুখস্ত করতো, এখন ছেলে-মেয়েদের পাঠ্য বইয়ের সাথে সাথে সৃজনশীল গাইড বইটাও মুখস্ত করতে হচ্ছে!’ আমি তাদের মনে করিয়ে দিই, এই গাইড বই মুখস্ত করে তারা কখনোই কোনো সত্যিকারের পরীক্ষায় একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারবে না! সত্যিকারের পরীক্ষায় কখনো কোনো প্রশ্ন এই গাইড বই থেকে আসবে না। ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের পাঠ্যবই-শুধু তাদের পাঠ্যবই-আগাগোড়া মন দিয়ে পড়ে তাহলেই তারা সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। )
যাই হোক, যখন প্রথমবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষার প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হল, তখন হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে এক ধরনের লেখালেখি শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা এই পদ্ধতিটার গুরুত্বটুকু ধরতে পেরেছিলাম, তাই সবাই মিলে এর পক্ষে কথা বলতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র বিষয় আবিষ্কার করলাম, ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা যেভাবে হোক সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র বন্ধ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেলেন। ঠিক কী কারণ জানি না সেটা করার জন্যে তারা সবাই মিলে আমাকে ‘সাইজ’ করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন। দিন নেই, রাত নেই তারা আমাকে ফোন করেন, আমার সাথে কথা বলেন, দল বেঁধে এখানে সেখানে দেখা করেন, আমাকে নানা বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাদের সাথে কথা বলে কিছুদিনের মাঝে আমি আসল ব্যাপারটি আবিষ্কার করলাম, তাদের যুক্তিটি খুবই চমকপ্রদ। তারা আমাকে বলেন, আমরা আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত, এই পদ্ধতিটি খুব ভালো। কিন্তু এই বছর আমার ছেলে মেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাক তারপর যা খুশি করেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই !
যে সব অভিভাবক আমার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলেন দেশের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তাদের কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, তাদের সকল মাথা ব্যথা শুধু নিজেদের ছেলে মেয়ে নিয়ে। আমি তখন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে অবিষ্কার করেছিলাম, লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে সোচ্চার অভিবাবকরা আসলে খুব স্বার্থপর,
তাদের নিজেদের সন্তানের ভালো–মন্দের বাইরে তারা কখনো কিছু চিন্তা করেন না!
স্বার্থপর মানুষের সাথে কথা বলার থেকে নিরানন্দ কাজ কিছু হতে পারে না । তাদের কথাবার্তা বলার থেকে নিরানন্দ কাজ কিছু হতে পারে না। তাদর কথাবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না।
২.
স্বার্থপর অভিভাবক থেকেও ভয়ঙ্কার এক ধরনের অভিভাবক আছে, তাদের সাথে সাধারণত আমার দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পর। এবার একজন আমার অফিসে এসেছেন। তার সাথে একজন তরুণ চেহারা। দেখে অনুমান করতে পারলাম সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। সেরকম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন, তিনি যে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সেটা তিনি বুঝিয়ে দিলেন। আমার সাথে হাত মিলালেন এবং আমি তাদের সামনে বসার আমন্ত্রণ জানালাম । ভদ্রলোক আমাদের এলাকার মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। আমকে জানালেন তার সাথের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি, তাকে ভর্তি করে দিতে হবে।
