আইন অনুযায়ী বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহার নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশু অধিকার রক্ষা করবে।
এই সনদের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার শিশুদের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশু নিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। এ তালিকার চতুর্থ নম্বরেই রয়েছে বিড়ি ও সিগারেট কারখানার কাজ। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন নং ১৮২ অনুসমর্থন করেছে। শিশু অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত এসব বিধি-বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিড়ি কারখানার মালিকরা ঝুঁকিপূর্ণ তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিড়ি উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে শিশুশ্রম ব্যবহার করছে।
একটি বেসরকারি গবেষণা মতে, দেশে মোট বিড়ি কারখানার সংখ্যা ১১৭টি। এসব কারখানায় তালিকাভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ৬৫ হাজার। কারখানাগুলোতে মাসিক ও বাৎসরিক মোট উৎপাদন যথাক্রমে ৪০৫ ও ৪,৮৬২ কোটি শলাকা।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট বিড়ি কারখানার সংখ্যা ১৯৫টি এবং এ খাতে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ৭৫ হাজার। যদিও কারখানার মালিকরা তাদের নিয়োগকৃত গবেষক, লবিস্ট ও ফ্রন্ট গ্রুপের মাধ্যমে এ খাতে ২৫ লক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত আছে বলে দীর্ঘদিন ধরে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। তবে তথাকথিত এসব গবেষক ও শ্রমিক হিতৈষীরা বিড়ি কারখানায় নিয়োজিত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বলতে নারাজ! অথচ বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট, মিডিয়ায় প্রচারিত খবরাখবর এবং প্রজ্ঞার টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ওয়াচবিডি টিমের সদস্যদের সরেজমিন বিড়ি কারখানা পরিদর্শন প্রভৃতি থেকে উঠে এসেছে বিড়ি কারখানায় শিশুশ্রম ব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র।
এসব তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, বিড়ি উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নিয়োজিত অধিকাংশ শিশুর বয়স ৪ থেকে ১২ বছর। হারাগাছ বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এবং কারখানার শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে হারাগাছে প্রায় ৩৫টি (যা দেশের মোট বিড়ি কারখানার প্রায় ৩০%) বিড়ি কারখানা চালু রয়েছে এবং এসব বিড়ি কারখানায় কর্মরত মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। ওই ৪০ হাজার শ্রমিকের ২০ হাজারই (৫০%) শিশু। বাকী ২০ হাজারের মধ্যে ১২ হাজার (৩০%) নারী এবং ৮ হাজার (২০%) পুরুষ।
শিশুশ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার নিয়মিত অথবা অনিয়মিতভাবে স্কুলে যায়, বাকিরা কখনই স্কুলে যায় না। কোমলমতি এসব শিশু জানেই না প্রতিনিয়ত তারা কি পরিমাণ স্বাস্থ্যঝুঁকি বহন করছে অথবা এ শ্রম তাদের কোন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
স্থানীয়দের মতে, বিড়ি কারখানায় কাজ করা ছেলে-মেয়ে লেখাপড়ায় বেশিদূর যেতে পারে না। পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়েই অধিকাংশের পাট চুকাতে হয়।
