বাংলাদেশ নদীমাতৃক, সুন্দরবন তার চেয়েও বেশি। কোথাও ক্ষীণতন্বী নদীস্রোত যতো দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে, ততোই বিস্তৃত, ততোই প্রশান্ত, ততোই তরঙ্গবিক্ষুব্ধ ক্ষিপ্রগতি হয়ে উঠছে।
সুন্দরবন এক জাদুমাখা নাম। কোন আদিকালে গঙ্গা ও পদ্মার মোহনায় পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছিল আর দ্বীপগুলোতে সৃষ্টি হয়েছিল গভীর অরণ্য তা লেখাজোখা নেই। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কাদামাটির উপর বুকের পাঁজরের মতো শেকড় বেরিয়ে থাকা ম্যানগ্রোভ বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃক্ষরাজি। নিবিড় লতা গুল্ম-ঘাসের জঙ্গল। আর সবুজের উপর ফুটে আছে বিচিত্রবর্ণের ফুল আর ফুল। তার উপর উড়ছে-বসছে মৌমাছি, অরণ্যের ভয়ঙ্কর বাঘ, দাঁতাল শুকর, বিষধর সাপ। নদীর হাঙর, কুমির, কামট এবং হরিণ-বানর। সিন্ধু ঈগল থেকে ছোট্ট মাছরাঙ্গার মতো অনেক রকম স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি। নদী-খালে আরো আছে ভোঁদর, ডলফিন, মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া। আষাঢ়-শ্রাবণে শোনা যায় বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বরিশাল কামানের গর্জন। একে আবার দৈব শব্দ বা গায়েবি আওয়াজও বলে। ইংরেজরা বলতো, ‘বরিশাল গান্স’। আমি এর শব্দ গাম্ভীর্য ও শব্দ বৈভব উপভোগ করছি বহুবার।
অনেক পণ্ডিতের মতে, প্রাচীন ভারতবর্ষে তেরোটি মহাবন ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ছিল আঙ্গেরিয় বন। এর বিস্তৃতি ছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত। তারই আজকের অংশ আমাদের একমাত্র অরণ্য সুন্দরবন। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা ও সিলেটের অরণ্য এখন শুধু নামেই বেঁচেআছে। আবার প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে জানা যায় গঙ্গা নদীর তীরের লক্ষ্ণৌ শহরের কাছে সুন্দরবনীয় বৃক্ষের নমুনা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এক সময় সুন্দরবন সেখানে ছিল। গঙ্গা সেখান থেকে এক সময় আরো উত্তর দিকে প্রবাহিত হত। সেই সুন্দরবন এক শো বছর আগেও ছিল মেঘনা মোহনার পশ্চিম থেকে হুগলী নদীর পূর্ব দিক পর্যন্ত। পূর্ব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৬০ মাইল। উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ ছিল পশ্চিম দিকে ৭০ মাইল থেকে পূর্ব দিকে ৩০ মাইলের বেশি নয়। গড়ে বিস্তৃতি ৫০ মাইল হলে সুন্দরবনের আকার ৮০০০ বর্গমাইল। অর্থাৎ বরিশাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত। এই হিসাব এক শো বছর আগের। এখন বরিশাল-পটুয়াখালি-বরগুনার দক্ষিণে সুন্দরবন নেই। হরিণঘাটা নদী এখন সুন্দরবনের পূর্ব-সীমা। এখন বাংলাদেশ ও ভারত মিলে সুন্দরবনের আয়তন ধরা হয় ১০ হাজার বর্গ কি.মি.। তার মধ্যে বাংলাদেশে ছয় হাজার বর্গ কি.মি. আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চার হাজার বর্গ কি.মি.। আজ থেকে ১২০-২৫ বছর আগে সুন্দরবন ছিল যথার্থ অর্থে অরণ্য। এখন অরণ্যের কঙ্কাল, গলিত লাশ। সেই সময় ইংরেজদের নজরে আসে সুন্দরবন।
ইংরেজরা বুঝতে পারে এই অরণ্যবহুল দ্বীপের ঘন গাছপালা কেটে সাফ করতে পারলে চাষের জমি বাড়বে, ভূমি রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে। এই লোভে তারা সুন্দরবনের দ্বীপগুলো ইজারা দিতে শুরু করে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ধনীরাও এসে ইজারা নিতে থাকায় লোভের থাবা পড়ে অরণ্যে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ফলে এই কাণ্ড ঘটেছিল। বিশ্বপ্রকৃতি বা পরিবেশের উপর মানবের মারাত্মক আঘাত বা আধিপত্য বিস্তারের অশুভ পদক্ষেপ পড়তে শুরু করে। মানুষ তখন এর ভয়াবহ পরিণামের মাত্রা বুঝতে পারেনি।
