পুরোনো দিনের সব দুঃখ, বেদনা ও গ্লানি কি বৈশাখ মুছে দিতে পারে না? পারে না কী ‘নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্তুপ বিগত বৎসর করি ভস্মসার’? নতুন বছরে পৃথিবীর ভিত্তি স্থাপন করতে? পারে না কী বিশাল বৈরাগ্যে আবরিয়া জরা, মৃত্যু, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লাখো কোটি নর-নারী হিয়া চিন্তায় বিকল’ বৈশাখ তার গেরুয়া বসন দিয়ে ঢেকে দিতে? বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই আবাহন করেছেন। রুদ্র বৈশাখের চণ্ড দাপটে সব অমঙ্গল দূর হোক।
এসবই সম্ভব যদি দেশে প্রচলিত থাকে সুশাসন এবং স্বশাসন। যে কোন সমাজে স্ব-শাসন হলো চূড়ান্ত লক্ষ। বাস্তবে কিন্তু দেখা যায় স্ব-শাসন সমাজে আসে সুশাসনের তীর ঘেঁষে। সুশাসনের লক্ষণ হলো মানবাধিকারকে ধর্মীয় আচারের মত অলঙ্ঘনীয় করে তোলা। ব্যক্তি প্রভাবের পরিবর্তে আইনের রাজত্ব সৃষ্টি করা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত হবার শতছিদ্র বন্ধ করা। ভয়-ভীতি বা অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে প্রশাসন পরিচালনা করা এবং সর্বোপরি শাসন-প্রশাসন যে ব্যক্তির জন্যে, ব্যক্তি যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং কোন ক্রমে ব্যক্তিস্বার্থ রাষ্ট্রের যুপকাষ্ঠে বলি হতে পারে না সমাজে এমন বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা।
সুশাসনের উপযুক্ত কর্ষণে সমাজ-ভূমি প্রস্তুত হলেই সেই মাঠে স্বশাসনের সোনালি ফসল ফলে। নববর্ষের প্রাক্কালে সমাজ জীবনের যেদিক তাকান না কেন, দেখা যাবে শুধু মরুভূমির কর্কশ বালি রাশি। মরুদ্যানের ছিটে ফোঁটা শ্যামলিমা চোখে পড়ে না কোনখানে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। নেই কিন্তু আইনের কার্যকরতা। নেই আইনের প্রতি আনুগত্য। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় পাওয়া যায় উন্নয়নে চারদিক প্লাবনকারী অগ্রগতির প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির যন্ত্রণায়।
শিল্পের অগ্রগতি, বাণিজ্যের প্রসার এবং বিনিয়োগের ঘোষণায় খবরের কাগজের পাতা ভরে ওঠে যদিও। কার্যত বাজার কিন্তু পরিপূর্ণ হয়েছে বিদেশী পণ্যে। অর্থনীতির সুস্থতার কথা শুনতে ভাল লাগলেও দেশের মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা জানে ওইসব কথায় কত বেদনাদায়ক পরিহাস লুকিয়ে রয়েছে। নীতি-নৈতিকহীনতায় সমাজে ছেড়ে গেছে, নইলে প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখি কেন. ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা এমন কী তাদের অভিভাবকরা কীভাবে হেনস্থা হচ্ছে। অনেকে এই আত্মগ্লানি ভুলতে আত্মহত্যা করছে। পথে ঘাটে চলাফেরা আজ নিরাপদ নয়। আনন্দদায়ক তো নয়ই। বাড়ীঘরেও নিরাপত্তার অভাব চারদিকে। হিংসা-আর প্রতিহিংসা ভয়ঙ্কর আকারে আবির্ভূত। দয়া-মায়া আজ নির্বাসিত সমগ্র সমাজ থেকে। সৌজন্যবোধ ও সহনশীলতা সমাজ থেকে নির্বাসিত। আপসকামিতা, যা গণতন্ত্রের মৌল সংস্কৃতি, আজ পথহারা। ব্যক্তি ও গণস্বার্থের স্থান দখল করেছে দলীয় স্বার্থ। সত্য কথনের দুঃখসময় বটে। সবাই আজ নেতা। জনতার দুর্দশা আকাশছোঁয়া। এমনি সময়ে সময়ে এবারে এসেছে বৈশাখ। মন্বন্তর সময়ের চোরাচালালি ও কালোবাজারির মত সমাজ বোরোধিদের লক্ষ করে ফররুখ আহমদ যা লিখেছিলেন আজ রাজনীতি ব্যবসায়ীদের জন্যে তার কবিতার কটা লাইন উদ্বৃত করতে চাই-
‘হে জঘন্য মানুষেরা। আজ মানুষের এই
অবশিষ্ঠ পচা লাশ উপহার নাও,
খাও তারে কুরে কুরে খাও।
আর খাও বিশীর্ণ ক্ষুধিত তরুণের
জীর্ণ শুল্ক শবে। ’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। কে পারে সমাজ সংসারে শুধরাতে? পারবে বৈশাখ এই স্তুপিকৃত আবর্জনাকে এক লহমায় উজাড় করে দিয়ে মানুষের জীবনে ক্ষণিকের জন্যে একটু শান্তি এনে দিতে। পারবে কী বৈশাখ এই ধ্বংসস্তূপকে ঝেটিয়ে বিদায় করে তারই উপর সুস্থ জীবনের সৌধ নির্মাণ করতে? না। রবীন্দ্রনাথের মতই ‘‘নিস্তব্ধ নির্বাক’ হবো ‘ভাঙিয়া মধ্যাহ্নতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে, চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে। ’’ বৈশাখ তবুও এসেছে। জমাট বাধাঁ অন্ধকার এবং নৈরাজ্যের মধ্যে এসেছে রুদ্র বৈশাখ।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়