একইভাবে লালমনিরহাট জেলার সাংবাদিক এবং বিড়ি শ্রমিকদের সাথে আলাপে জানা গেছে, এ জেলার ৯টি বিড়ি কারখানায় (যা দেশের মোট বিড়ি কারখানার প্রায় ৭.৭%) প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে, যাদের প্রায় ৭০ শতাংশই (১৪,৭০০) শিশু। বিড়ি তৈরির বিভিন্ন ধাপে নিয়োজিত এসব শিশুর বয়স ৪-১৪ বছরের মধ্যে।
সরেজমিনে এলাকার বেশ কয়েকটি বিড়ি কারখানা ঘুরে শিশুশ্রম ব্যবহারের এ সত্যতা মেলে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, শ্রমিকদের ৬০-৭০ ভাগই শিশু। অন্যদিকে গৃহস্থালি পর্যায়ে বিড়ির খালি ঠোস বা শলাকা তৈরিতে যুক্ত শিশু শ্রমিকদের চিত্র আরও ভয়াবহ, এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ শ্রমিকই শিশু।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, শিশুরা সাধারণত বিড়ি তৈরির ৪টি ধাপ যথাঃ (১) বিড়ির খালি ঠোস তৈরি (২), খালি ঠোসে গুঁড়া তামাক ভরা (৩), তামাক ভরা ঠোসের মাথা মোড়ানো এবং (৪) বিড়ির প্যাকেট তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব কাজের মধ্যে ঠোস তৈরির কাজ গৃহস্থালি পর্যায়ে এবং বাদবাকি কাজ কারখানাতে সম্পন্ন হয়। সাধারণভাবে শিশুরা সকাল ৯টা থেকে দুপর ১২টা পর্যন্ত বিড়ি কারখানার কাজ এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত বাড়িতে ঠোস তৈরির কাজ করে থাকে। বাড়িতে তৈরি বিড়ির ঠোস কারখানায় নিয়ে তামাক ভরা এবং মাথা মোড়ানোর কাজ শেষ করে প্যাকেটজাত করা হয়।
প্যাকেট তৈরির কাজ সাধারণত বয়স্করা করে, তবে শিশুরাও একাজ করে থাকে। শিশু শ্রমিকদের মজুরি প্রাপ্তির পরিমাণও খুবই নগণ্য। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত টানা কাজ করলে একজন শিশুশ্রমিক গড়ে সাড়ে চার হাজার ঠোস তৈরি করতে পারে। প্রতি হাজার ঠোস তৈরির মজুরি গড়ে ৭.৫০ টাকা।
একইভাবে কারখানায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একজন শিশু গড়ে ৫ হাজার বিড়ির মুখ মোড়ানোর কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রেও প্রতি হাজারে গড় মজুরি ৭.৫০ টাকার বেশি নয়। অর্থাৎ দিনে একজন শিশুশ্রমিকের গড় মজুরি প্রায় ৩৫ টাকা।
স্থানীয়দের মতে, বেশিরভাগ কারখানায় মাসে গড়ে ১২ দিন কাজ থাকে। সে হিসেবে একজন শিশুশ্রমিকের মজুরি বাবদ গড় মাসিক আয় মাত্র ৪২০ টাকা। দৈনিক হিসাবে এই আয় মাত্র ১৪ টাকা।
স্থানীয়দের মতে, শিশুরা বিড়ি তৈরির কাজে একবার জড়িয়ে পড়লে সহজে বের হতে পারে না। অধিকন্তু বেশিরভাগ শিশুই তামাক সেবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। বছরের পর বছর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করা, তামাক সেবন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাবে বেশিরভাগ শিশুই মারাত্মকভাবে অপুষ্টির শিকার হয়। জীবন চলার শুরুতেই কোমলমতি এসব শিশুর শরীরে বাসা বাঁধে নানারকম অসুখ-বিসুখ।
শিশু শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, তারা খুব ঘনঘন জরে আক্রান্ত হয় এবং সর্দি-কাশি প্রায় নিয়মিতই লেগে থাকে। কিছুদিন পর পরই মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, পেট ব্যথা, হাত-পা ব্যথা ও পাতলা পায়খানা প্রভৃতি অসুখে আক্রান্ত হয় তারা। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ব্রঙ্কাইটিস ও এজমা রোগে আক্রান্ত অনেক শিশু বিড়ি কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