সুন্দরবনের অরণ্যে হিংস্র পশু ও পানির প্রাণীর সঙ্গে অসুরিক লড়াই চালিয়ে জঙ্গল সাফ করে ফসল উৎপাদন শুরু করে মানুষ। মানুষের সেই ঢেউয়ে আজ বরিশাল, পটুয়াখালি, বরগুনার অরণ্য লুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গে অরণ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে মানববসতি গড়ে উঠল ৫৪টি দ্বীপে। সেখানে ৪০ লক্ষ লোকের বাসভূমি, সেখানে অরণ্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু বাকি অংশ বলতে গেলে নিবিড় সুন্দরবনীয় অরণ্য। বাংলাদেশে সে রকম নিবিড় অরণ্যেও মানুষের থাবা পড়েছে পরিকল্পনা ও তদারকির অভাবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো সুন্দরবনের ভেতর জনবসতির অনুমোদন বাংলাদেশ দেয়নি, তাই রক্ষা সুন্দরবন। কিন্তু অন্যভাবে সুন্দরবনের পশ্চিম অংশ অর্থাৎ বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনায় সুন্দরবন সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু তা বলবো কেন, সুন্দরবন এক সময় তারও পূর্বে— ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ হয়ে চকোরিয়া-বাঁশখালী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আজও সেখানে নতুন করে সুন্দরবনীয় প্যারাবন সৃষ্টির উদ্যোগ চলছে থেমে থেমে। জুলাই মাসের প্রথম দিকে একদল জাপানি ছাত্রছাত্রী সেখানে গাছ রুয়ে গেছে। আর সুন্দরবন যখন লক্ষ্ণৌ থেকে উত্তরবঙ্গ ও আসাম পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল হাজার বছর আগে, তখনও সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বসত করতো। সুন্দরবন সেই থেকে গঙ্গা-পদ্মার মোহনার সঙ্গে ক্রমশ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ১৬ কোটি মানুষের চাপে কোথায় গিয়ে থামে কে জানে। যদি সুন্দরবন অত্যাচারে অত্যাচারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তার অচিন্তনীয় কুফল বইতে হবে ১৬ কোটি মানুষ এবং তার বংশধরদের। সেই সঙ্গে বিশ্ববাসীদেরও।
সুন্দরবনের মূল্য টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সুন্দরবন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে প্রথম বিপর্যয় দেখা দেবে আবহাওয়ায়, বৃষ্টিপাতে। দ্বিতীয় বিপর্যয় আইলা বা এরকম সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণবঙ্গ তছনছ হয়ে যাবে। জীববৈচিত্রে চরম সঙ্কট সৃষ্টি হবে। তার মধ্যে পাখি, জীবজন্তু, মৎস্যসম্পদ থেকে কীটপতঙ্গ কিছুই বাদ পড়বে না। অর্থাৎ সুন্দরবনের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সব সম্পদ তার সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গেও ওতপ্রোত জড়িত।
একজন ইংরেজ ১৯২৯ সালে বন-অরণ্যে, বাদাবনে, নদীতে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবন নিয়ে তৈরি করেছিলেন মানচিত্র। প্রকৃতি, পরিবেশ, বনজসম্পদ আর অরণ্যচারী প্রাণীদের নানা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এখন সেগুলোই আমাদের ও সরকারের সম্বল। সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমাদের জ্ঞান, রাষ্ট্রের কাজকর্ম। পরিকল্পক বিশেষজ্ঞরা হয়তো ভাবতেই ভুলে যান সে প্রায় একশত বছরে সুন্দরবনের কত পরিববর্তন হয়ে গেছে। জলবায়ুরও বদল হয়েছে। গঙ্গা-পদ্মার নাব্যতা কমে গেছে। তার উপর সুন্দরবনের উপর পড়েছে জনসংখ্যার চাপ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর লোলুপ দৃষ্টি, রাজনৈতিক খেলা ও বহির্দেশের কলকাঠি নাড়া। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ডলফিন বা শুশুক, ঘড়িয়াল, কুমির, কচ্ছপ, কাঁকড়া লুপ্ত হয়ে গেলে অন্যদের কিছুই আসে যায় না। আমাদের আসে-যায়। এমনকী সুন্দরবন আমাদের গৌরব, সম্মান এবং অহংকারও। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরের জন্য রেখে যেতে পারার মতো প্রাকৃতিক অরণ্য, তরল সোনা তেল-গ্যাসের ভান্ডার। এজন্যও সুন্দরবনের উপর আমার এত নজর, বিদেশীদের নজর কেন তা তো জানেনই।