‘অমুক বিভাগে ভর্তি হয়েছে, এখন তাকে আপনার বিভাগে ভর্তি করে দিতে হবে’ - এরকম অনুরোধ মাঝে মাঝে শুনতে হয়। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাতেই টিকেতে পারেনি তাকে ভর্তি করে দিতে হবে এই অনুরোধটি নতুন। আমি এ ধরনের অন্যায় কাজ করতে পারি লোকজন সেটা বিশ্বাস করে জানতে পেরে অবশ্যই আমার খুব আশা ভঙ্গ হল। আমার খুব মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু তারপরও আমাকে জোর করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলতে হল- এরকম কিছু করা সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কী, কেউ যদি এটা করার চেষ্টাও করে তারপরও সেটি করার উপায় নেই। মেধা তালিকায় যারা আছে তাদের একজন একজন করে ভর্তি করা ছড়া আমাদের সিস্টেম আর কিছু করতে পারবে না।
ভদ্রলোক আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। হেসে বললেন, এই দেশে সবকিছু সম্ভব । আপনার দেশের একজন মানুষের এ ধরনের বিস্ময় নিয়ে পাশাপাশি বসে থাকা এই কম বয়সী তরুণ এবং তার অভিভাবকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক পর্যায়ে আমাকে কঠিন হতে হল। রুঢ় ভাষায় বলতে হল যে, এই ছেলেটি আপনার পাশে বসে বসে দেখছে তাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর চেষ্টা চলছে! ছেলেটির আপনার সম্পর্কে এখন কী ধারণা হচ্ছে? সে জানছে তার অভিভাবক একজন ক্রিমিনাল-এসেছে আরেকদল ক্রিমিনালের কাছে? ভদ্রলোক অত্যন্ত মনোক্ষূন্ন এবং বিরক্ত হয়ে বিদায় নিলেন। আমার ভেতরটা সারাদিনের জন্য তেতো হয়ে গেল। এই ধরনের অভিভাবকের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। তাদের ছেলে মেয়েদের সামনে তারা অন্যায় কাজ করে ফেলেন। ছেলে মেয়েদের বোঝান কোনো কিছু পাওয়ার জন্য অন্যায় করতে হয়। সৎ হওয়ায় প্রয়োজন নেই। যেটা পাওয়ার কথা সেটা পেলেই হল।
এ ব্যাপারে খুব ছেলে মানুষী একটা ব্যাপার আমার ভেতরে খুব দাগ কেটেছে। আমি বইমেলায় বসে আছি, শত শত ছেলে মেয়ে ভিড় করে আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে, যখন দেখলাম এটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না তখন আমি তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলাম, কিছুটা হলেও একটু শৃঙ্খলা ফিরে এলো, তারপরও যে ছুটাছুটি নেই তা নয়। তখন হঠাৎ করে একজন ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে লাইনের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন ‘এর বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিন’। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘তুমি কি সবার মত লাইন ধরে এসেছো?’ মা ছেলেটিকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না, বললেন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সে লাইন ধরে এসেছে’। আমি আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম ‘সত্যি তুমি লাইনে ছিলে?’ ছেলেটি কিছু বলতে পারল না, মা আবার বললেন, সে লাইনেই ছিল, লাইন ভেঙ্গে ঢুকেনি। আমি নিজের চোখে দেখেছি কিন্তু ভিড়ের মাঝে এই ছোট বিষয় নিয়ে নাটক করার চেষ্টা না করে ছেলেটির বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে তাকে বললাম,‘আমি দেখেছি তুমি লাইন ভেঙে ঢুকেছো! কেন এটা করলে?’
ছেলেটির মুখ মুহূর্তে অপমানে ম্লান হয়ে গেলো। তীব্র চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,‘ আমি করতে চাইনি। আমার মা আমাকে করিয়েছে। ’
আমি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে বললাম,‘এরপর থেকে মায়ে করাতে চাইলেও করবে না, ঠিক আছে?’
