ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গণজাগরণ মঞ্চ: কাজ ফুরিয়ে পাজি

ড. জিনিয়া জাহিদ, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৪
গণজাগরণ মঞ্চ: কাজ ফুরিয়ে পাজি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ছবি)

যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার যথাযথ বিচার হয়নি, এই দাবি নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যখন গুটিকয়েক ব্লগার শাহবাগে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন, সেই ডাক আলোড়িত করেছিল সবাইকে। সেই ব্লগাররা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য কি না, তাদের জাত-পাত কি, কে কোন ধর্মের এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ।

কারণ, তাদের দাবির সঙ্গে সবার চাওয়া হুবহু মিলে গিয়েছিল। জন্ম হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের।
 
গণজাগরণ মঞ্চ যখন শুরু হয়েছিল, কোনো সন্দেহ নেই যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাতে স্বতস্ফূর্তভাবেই অংশগ্রহণ করেছিল।
 
কে না চায় একাত্তরের ঘাতক-দালালের উপযুক্ত শাস্তি হোক! আর তাইতো সদ্যজাত শিশুকে নিয়েও অনেক বাবা-মা যেমন গণজাগরণ মঞ্চে অবস্থান নিয়েছিলেন, অশীতিপর বৃদ্ধ, স্কুলের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে সব পেশার, সব বয়সের সবাই সেখানে গিয়ে দিনের পর দিন স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই গিয়েছিলেন শুধু সশরীরে সেখানে উপস্থিত থেকে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য।
 
রাজনৈতিক সমাবেশগুলোতে যেমন ট্রাকে করে দূরদূরান্ত থেকে কর্মী ভাড়া করে এনে বিশাল জমায়েত করা হয়, গণজাগরণের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। সবাই এসেছিলেন স্বতস্ফূর্তভাবে।

যে গণজাগরণ মঞ্চ সব রাজনৈতিক বিভেদের উর্ধ্বে গিয়ে সাধারণ জনগণকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে সক্ষম হয়েছিল, একসময় এই গণজাগরণ মঞ্চই বিদ্বেষ, রেষারেষি ও হিংসা ছড়ানোর মূল উত্সে পরিণত হতে থাকে।
gonojagaron_bg
অবশ্যই এর পেছনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চাল মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। রাজনৈতিক হীন স্বার্থের বলী করার জন্য আওয়ামী লীগ প্রথম গণজাগরণকে কাজে লাগায়।
 
ভুঁইফোড় হেফাজতে ইসলামের ডানায় ভর দিয়ে যখন খালেদা জিয়া সরকার পতনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন, তখন এই গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলামের সম্মেলন বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগ। হেফাজত মাথা তুলে আর দাঁড়াতে পারে নি। খালেদার বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার কারণে বিরোধীদলের আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে গণজাগরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার।     

দেশে আওয়ামী লিগ-বিএনপির মতই আস্তিক-নাস্তিক বলে দুটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। নাশকতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সর্বত্রই।

কে কোন দলের, কে কত আস্তিক, কে কত বড় নাস্তিক, ওখানে গেলে টাকা পয়সা পাওয়া যাবে কি না, ফ্রি বিরিয়ানির প্যাকেট পাওয়া যাবে কি না সে নিয়ে সাধারণের কেউ কখনই মাথা ঘামায় নি। অথচ, অরাজনৈতিক কার্যক্রমের গণজাগরণকে ক্রমেই রাজনৈতিক দলের লেবাসে দেখে যেভাবে উদ্দীপ্ত জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে এসেছিল, তেমনি চুপিসারেই ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে গিয়েছিল।

এছাড়াও গণজাগরণ মঞ্চের ভেতরে ক্রমেই আওয়ামী লীগের দলীয়করণের অস্তিত্ব এবং তাদের দলীয় কূট স্বার্থে যাতে ব্যবহৃত হতে না হয়, সে কারণেও শাহবাগে অনেকেই তাদের পদচারণা নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন। হঠাৎ করেই যেন শাহবাগ নিয়ে সব উত্সাহ মিইয়ে যেতে শুরু করে।  