হারাগাছ ৩১ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের সাথে আলাপ করে উপরোক্ত বিষয়ের সত্যতা পাওয়া গেছে।
মেডিকেল অফিসারের তথ্যমতে, হাসপাতালে যে সংখ্যক রোগী আসে তার অর্ধেকই এজমা আক্রান্ত, বাদবাকিরা ঠাণ্ডা-কাশি, জর ও অপুষ্টিজনিত অসুখসহ নানাবিধ অসুখে আক্রান্ত।
তার মতে, এজমা রোগীদের বেশির ভাগই বিড়ি কারখানায় কাজ করে। রোগীদের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নারী, ১০ ভাগ শিশু এবং ১০ ভাগ পুরুষ। শিশু ও পুরুষ রোগীদের প্রায় সবাই ধূমপান করে।
শিশুদের অভিভাবকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এধরনের অসুখে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ ক্রয় করে শিশুদেরকে খাওয়ান। মাসে গড়ে চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় ৩০-৪০ টাকা। আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় চিকিৎসা বাবদ খরচ হওয়া এই সামান্য ক’টি টাকাও শিশু শ্রমিকদের খানার উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে।
শিশুশ্রমিক খানাগুলির আয়-রোজগারের চিত্র খুবই ভয়াবহ এবং অমানবিক। শ্রম বিক্রিই তাদের আয়-রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। আবাদি জমিজমা, গবাদিপশু এমনকি বসতভিটাও নেই অনেক খানার। বেশিরভাগ খানা প্রধানই বিড়ি শিল্পের কাজে যুক্ত, কোন কোন খানা প্রধান কৃষি/পরিবহণ শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত। বিড়ি শিল্পে জড়িত শিশুশ্রমিক খানাগুলির মাসিক গড় আয় প্রায় ৩০০০ টাকা। ৫/৬ সদস্য বিশিষ্ট এসব খানার পক্ষে এই সামান্য টাকায় মাস পার করা রীতিমত অসাধ্য সাধন করার মতো। খানাভিত্তিক আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০ এর তথ্যানুযায়ী ২০১০ সালে একটি ভূমিহীন খানার মাসিক গড় আয় ছিল ১১৪৭৯ টাকা, ২০০৫, ২০০০ ও ১৯৯৫/৯৬ সালে এটা ছিল যথাক্রমে ৭২০৩, ৫৮৪২ ও ৪৩৬৬ টাকা । অর্থাৎ দেড় যুগ আগে একটি ভূমিহীন খানার গড় আয় যে পরিমাণ (৪৩৬৬ টাকা) ছিল তার চেয়েও অনেক কম বর্তমান বিড়ি শ্রমিকদের খানার গড় আয়।
বিগত কয়েক দশকে প্রায় সবধরনের শ্রমজীবী মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি বরং প্রকৃত মজুরির মূল্যমানে তা খানিকটা হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে। ফলে খানাগুলি ক্রমবর্ধমান আয় ঘাটতির চাপ সামলাতে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপ ‘ওয়েজ রেট অফ ওয়ার্কিং পুওর ইন বাংলাদেশ, ২০০৯-১০’ এর তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকের গড় দৈনিক মজুরি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- বিড়ি ও জর্দ্দা তৈরিতে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। বর্তমানে বিড়ি খাতে নিয়োজিত শিশুদের মজুরির চিত্র আরও ভয়াবহ, মাত্র ৩৫ টাকা। তবে বিড়ি কারখানাগুলোতে সপ্তাহে যে পরিমাণ কাজ হয় সে হিসেবে একজন শিশুশ্রমিকের মজুরি বাবদ প্রাপ্ত মাসিক গড় আয় থেকে দৈনিক গড় আয় বের করলে, শিশু মজুরির অমানবিক চিত্র পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায়। হিসেব অনুযায়ী এই আয় মাত্র ১৪ টাকা। এই টাকায় কি একটা ছোট্ট শিশুরও পেট ভরে? এভাবেই দারিদ্র্য আর অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করছে। মরণ ফাঁদে আটকে রাখছে জাতির এসব অবুঝ শিশু সন্তানদের।
