প্রেসক্লাবে গিয়ে আর কখনো দেখা পাব না সবার প্রিয় মূসাভাইকে। প্রেসক্লাব বললাম এই জন্য যে, রাতে ঘুমানোর জন্য বাড়ি যাওয়া ও টিভিতে তাঁর টক শো ছাড়া মূসাভাইকে বাকি সময়টা দেখা যেত প্রেসক্লাবেই।
এজন্য জাতীয় প্রেসক্লাবকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘প্রেসক্লাব আমাদের সেকেন্ড হোম’। এনিয়ে গানও বাঁধা হয়েছে। ক্লাবের অনেক সদস্য ক্লাবের উপর পুরো নির্ভরশীল। তারা সকালে নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুর-রাতের আহারটাও সেরে নেন প্রেসক্লাবে।
অর্থাৎ তারা তিন বেলাই প্রেসক্লাবে আহারটা সেরে নেন। তাই অনেককেই বলতে দেখি ক্লাবের নবীন-প্রবীন অনেক সদস্যের নাকি এ কারণে বিয়ে করার তাগিদ অনুভব করেননি।
সব সময় প্রেসক্লাবে দেখা পেলেও মূসাভাই ঠিক হয়ে এক জায়গা বসে থাকতেন না। খালি পায়চারি করে বেড়াতেন সর্বত্র। এই দেখলাম টিভিরুমে আড্ডার আসরে, নয়তো দোতলায় কার্ড রুমে। কদাচিৎ যেতেন ক্যান্টিনে। বেশিরভাগ সময় খেয়ে নিতেন ক্যান্টিনে। ভাত খেতে আমি কখনো দেখিনি। কাবাবসহ নানই তাঁকে বেশি খেতে দেখতাম। এরপর শুধু লিকার চা। এক সময় বেশ ডালপুরি খেতেন।
তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল বরফ হয়ে যাওয়া সফট পানীয়। কফি খুব পছন্দ করতেন। তবে কফি পান কেন ছেড়ে দিতে হয়েছিল তা পরের প্রসঙ্গে জানাব।
মূসাভাইর তুলনা শুধু মূসাভাইয়ের সঙ্গে করা চলে। সেখানে আর কাউকে দাঁড় করানো যাবে না। দেখা হলেই কুশল জেনে নিতেন। বলতেন খবর কী? কথা বলার ঢংটা ছিল সেই শিশুবেলায় গ্রামের দাদা বা অভিভাবকরা যেভাবে ডাক দিয়ে খোঁজ-খবর নিতেন। অবিকল সেই রকম ছিল। ঢাকায় এমন আদর কদাচিৎ দেখা মেলে।
তাঁর হৃদয়টা ছিল সাগরের মত বিশাল । আর মনটা ছিল আকাশের মত উদার। ২০০২ সালে মালিক-সম্পাদক দ্বন্দ্বের কারণে একটি দৈনিকে অনিয়মিত বেতন ব্যব¯’া হওয়ায় উপায় না দেখে ওই দৈনিকটি থেকে পদত্যাগ করি।
২০১০ সালে প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ মূসাভাইয়ের জন্মদিন উদযাপন করেছিল বেশ ঘটা করে। তাঁর আগেই তাঁকে আজীবন সদস্যপদ দিয়ে সম্মানিত করেছিল প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ। অধিকাংশ সদস্য সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কেক কেটে মিষ্টি-নিমকি খেয়ে সবাই হৈ-হুল্লোড় করেছিল। তবে মূসাভাইকে সেদিন খুবই আবেগপ্রবণ দেখা গিয়েছিল। আমরা অনেকেই মূসাভাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলাম। উনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছিলেন।
