বৈশাখের পহেলা দিনে নতুন একটা বাঁধাই খাতাতে যদি লিখতে শুরু করি জীবনের গল্প, তবে কি হালখাতা হলো? বদলে গেলাম আমি, পাল্টে গেলো জীবন, সমাজ এবং দেশটাও হাজির হবে নতুন দৃশ্যপট নিয়ে? প্রশ্নগুলো কাকে করবো, কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাচ্ছিনা। পথে জনজট।
তরুণবেলায় এসে তাগিদবোধ করতে থাকি-না এই হালখাতা কেবল বেনিয়ার অঙ্ক মেলাবার খাতা নয়। দিনটিও আসলে সেই ভাবনার কুঁড়িঘরে রেখা দেয়া যায়না। হালখাতা বলতে মানুষের মনোজগত, দৈনন্দিন অভ্যাস এবং প্রতিশ্রুতিরও। একক ভাবে একজন ব্যক্তির হালখাতার বিষয় নয় এটি। ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে বিষয়টিকে। উচ্ছাসের বিষয় হলো-গত এক দশকে ব্যক্তির সীমানা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্রের পর্যায় পর্যন্ত বাঙলা বর্ষবরণ উৎসবের সঙ্গে মেতে উঠার প্রণোদনা শুরু হয়েছে। সমাজের সকল শ্রেণির মধ্যে এই উৎসবে সামর্থ মতো যোগ দেয়ারও উদ্দীপণা লক্ষ্যনীয়।
পথে নেমে আসে সকল শ্রেনীর মানুষ। সবাই নিজের মতো করে সেজে পথটাকেও দেয় উৎসবের সাজ। রেওয়াজ তৈরি হয়েছে উপহার বিনিময়ের। কর্পোরেট থেকে শুরু করে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মধ্যে গত এক দশকে এই রেওয়াজটি অভ্যাসে রূপ নিয়েছে। উৎসবের চৌহদ্দি কেবল ঢাকাতেই যে রমনা বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়িয়ে উৎসব ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরায় পৌঁছে গেছে তা নয়। গ্রামে-গঞ্জে বিভাগীয় শহরেও উৎসবে দিগন্ত বেড়ে গেছে। বাঙলা বর্ষবরণ নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠার নকশাটি এক-দুই দশকে যে গাঢ় হলো, এর অনেকটাই বাচক হিসেবে ইতি। যদিও সংগত ভাবেই ধুলো-বালুর মতো কিছু ঢঙও যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। তবে ভরসা রাখি সেই ধূলো এক সময় উড়ে যাবে। নেতির দিকটি বাঙালীর সনাতন কালের বদঅভ্যাস। দিবস পেরিয়ে যেতেই তার প্রতিপাদ্যটাও বেমালুম ভুলে যাওয়া। সেই বদঅভ্যাসই বাঙালীকে একদিনের বাঙালীর রূপ দিয়েছে। ইলিশ-পান্তার সানকিতে এসে লুকিয়েছে বাঙালীয়ানা। বছর ধরে, যাপিত-জীবনে বাঙালীয়ানাকে ধারণ করতে উন্নাসিক বাঙালী।
সমাজ ও রাষ্ট্রে যে ক্রান্তিকাল চলছে- সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ব্যবস্থাপত্র হলো নিজেকে জীর্ণতা ও পুরাতন থেকে বের করে নিয়ে এসে নতুন করা। নতুন সময় ও ভাবনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা। সময়ের দাবি বলে যে একটি কথা আছে, তাকে আমলে নেয়া। এই ব্যবস্থাপত্রটি ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং রাষ্ট অবধি প্রযোজ্য। তবে এই প্রযোজ্য হবার কাজটি ব্যক্তি থেকেই শুরু করতে হবে। কারন পরের ধাপ গুলো ব্যক্তিরই পর্যায়ক্রমিক সমষ্টি। তারই অংশ হিসেবে হালখাতা বিষয়ে প্রচলিত ধারনাটি বদলে ফেলতে হবে। কোন বেনিয়ার আয়-ব্যয় হিসেব নয়, হালখাতা প্রত্যক ব্যক্তি মানুষের। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রর কাছ থেকে কি পেলাম, কতোটুকু শোধ হলো। এই হিসেব কষতে সাহসী হতে না পারলে, বাঙালীর বর্ষবরণের বাঙালীয়ানা পান্তা-ইলিশের সানকির তলানীতে রয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময় ২৩৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