কেস ১: মৃত্যুফাঁদে ডলারের শৈশব
ডলার, বয়স ১৪ ছুঁই ছুঁই। বিড়ি শিল্পের মরণ ফাঁদে আটকা পড়া এক দরিদ্র শিশু। হারাগাছ গফুর বিড়ি কারখানার পাশে গড়ে উঠা সারাই কলোনির ছোট্ট ঘরে খানার আরও পাঁচ পাঁচজন সদস্যের সাথে মানবেতরভাবে বেড়ে ওঠা এক অপুষ্ট শিশু। ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে সে। আর দশজন শিশুশ্রমিকের মতো বিড়ি কারখানায় কাজ শুরুর পর তার পক্ষেও লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। সংসারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই মাত্র ৭ বছর বয়সে সে আজিজ বিড়ির কারখানায় কাজ শুরু করে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কারখানার ভিতরে বিড়ির খালি ঠোসে তামাক ভরা, বিড়ির মাথা মোড়ানো এবং বিড়ি প্যাকেটজাত করতে হয় তাকে। এছাড়া বাড়িতে খালি ঠোস তৈরির কাজে মা, বোন ও ভাইয়ের পাশাপাশি সে নিজেও যুক্ত থাকে। উল্লেখ্য, ঠোস তৈরিতে সম্পৃক্ত শিশুদের বয়স সবচেয়ে কম, বেশিরভাগই ৫-৯ বছরের মধ্যে।
ডলার জানায়, তার বাবা বর্তমানে বিড়ি তৈরিতে যুক্ত না থাকলেও এক সময় বাবার কাজে সহযোগিতা করতে করতেই তার বিড়ি শ্রমিক হয়ে ওঠা। ‘বাবার সাথে একটু একটু কাজ করতে করতে ফ্যাক্টরিতে ঢুকে পড়ছি’- ডলার বলে।
হারাগাছ এলাকার প্রায় সব শিশু শ্রমিক এভাবেই প্রথমে পারিবারিক শ্রমের অংশ হিসেবে ঘরে বসে অন্যান্য সদস্যদের সাথে বিড়ির ঠোস তৈরি করে, তারপর একদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে বিড়ি ফ্যাক্টরির অস্বাস্থ্যকর প্রকোষ্ঠে ঢুকে পড়ে। সাত বছর ধরে ডলার বিড়ি কারখানার ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে নিয়মিতভাবে কাজ করছে। সপ্তাহে সে ৩ দিন কাজ করে এবং প্রতিদিন ৬ হাজার বিড়ির ঠোস তৈরি, খালি ঠোসে তামাক ভরা, মাথা মোড়ানো এবং প্যাকেটজাত করার কাজ করে। ৬ হাজার বিড়ির জন্য মজুরি হিসেবে সে পায় ১৪৩ টাকা। এই ১৪৩ টাকার মধ্যে তার নিজস্ব মজুরি ১০৩ টাকা আর বাড়িতে বিড়ির ঠোস তৈরি বাবদ তার মা-বোন ও ভাইয়ের অংশ ৪০ টাকা। এই হিসেবে ডলারের সাপ্তাহিক গড় মজুরি ৩০৯ টাকা এবং প্রতিমাসে সে গড়ে ১২৩৬ টাকা উপার্জন করে।
খানাভিত্তিক আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০ (এর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১০ এ মাথাপিছু গড় মাসিক আয় ছিল ২৫৫৩ টাকা, ২০০৫ এ ছিল ১৪৮৫ টাকা, ২০০০ এ ছিল ১১২৮ টাকা এবং ১৯৯৫-৯৬ সালে এই ছিল ৮৩০ টাকা । ডলারের বর্তমান আয় ২০০৫ সালের জাতীয় মাথাপিছু আয় থেকে কম এবং ২০০০ সালের আয় থেকে একটু বেশি।
ডলারের চোখ-মুখ কেমন শুষ্ক, বয়স্কদের ভাঁজপড়া ত্বকের ছায়া এখনি ওর মুখাবয়ব জুড়ে। হাত-পা সরু পাট খড়ির মতো। ফ্যাকাশে ফোলা ফোলা ত্বক, কোন লাবণ্য নেই যেন। এখন সে প্রায়ই অসুখে পড়ে। মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। কখনও কখনও হাত-পা ভীষণ ব্যথা করে, পাতলা পায়খানা হয়। সর্দি কাশি যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। এজন্য সে কোন ডাক্তারের কাছে যায় না, নিকটস্থ ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খায়। পরিবারের লোকজনেরও এ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই, অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে এসব তাদের কাছে। সবচেয়ে বড় কথা, টাকা। ক্ষুধা নিবারণের জন্য টাকা। সংসারের ঘানি টানতে তাই ব্যবহার করা হচ্ছে এই ছোট্ট শরীর। সংসারে বাবার আয়-রোজগার যথেষ্ট নয়, আবাদি কোন জমিজমা নেই তাদের।