শিশুটি চোখের পানি আটকে রেখে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার ধারণা যখন একটি শিশু জন্ম নেয় তখন তারা অন্যায় করতে জানে না। অন্যায় করার মাঝে কোনো আনন্দ নেই, বাবা-মা কিংবা অভিভাবক যখন তাদের সন্তানের সামনে অন্যায় করেন, সন্তানকে অন্যায় কাজ করাতে শেখান তখন তারা সেটা করতে শেখে।
সুন্দর একটা মন ধীরে ধীরে দুষিত হয়ে যায়। আমাদের দেশের মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার কিছু কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা অভিভাবক এবং তাদের সন্তানদের এক জায়গায় নিয়ে আসেন। অভিভাববকদের খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা থাকে যখন পরীক্ষার্থীরা রাত জেগে ফাঁস করে আনা মেডিকেলের প্রশ্ন মুখস্থ করতে থাকে।
ছেলে-মেয়েরা জানে তাদের বাবা-মায়েরা কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে তাদেরকে ফাঁস করে আনা প্রশ্ন মুখস্থ করার সুযোগ দিয়েছে। সেটান নিয়ে তাদের বিবেক কোনো যন্ত্রণা দেয় কীনা আমার জানা নেই। টাকা দিয়ে তারা অনেক বড় অন্যায় করছে কিন্তু সেই বাবা-মা কীভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের চোখের দিকে তাকান আমি জানি না। আমার খুব জানার ইচ্ছে।
এরকম একটা মন খারাপ করা কুৎসিত বিষয় লিখতে আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি সেটা মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি কারণ প্রতিদিনই আমার অভিভাবকদের সাথে দেখা হয়। তারা গভীর ভালোবাসা দিয়ে তাদের সন্তানদের বড় করছেন। সন্তানের শখ পূরণ করার জন্য নিজের সময় দিচ্ছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ার উৎসবে বাবা মায়েরা কষ্ট করে তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসেন। গণিত, বিজ্ঞান পদার্থ বিজ্ঞান এ ধরনের অলিম্পিয়াডে যোগ দেওয়ার জন্যে সন্তানদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ছবি আঁকার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছেন। ছেলে মেয়েদের দেশকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন, মানুষকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন। আমি হত দরিদ্র অশিক্ষিত বাবা মা’দের দেখেছি যারা সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যে নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছেন। আমি জানি আমার হতাশ হবার কিছু নেই।
কিন্তু যখন দেখি একটা তরুণ শুকনো মুখে আমাকে বলে, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি বলে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার পরিচিত জগৎটি তখন এলোমেলো হয়ে যায়। যখন শুনি বাবা মায়ের প্রচণ্ড চাপে একটি মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে একটা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে আমি তখন আতঙ্কে শিউরে উঠি। আমার এ লেখাটি সেই ধরনের কোনো অভিভাবকের চোখে পড়বে কী না আমি জানি না। যদি পড়ে তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনাদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন আপনাদের সন্তানদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন না। তাদেরকে তাদের নিজেদের স্বপ্ন দেখতে দিন। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন।
তাদেরকে জোর করে একটা প্রতিযোগিতা থেকে আরেকটা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেবেন না। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করাতে বাধ্য করবেন না। তারা যে কাজটুকু করতে আনন্দ পায়, সেই কাজটুকু করতে দিন। আমাদের একটা মাত্র জীবন। সেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অংশটুকু হচ্ছে শৈশব। তাদের শৈশবটিকে বিষাক্ত করে দেবেন না। তাদেরকে একটা আনন্দময় শৈশব নিয়ে বড় হতে দিন। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে হবে না, সবকিছুতে পুরস্কার পেতে হবে না। তাদেরকে জীবন উপভোগ করতে হবে। তাদেরকে জীবনটাকে উপভোগ করতে দিন।
যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানকে অন্যায় কাজ করতে ঠেলে দিচ্ছেন তাদেরকে কী বলব আমি জানিনা। তারা কীভাবে তাদের সন্তানদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি এই গুরুতর অপরাধটি করো’। এরকম কোনো একজন অভিভাবক কী আমাকে ব্যাপারটা একবার বুঝিয়ে দেবেন?
অভিভাবকরা সন্তানদের ভালোবাসা দেবেন, তাদের জীবনে তারা কেন অভিশাপ হয়ে যাবেন?
বাংলাদেশ সময়: ০১১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৪