বছর দেড়েক আগে মূসাভাই আমাদের বাংলানিউজের অফিসে বেড়াতে এসেছিলেন। আলমগীর ভাইয়ের রুমে বসেছিলেন অনেকক্ষণ। বাংলাদেশের মিডিয়া জগৎ নিয়ে অনেক কথা আলোচনা করেছিলেন। মিডিয়ার বটবৃক্ষের কথা আমরা তন্ময় হয়ে শুনেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে আলমগীর ভাইকে মূসা ভাই বলেছিলেন শরীরের দিকে একটু খেয়াল রাখিস, রেস্ট নিস।
একদিন প্রেসক্লাবে মূসাভাই দেখে বললেন কি-রে তোর খবর কী? জানালাম আপাতত বেকার। তখুনি বললেন চল আমার সঙ্গে। নিয়ে গেলেন জনকণ্ঠের তোয়াব ভাইয়ের কাছে। এমনই ছিল তাঁর আমাদের প্রতি স্নেহ-ভালবাসা। সব সময় তাঁকে দেখতাম হাসি-খুশি। মনে পড়ে না বেজার মুখ দেখার।
একবার কলকাতায় যাবার পথে মূসাভাইয়ের সঙ্গে বেনাপোল সীমান্তে দেখা। বললেন, চেকআপ করতে ডাঃ শুভদত্তের কাছে যাচ্ছেন। আমাকে দিন ও সময় ধরে শুভদত্তের চেম্বারে যেতে বললেন। আমি কথা পালন করেছিলাম।
সম্ভবত ২০০২ সালের প্রথমার্ধের দিকে প্রেসক্লাবে মূসাভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বললেন কলকাতা যাবি? বললাম হ্যাঁ কযেকদিন পড়ে যাব। মূসাভাই বললেন, যাবার আগে আমাকে বলে যাবি। শুভদার কাছে টেস্টের কাগজপত্র পাঠাব।
আমি যাবার আগে মূসাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। মূসাভাই ব্লাড ও অন্যান্য টেস্টের কিছু কাগজ দিলেন ডাঃ শুভদত্তকে দেখানোর জন্য। বিড়লা হার্টফাউন্ডেশনে গিয়ে শুভদত্ত‘র সঙ্গে দেখা করলাম। টেস্টের কাগজপত্র দেখে বললেন, মূসাভাই কি এখনও সিগারেট টানেন।
বললাম হ্যাঁ দেখি তো কার্ডরুমে বসে টানছেন। আমাকে বললেন বারণ করবেন। বাইপাস হয়েছে এখন আর সিগারেট চলবে না। ঢাকায় এসে মূসাভাইকে শুভদার প্রেসক্রিপশনটা হাতে দিয়ে জানালাম বারণ করার কথা।
বছর খানেক পর মূসাভাইয়ের টেস্টের কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম দক্ষিণ কলকাতায় শুভদার চেম্বারে। শুভদা জানতে চাইলেন মূসাভাই কি বেশিমাত্রায় কফি পান করেন। জানালাম, হ্যাঁ চা নিতে দেখি না। প্রায় সময়ই কফি পান করেন।
শুভদা জানালেন, কফি বারণ করবেন। চা চলবে। তবে অনুমতি দিলাম ইচ্ছে করলে কফির বদলে প্রতিদিন এক পেগ হুইস্কি পান করতে পারেন। এর বেশি না।
মূসাভাইকে এ কথা বলার পর তিনিসহ আশপাশের সবাই তা নিয়ে সে কি হাসাহাসি। এরপর ঠাট্টা করে বললেন, না তোকে দিয়ে আর কাগজপত্র পাঠাব না সব নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এরপর আরও একবার ঢাকা থেকে টেস্ট করা কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। শুভদা দেখেশুনে বলেছিলেন হ্যাঁ মূসাভাইকে এ ভাবে মেনে চলতে বলবেন। এরপর কদাচিৎ কলকাতা গেলে শুভদাকে রিং দিই। উনি ঢাকার খোঁজ-খবর নেন। মূসা ভাইয়ের প্রসঙ্গও কিন্তু বাদ যায়না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৪