সবার আগে দরকার সুন্দরবনের সমীক্ষা। দ্বীপ-বদ্বীপ ঘিরে থাকা নদী-খালের সঠিক মানচিত্র। অরণ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, বন্যপ্রাণী ও অরন্যের উপর নির্ভরশীল মানুষদের প্রকৃত তথ্য। তার উপর ভিত্তি করেই তো উন্নতি বা উন্নয়ন পরিকল্পনা। প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র মানুষকে অবহেলা করে কোনো কিছুতেই তিলোত্তমা করা যায় না। সম্পন্ন মানুষ সব সময় এদের পরোক্ষে বর্জন করে চলে। সুন্দরবনের সম্পদ লুঠ ও ভাগাভাগি করে ক্ষমতাধর বনকর্তা ও রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় নিয়োজিত পঙ্গপালেরা।
২০০১ সালে সুন্দরবনে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানের প্রতিবাদে ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ শ্লোগান সামনে রেখে ৩ দিনব্যাপী জাতীয় সুন্দরবন মেলা খুলনা নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়। ৮৪টি সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই বিশাল আয়োজনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা দিয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
সম্মেলনের সমাপনীতে ১৮টি সুপারিশমালা নিয়ে ‘খুলনা ঘোষণা’ দেওয়া হয়। সুপারিশসমূহে ৩ নম্বরটি ছিল সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করে তেল-গ্যাস আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান উদ্যোগ বন্ধ করা। ‘আমাদের উদ্বেগের বিষয় তখন সুন্দরবনে গ্যাস অনুসন্ধান। সারা বাংলাদেশ এমনকী বঙ্গোপসাগরে যদি গ্যাস থাকে এবং প্রাথমিক অনুসন্ধান করা হয়ে গেছে বা হওয়ার পথে, তখন সুন্দরবনকে কি আমরা আপাতত বাদ রাখতে পারি না? কারণ বাংলাদেশের নিবিড় বন ও বনসম্পদ বলতে এখন সুন্দরবনকেই বুঝি। আমাদের একমাত্র স্বপ্ন-অরণ্যকে রক্ষা করতে পারি না? [নিপীড়িত নিসর্গ ও লাঞ্চিত বাংলাদেশ: বিপ্রদাশ বড়ুয়া। প্রকাশক: পার্ল পাবলিকেশ। পৃ. ১১৩]
সুন্দরবনের উপর সাম্প্রতিক মরণ-ফাঁস বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি। চুক্তিটি সর্বনাশা নয়, সুন্দরবনের কোলে বাগেরহাটের রামপালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান নির্বাচন হল সর্বনাশা। ২৯ শে জানুয়ারি ২০১২ সালে এই চুক্তি হয় ঢাকায়। উভয় দেশের সমান অংশীদারত্বের শর্তে যৌথ উদ্যোগে এই কেন্দ্রটি গড়ার চুক্তিতে সায় দিয়েছে। এই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে কয়লা দিয়ে, স্বাভাবিকভাবেই ভারত থেকে আমদানি করা কয়লায়। আবার দেশের মাটির নিচে যদি কয়লা থাকে তা চাইলেই তোলা যাবে না। বড়পুকুরিয়ার কয়লার সমস্যার কথা আমরা জানি। যে কয়লা অনেক নিচে, তা তুলে আনার প্রযুক্তিগত সমস্যা যেমন রয়েছে, যে কয়লা রয়েছে অরণ্যে বা জনপদের নিচে, তা কেমন করে তোলা হবে, প্রশ্ন ও সমস্যা সেটাও। বিদেশি কয়লা বা জলবিদ্যুৎ পরমাণু কোনোটাই সমাধান নয়। তার উপর স্থান নির্বাচন। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পে যে পরিমাণ দূষণ ছড়ায় তার ভার কোনো মতে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক বন সুন্দরবনের উপর দেওয়া যায় না। এমনিতেই সুন্দরবন নানা প্রতিকূল পরিবেশের চাপে ধ্বংসের বিরুদ্ধে অসহায় লড়াই করে যাচ্ছে। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হবে তার উপর শেষ নির্মম আঘাত। এই আঘাত সহ্য করার মতো শক্তি সুন্দরবনের আছে বলে আমার যুক্তি ও মন সায় দেয় না।
