সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চাং হং-উন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১৬ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার উপকূলে কয়েকশ’ যাত্রী নিয়ে একটি ফেরি ডুবে গিয়েছিল।
ঘটনার প্রায় দু'সপ্তাহের মধ্যে ফেরিডুবি প্রতিরোধ ও নিখোঁজদের উদ্ধারে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে চাং হং-উন প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন। দেশের এই অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার দায়ভার তো সরকারপ্রধানের উপরই বর্তায়। সেক্ষেত্রে তাঁর তো পদত্যাগ করাই উচিত।
কাজেই, তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমরা মোটেও বিস্মিত হই না। বরং মনে হয় এটাই তো হবার কথা, এটাই তো কাম্য।
অথচ দেখুন, আমাদের দেশে বছর বছর লঞ্চ বা ফেরি ডুবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। প্রধানমন্ত্রী তো দূরে থাক, নৌমন্ত্রী, তাঁর প্রতি কিংবা উপ কোনো মন্ত্রী-ই এর দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করার কথা ভাবেন না। মন্ত্রণালয় তো দূরে থাক, এলাকার এম.পি, চেয়ারম্যান এমনকি কমিশনার পর্যন্ত প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে এরকম দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেই মর্মে কোনো বিবৃতি দেন না। তাদের কাছে যেন ঈদের আগে-পিছে বা ভরা বর্ষায় লঞ্চ ডুবে শত শত মানুষ মারা যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। বরং কোনো বছর লঞ্চ না ডুবে গেলেই যেন তা হয় অস্বাভাবিক-অভূতপূর্ব কোনো ঘটনা!
প্রতি বছরই কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন বা মাধবকুণ্ডের পর্যটন এলাকায় কারো না কারো ডুবে মারা যাবার খবর সংবাদ শিরোনাম হয়। এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কোনো ধরনের উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করিনি। এই যে দেখুন, সেন্টমার্টিনে ডুবে তলিয়ে গেলেন ৪টি তাজা প্রাণ। অথচ এর দায়ভার নিয়ে আমরা পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদত্যাগ তো দূরে থাক, কাউকে দুঃখপ্রকাশও করতে দেখিনা। যেন সমুদ্র স্নানে প্রতিবছর কেউ না কেউ ডুবে মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে যখন খেলা বন্ধ থাকলো, তখনও এর দায়ভার নিয়ে আমরা কাউকে দুঃখপ্রকাশ করতে দেখিনি, পদত্যাগ তো দিবাস্বপ্ন।
প্রতি বছর পাঠ্য বইয়ে ভুল, পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের হানাহানির কারণে ছাত্রদের মৃত্যু- এসবের দায়ভার নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী তো দূরে থাক, শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি কাউকেই ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে দেখি না।
শেয়ার বাজারে যখন শত শত খেটে খাওয়া মানুষ পথে বসে, হলমার্ক কেলেংকারীসহ প্রকাশ্যে জালিয়াতি-দুর্নীতিতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো লিপ্ত, তখনও আমাদের অর্থমন্ত্রী আসল-নকল(?) মিলিয়ে ৩২ পাটি দন্ত বিকশিত করে হাসি দেন। রাবিশ, বোগাস জাতীয় শব্দ তাঁর ডিকশনারিতে স্থান পেলেও ক্ষমা ও পদত্যাগ নামক শব্দদ্বয়ের সঙ্গে তাঁর কোন রকম পরিচয়-ই নেই!