ডলারের বাবা জানালেন, সংসারে ছেলের আয় যুক্ত হওয়ায় কোন রকম চলে যাচ্ছে তাদের।
ডলারের আশা, অন্য কোথাও একটা কাজ জুটে গেলেই ছেড়ে দিবে বিড়ি কারখানার কাজ। তার স্বপ্ন, সে একদিন এলাকার বাইরে গিয়ে কাজ শুরু করবে। অনেক টাকা রোজগার করবে, দূর করবে সংসারের অভাব।
ডলারের ধারণা, আজিজ বিড়ি কারখানায় বর্তমানে ১৪-১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করছে, যার মধ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭-৮ হাজার (ছেলে শিশু ২-৩ হাজার এবং মেয়ে শিশু ৫-৬ হাজার)।
অবশ্য স্থানীয়দের মতে, এ কারখানার প্রায় ৬০/৬৫ ভাগ শ্রমিকই শিশু।
গবেষণা অনুযায়ী, সারা দেশে মোট ১৯৫টি বিড়ি কারখানায় ৭৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। মোট শ্রমিকের অর্ধেকও যদি শিশু হয়, তাহলে সারা দেশে ৪২,৫০০ হাজার শিশু শ্রমিক ডলারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বিড়ি কারখানায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ কিন্তু সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় তামাক কোম্পানির মৃত্যুবিপণন কৌশলে প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
কেস ২: মুক্তার মুক্তি কিসে?
মুক্তা, বয়স ৯। হারাগাছ সাহেব পাড়ায় বসবাস। বাবা ট্রাক হেলপার। পরিবারের মাসিক আয় ২৫০০-৩০০০ টাকা। এই আয়ে ৫ জনের সংসার চলে না। মুক্তা ও তার বড় বোনকে তাই মায়ের সাথে বিড়ি তৈরির কাজ করতে হয়। মাত্র ৭ বছর বয়সই সে বিড়ির কাজ শুরু করে। সপ্তাহের বুধ ও শনিবারে সে মায়ের সাথে বিড়ি কারখানায় যায়। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কাজ করে। এ সময়ে সে ৫ হাজার বিড়ির মাথা মোড়ানোর কাজ করতে পারে যার মজুরি প্রতিহাজারে ৭ টাকা। মায়ের কাজের অংশ হিসেবে সে এই কাজ করে। মূলত তার মা সপ্তাহে ১৮,০০০ হাজার বিড়ি তৈরির অর্ডার পায়। বুধবারে জমা দিতে হয় ৯ হাজার এবং বাকি ৯ হাজার জমা দিতে হয় শনিবার। মুক্তার বোন ও মা বাড়িতে বসে ৪ দিনে এই ১৮,০০০ বিড়ির ঠোস তৈরি করে। সপ্তাহের দুই দিনে (বুধ ও শনি) কারখানায় ঠোসগুলিতে তামাক ভরা, মাথা মোড়ানো এবং প্যাকেটজাত করার কাজ করে মুক্তা আর তার মা। এক সপ্তাহে এই ১৮ হাজার বিড়ির জন্য মুক্তার মা মজুরি হিসাবে কারখানা থেকে পায় মাত্র ৩৩০ টাকা যার মধ্যে মুক্তার আয় ৭০ টাকা। অর্থাৎ মজুরি থেকে তার মাসিক গড় আয় মাত্র ২৮০ টাকা। মুক্তা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়লেও নিয়মিত স্কুলে যায় না। দিনে দিনে রোগা হয়ে পড়ছে সে। জ্বর, কাশি প্রভৃতি কারণে তাকে মাঝে মাঝেই স্কুল ও কারখানার কাজ কামাই করতে হয়। এই কাজ করতে কেমন লাগে, এ প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি মুক্তা। হয়ত প্রশ্নটাই তার কাছে বাহুল্য মনে হয়েছে অথবা আগেও সে এ প্রশ্ন অনেকবার শুনেছে। কিংবা নিঃশব্দে বিরক্তি প্রকাশ করেছে, তোমরা যাই বল মুক্তাদের মুক্তি হয় না!