যখন পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতাসীন দলটি গণজাগরণ মঞ্চকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অতি সুক্ষ ও ধূর্ততার সঙ্গে ব্যবহারের হীন চেষ্টা শুরু করেছিল, তখন অনেক সচেতন মানুষের মধ্যেই দুশ্চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করেছি আমরা। কিন্তু সেইসব মানুষকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশেষ "ট্যাগ" দিয়ে গণজাগরণ থেকে সরিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। গণজাগরণ নিয়ে মুখ খুললেই বিপদ। কোনো আলোচনা-সমালোচনা সব কিছুর ঊর্ধ্বেই যেন ছিল গণজাগরণ মঞ্চ।

এরই মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে পরিকল্পিতভাবেই অনেক রটনা রটেছে। গালাগালি, হাতাহাতি, মারামারি, এমনকি মামলা মোকদ্দমাও হয়েছে।

যে মুখপাত্র একদিন হিরো ছিলেন, সেই মুখপাত্রই নাকি এখন গণজাগরণের ভিলেন। তিনিই নাকি এখন চাঁদাবাজ, তিনিই নাকি চোর, তিনিই নাকি বাটপাড়! সত্যি কি বিচিত্র আমরা। যখন কাজ ছিল তাকে সব সময় সামনে এগিয়ে দিয়ে সব কাজের কাজী বানানো হয়েছিল, এখন কাজ শেষ, তিনি-ই হলেন নাকি মহা পাজি!

সুন্দরের কি করুণ ও অসুন্দর পরিসমাপ্তি! এখন আর চেতনা নিয়ে কেউ কথা বলছে না, এখন একে অপরের টাকা চুরি নিয়ে কথা বলছে। এখন আর কেউ অরাজনৈতিক গণজাগরণ মঞ্চের উদ্দেশ্য নিয়ে বলে না, এখন বলে কে কতটা রাজনৈতিক তা নিয়ে। এখন গণজাগরণ মঞ্চকে রাজনৈতিক মোড়কে পেঁচিয়ে নতুন দলে পরিণত করার স্বপ্নও দেখছেন সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ।  

সরকার সমর্থিত গণজাগরণ মঞ্চের ভবিষ্যত সরকার-ই নির্ধারণ করছে। যতদিন দরকার ছিল গণজাগরণ মঞ্চকে সরকার পুলিশ পাহারায় টিকিয়ে রেখেছিল। গণজাগরণের প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। দুধ-কলা দিয়ে পোষা গণজাগরণ যখন সরকারের বিরুদ্ধেই ফুঁসে ওঠার পাঁয়তারা করছে, তখন এর বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিতে আওয়ামী লীগ তার পেটোয়া ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে পুলিশ পাহারায় সরকারি পেটোয়া দল গণজাগরণ মঞ্চকে বিতর্কিত করে এর গতি রুদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছে।
Imran_01
আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সরকারের পোষা পেটোয়া বাহিনী যখন গণজাগরণ মঞ্চকে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর, তখন হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী এখন ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগকে তাদের পরম বন্ধু বলে ঘোষণা দিচ্ছে!

আওয়ামী লীগ এখন জামায়াতের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। জামায়াতও এখন যেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতে ব্যস্ত। ক্ষমতার স্বাদ নেয়া স্বৈরাচারী এরশাদ হেফাজতের সঙ্গে যেমন ছিলেন, তেমনি এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আছেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন রাজাকারী ও স্বৈরাচারী চেতনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। কোথাও কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই।


হায়রে রাজনীতি, আসলেই যেন নীতিহীনদের সীমাহীন দুর্নীতি। তাইত বহু কাজের কাজী গণজাগরণ এখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সব কাজ ফুরিয়ে হয়ে গিয়েছে মহা পাজী।

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।