সুন্দরবন আমাদের শেষ আশ্রয় প্রকৃতিভাণ্ডার। এরকম অরণ্য সৃষ্টি করা যায় না। এরকম অরণ্য সৃষ্টি হয় লক্ষ বছরে। এর স্রষ্টা প্রকৃতি। মানুষ গর্জন, চাপালিশ, চাঁপা, সেগুন বা নিমের বন সৃষ্টি করতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে রকম বন এক সময় ছিল, এখন সে রকম নিবিড় বন আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এখন সেখানে একশত বছরের প্রাচীন গাছের দেখা পাওয়া যায় না; অন্তত আমি দেখিনি। মধুপুর-ভাওয়ালের গজারি বনও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে।
সুন্দরবন ধ্বংসের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও দায়ী। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের ২৯শ বর্ষে এক অপরাহ্নে সমুদ্রের জল বৃদ্ধি পায়। ক্রমাগত ৫ ঘন্টা ভয়ঙ্কর ঝড়বৃষ্টি ও বজ্রাঘাত হয়েছিল। উত্তাল তরঙ্গে ঘরবাড়ি, নৌকা, জাহাজ ভেঙে যায় এবং প্রায় দু’ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়। পরবর্তী ভীষণ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয় ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এতে সাগরদ্বীপে ৬০ হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। প্রতাপাদিত্যকে সাগরদ্বীপের শেষ রাজা বলা হয়ে থাকে। প্রতাপের পরে সুন্দরবনের একটি অবনমন হয়েছিল। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর যে সব মানুষ বেঁচে ছিল তারা প্রায় সবাই উত্তর মুখে পালিয়ে গিয়েছিল। ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক ঝড় হয়। এতে ইংরেজদের কোলকাতা বা হুগলির বহু কারখানার প্রচুর ক্ষতি হয়। এই ঝড়ের পর সুন্দরবন সম্পূর্ণরূপে মানুষের আবাসশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে, ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর একের পর এক সামুদ্রিক ঝড় বয়ে যায়। শেষবারের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মানুষ ও জীবজন্তুর মৃত্যু ছাড়াও সুন্দরবনের পূর্বভাগ বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ে। এভাবে সুন্দরবন ও সন্নিহিত জেলাগুলো সব সময় বঙ্গোপসাগরের ঝড় ও প্লাবনের অত্যাচার সহ্য করে। ১৯০৯ সালের ১৭ই অক্টোবর (বা ১৩১৬ বাংলার ৩০শে আশ্বিন) একটি ঘূর্ণিঝড় খুলনা অঞ্চলকে তছনছ করে দেয়। একে ইতিহাসে আশ্বিনের সর্বনাশা ঝড় বলে। এ সময় সুন্দরবনের প্রাচীন সব গাছ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলা হয়। এছাড়া ভূমিকম্প, মগ ও ফিরিঙ্গিদের অমানুষিক অত্যাচারও সুন্দরবন ধ্বংসের কারণ। আর সে সময় সুন্দরবনে মানববসতি ছিল বলে ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বইতে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
কিন্তু প্রকৃতির ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, আইলাতে ধ্বংস হওয়া সুন্দরবনের ক্ষতি প্রকৃতির নিয়মে আবার পূরণ হয়। কিন্তু আজকের যুগের মানুষের অত্যাচার, কলকারখানা স্থাপন, মাটির নিচের খনিজ সম্পদ আহরণের অত্যাচার পূরন হওয়ার নয়।
সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ জরিপ। এতে পাওয়া যাবে তার সঠিক পরিস্থিতি। সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে রক্ষা করার কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণীত হওয়া সম্ভব ও উচিত। সুন্দরবনে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অনেক ডুবোচর জন্ম নিচ্ছে। নদী-খাল নালা পলিতে ভরে গেছে। সাগরের মৎস্য সম্পদ এসব কারণে দিগভ্রান্ত হয়ে সরে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে ইলিশ তাদের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাচ্ছে নতুন জায়গায়। সুন্দরবন নিঠুর নিদয়া হয়ে যাবে মানুষের অত্যাচারে। প্রকৃতিক অত্যাচার প্রকৃতির অংশভাগী সুন্দরবন হজম করতে জানে। মানুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার কৌশল তার জানা নেই। এই সত্য অমোচনীয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নিসর্গপ্রেমী
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৪