কেস ৩: ছোট্ট কাঁধে সংসারের ঘানি, এ কেমন শৈশব!
লালমনিরহাট জেলার কালমাটির মন্ডল পাড়ার শিশু শ্রমিক রোখসানা, বয়স ৮। ৫ বছর বয়স থেকেই মা শিউলি বেগমকে বিড়ির ঠোস তৈরির কাজে সহায়তা করে আসছে সে। বর্তমানে সপ্তাহে ৫-৬ দিন বিড়ির ঠোস তৈরির কাজ করে রোখসানা। তার মা সপ্তাহে ১০ হাজার ঠোস তৈরির অর্ডার পায়। রোখসানা তৈরি করে ৪ হাজার এবং বাকি ৬ হাজার ঠোস তৈরি করে তার মা। প্রতি হাজার ঠোস তৈরির মজুরি ৮ টাকা। এ কাজে রোখসানা সপ্তাহে আয় করে ৩২ টাকা এবং সে হিসেবে তার মাসিক আয় মাত্র ১২৮ টাকা। মা শিউলি বেগম বিড়ি কারখানার কার্ডধারী শ্রমিক নয়।
উল্লেখ্য, লালমনিরহাট এলাকায় যেসব শ্রমিকের কার্ড নেই তারা বাড়িতে বসে চুক্তিভিত্তিক ঠোস তৈরি করে। এদেরকে চুক্তিভিত্তিক কাজে যুক্ত করে কার্ডধারী শ্রমিক। কার্ডধারী শ্রমিক বিড়ি কারখানা থেকে প্রতিদিন (১০-১৮ হাজার) যে পরিমাণ বিড়ি তৈরির অর্ডার পায় তার সবটা তৈরি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে, তারা চুক্তিভিত্তিতে ঠোস তৈরি করিয়ে নেয়। কার্ডধারী শ্রমিকরা বাড়িতে বাড়িতে ঠোস তৈরির উপাদান অর্থাৎ সাদা কাগজ ও আঠা সরবরাহ করে এবং ঠোস তৈরি শেষে নিয়ে আসে।
মায়ের ঠোস বানানো দেখে দেখেই একাজ শিখেছে রোখসানা। এখন অভাব তাড়ানোর দায়ভারও পড়েছে তার ঘাড়ে। রোখসানা এখন ২য় শ্রেণির ছাত্রী কিন্তু কাজের জন্য নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না, এমনকি খেলাধূলার সময়ও নেই তার হাতে। গত তিন বছর ধরে এভাবেই চলছে রোখসানার শৈশব। তার মতো কয়েক হাজার শিশু নিয়মিত স্কুলে যায় না, অভাব নামক দানবের কাছে মাথা হেঁট করে কাজ করে চলেছে তারা। এ অবস্থার অবসান হবে কবে?