তাজরিনে যখন আগুনে পুড়ে কয়লা হলো শত শত নরম মাংসপিণ্ড, তখনও এর দায়ভার নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাউকে পদত্যাগ করতে দেখিনি।
রানা প্লাজায় রানা নামের একজন নরপিশাচের লোভের পাহাড়ে চাপা পড়ে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল শত শত মুখ। সারাজীবন শারীরিক-মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে বেঁচে রইলেন হাজার হাজার শ্রমিক। অথচ প্রশাসনের নাকের ডগায় এরকম একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ব্যবসা চালিয়ে যাবার অনুমতি দেবার কারণে কোনো মন্ত্রণালয়ের কাউকেই আমরা দায়ভার স্বীকার করে পদত্যাগ করতে দেখিনি।
ক্ষমতাসীন দলের অংশ হয়ে রানা যখন এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী হন, তখন দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরি পোশাকশিল্প খাতকে নিরাপত্তা না দেবার দায়ে প্রধানমন্ত্রীও সমান দায়ী ছিলেন।
প্রায় পাঁচশত লোকের জীবনশংকার জন্য যদি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারেন, তবে রানা প্লাজায় হাজারের উপর মৃত্যু ও নিখোঁজের দায়ভার নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ নয় কেন?
আমরা দায়িত্বে থেকেও দায়িত্ব অবহেলার জন্য পদত্যাগ করি না। বরং সব জায়গায় বিরোধীদলের ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজি। লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করি। তদন্তের কি রিপোর্ট, কে দায়ী কিছুই কখনো জানা হয় না। কাউকেই শাস্তি পেতে আমরা দেখিনা। অপরাধীর শাস্তি হয় না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কেউ দায়ভার নেন না, তাই একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি দেখি আমরা দু’দিন পর পরই।
উন্নত দেশে দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র গাফিলতি হলেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান সাধারণত পদত্যাগ করে থাকেন। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বা প্রবল সমালোচনার মুখে হলেও পদত্যাগ সংস্কৃতি বেশিরভাগ উন্নত দেশেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
অথচ আমরা পদত্যাগ করতে জানি না। প্রকাশ্য অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে আমরা নির্লজ্জভাবে আকাশ-কুসুম যুক্তি উপস্থাপন করে হাস্যরসের খোরাক হই। একটি বড় কোনো দুর্ঘটনা অন্য একটি সাজানো নাটক দিয়ে দ্রুত জনগণের মন থেকে মুছে ফেলার ব্যবস্থা করি। আমরা আম-জনতাও এখন ক্রমশই অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছি।
রাজনৈতিকদের কেউ হাঁচি দিলেও দেশের চিকিত্সা ব্যবস্থার বুকে লাথি মেরে আমেরিকা, লন্ডন বা সিঙ্গাপুরে চিকিত্সা নিতে দেখি। দেশের প্রায় সব রাজনীতিকের সন্তানকে বিদেশে পড়াশুনা করতে দেখি। দেশের শান্তির জন্য কোনো রাজনীতিকের সন্তানকে মাঠে দেখিনা। দেশপ্রেমের বড় বড় বুলি কপচানো রাজনীতিকদের সন্তানকে দেখি বিদেশের মাটিতে, তাদের দেখি ফেসবুকে। মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা বয়ান দিয়ে দেশের মানুষের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডে কাউকে দেখিনা।
দেশের মাথাগুলোকে আমরা জনগণের জন্য কোনো কিছুই ত্যাগ করতে দেখিনা। তবে তারা ত্যাগ যে একেবারেই করেন না, তা নয়। তারা অবস্থা বুঝে দেশ ত্যাগ করেন। তারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে ত্যাগ করেন। নিজেদের সন্তানকে ইউরোপ-আমেরিকায় পড়াশুনার নামে ত্যাগ করেন। আবার রাজনৈতিক চাপে এরশাদের মত স্ত্রী ত্যাগের নজিরও আছে।
আমরা তাই শিক্ষা নিই, দোষ করেও দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করে কোনো সুখ নেই। জনগণের জন্য ক্ষমতায় এলেও জনগণের সুখের জন্য কোনো ত্যাগ নয়। রাজনীতিকদের ত্যাগ শুধুই নিজের জন্য। কারণ এই ত্যাগের ওপর নাম-ই হলো ভোগ। আর আমাদের ক্ষমতাসীন তথা সব রাজনীতিকের ভোগেই আছে সর্বসুখ।
ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৪