রোখসানার বাবা দিনমজুর। সারা বছর নিয়মিত কাজ থাকে না। চাষাবাদের কোন জমিও নেই তাদের। বাবার অল্প আয়ে সংসার চলে না। যে কারণে মা ও মেয়েকে বাধ্য হয়েই বিড়ির কাজ করতে হয়।
শিউলি বেগমের সাথে কথা বলে জানা গেল, এই এলাকার বেশির ভাগ গরিব মানুষই বিড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত। যাদের নিজেদের চাষের জমি নেই, সহায়সম্পদহীন অথবা দিনমজুরিই যাদের একমাত্র সম্বল তাদের বেশির ভাগ মানুষই বিড়ি কারখানার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
কেস ৪: স্কুলে যাওয়া হলো না শুকির
শুকির বয়স ১১। দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। এখন সে বিড়ি কারখানার নিয়মিত শ্রমিক। প্রতিদিন ভোর ৫টায় চোখ মুছতে মুছতে বাবার সাথে বিড়ি কারখানায় যায় এবং কাজ শেষে বিকাল ৫টায় বাড়ি ফেরে। লালমনিরহাট জেলার কালমাটির বানিয়াপাড়ার ভেড়িবাঁধে শুকিদের বসবাস। শুকির বাবা কার্ডধারী শ্রমিক। কারখানা থেকে সে প্রতিদিন ১০ হাজার বিড়ি তৈরির অর্ডার পায়। প্রতি হাজার ২৪ টাকা হিসেবে ১০ হাজার বিড়ি তৈরির জন্য সে মোট পায় ২৪০ টাকা । ৮ টাকা হাজার চুক্তিতে বাইরের শ্রমিক দিয়ে ১০ হাজার ঠোস তৈরিতে তার খরচ হয় ৮০ টাকা। ঠোস তৈরির খরচ বাদ দিয়ে যে ১৬০ টাকা অবশিষ্ট থাকে তাই শুকি ও তার বাবার দৈনিক আয়। তারা ১ মাসে গড়ে ২০ দিনের মতো কাজ পায়, যা থেকে তাদের মোট আয় হয় ৩২০০ টাকা এর মধ্যে শুকির আয় ৮০০ টাকা। শুকি সপ্তাহে ৫ দিন কারখানায় যায়। প্রতিদিন সে ৫ হাজার বিড়ির মাথা মোড়ায় যার মজুরি হাজারপ্রতি ৮ টাকা হিসাবে ৪০ টাকা। অর্থাৎ শুকির সাপ্তাহিক মজুরি থেকে আয় ২০০ টাকা যা মাসে দাঁড়ায় ৮০০ টাকায়। উল্লেখ্য, শুকির আয় অন্য যেকোন শিশু শ্রমিকের গড় আয়ের চেয়ে বেশি, দক্ষতা ও সপ্তাহে ৫দিন কাজের সুযোগ থাকাই এর প্রধান কারণ।
শুকির সাথে কথা বলার সময় তার বাবা মা পাশেই ছিল। মেয়ে বিড়ি কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে, স্কুলে যায় না এসবে কোন অনুতাপ নেই তাদের। বরং মেয়ে যে টাকা আয় করছে সেটা বলার সময় তাদের চোখে-মুখে দারুণ তৃপ্তির ঝিলিক দেখা গেল। তার স্কুলে না যাওয়া পরিবারের কাছে বড় কোন ঘটনা নয়, সে যে টাকা আয় করছে সেটাই তার পরিবারের কাছে অনেক বড়। কারণ, তার পরিবারও নিঃস্ব, সর্বহারা। নদী ভাঙনের ফলে সবকিছু হারিয়ে গত ৬ বছর যাবৎ ভেড়িবাঁধে বসবাস করছে। কোন জমিজমাও নেই তাদের। শরীরই একমাত্র সম্বল। বাবার একার আয় দিয়ে পাঁচ জনের সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণেই শুকিকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে তার বাবা।
তবে বিড়ি কারখানায় কাজ করতে গিয়ে শুধু স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়নি তার স্বাস্থ্যেরও বেশ অবনতি হয়েছে। জ্বর, কাশি ছাড়াও বেশ কিছুদিন থেকে শুকির দুচোখ ফোলা ফোলা এবং চোখ ব্যথা করে। টাকার অভাবে এখনো ডাক্তার দেখানো হয়নি । আর কতদিন শুকি বিড়ি কারখানায় কাজ করবে? উত্তরে তার বাবা জানায়, “শুকি যে টাকা আয় করছে তা ওর জন্যই সঞ্চয় করছি, ওর বিয়ের সময় তো টাকা লাগবে। ” শুকির কাছে প্রশ্ন ছিল, “বিড়ি কারখানায় কাজ করতে তোমার ভাল লাগে?” ও চুপ করেছিল। কারণ ওর মা-বাবা কাছেই ছিল। শুকির মতো অনেক শিশু তাদের বেড়ে উঠা সময় ব্যয় করছে বিড়ি কারখানার ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। যে সময় ব্যয় হওয়া উচিত ছিল শিক্ষা ও খেলাধুলায় সে সময় চলে যাচ্ছে সংসারের আয়-উপার্জনের ঘানি টানতে।
কেস ৫: কারখানার অভ্যন্তরে
উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধের তীব্রতা ভেদ করে কারখানার ভেতরে পা রাখতেই চোখে পড়লো এক অন্যরকম দৃশ্য। গুদামসদৃশ বিশাল ঘরের মেঝেতে শত শত কচি হাত একমনে কাজ করে চলেছে, কারো কোন দিক তাকাবার ফুরসত নেই। সারা মেঝে জুড়ে তামাকের গুঁড়া আর ধূলো-ময়লার আস্তরণ, ঘরময় দূষিত বাতাস। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন জীবনি শক্তি খেয়ে ফেলছে। এরমধ্যে গোল হয়ে বসে কাজ করছে ২-৫ জনের এক একটা দল, এক একটি পরিবার সাথে বিড়ি তৈরির সরঞ্জাম। মায়ের পাশে আনমনে খেলা করছে অনেক দুধের শিশু, ঘুমিয়ে আছে কেউ কেউ চরম অনাদর আর অবহেলায়। মায়ের সাথে আসা এসব শিশুর বেশিরভাগের বয়স ৬ মাস থেকে ৪ বছরের মধ্যে। ভীষণ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বাধ্য হয়েই সারাদিন মায়ের সাথে থাকতে হচ্ছে তাদের।
তামাকের গুঁড়া নাক মুখ দিয়ে প্রবেশ করছে অনবরত। কারো কোন বিকার নেই। অবশ্য কারখানা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নির্বিকার, ‘১৪ বছরের নিচে শিশুদের বিড়ি ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ নিষেধ’ সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড প্রধান ফটকের সামনে সাটিয়ে দিয়ে খালাস, যেন শিশু অধিকার আইন পালন করে ফেলেছে।
চৈত্রের দাবদাহ, প্রায় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। টিনের ছাদ বেয়ে নামছে দগদগা গরম, কোন ফ্যান নেই। অনেকে শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে কাজ করছে। কেউ কেউ উদাম শরীরে হাত চালাচ্ছে দিনের কোটা পূরণ করতে। খালি গায়ে থাকা শিশুদের হাড্ডিসার শরীর দেখে, মনের অজান্তেই স্বাভাবিক পরিবেশে বাস করা শিশুদের সাথে এদের তুলনা মাথায় এসে পড়ে। কি নির্মম বাস্তবতা। সারা শরীরে তামাক গুঁড়ার আস্তরণ, শুষ্ক চোখ-মুখ। চোয়ালের হাড় জেগে উঠা। চোখদুটো গর্তে বসানো, নিস্প্রভ। শিশুর চাঞ্চল্য নেই ওদের চোখে-মুখে, যেন সংসারের সবার ভাত-কাপড়ের দায়ভার তাদের ঘারে চাপানো।
কারখানার ভেতরে অনেক প্রশ্ন মনে আসলেও কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল না। শুধু পর্যবেক্ষণ। তবে কারখানার (১/২ জন) কর্তৃপক্ষের পক্ষে টিমের ৭/৮ জনকে (স্থানীয় সাংবাদিকসহ) সামলানো সহজ ছিলনা। ফলে, কৌশলে কারখানার অভ্যন্তরে কিছু কিছু ছবি তোলা সম্ভব হয়েছিল। শ্রমিকদের সাথে কথা বলার জন্য কারখানার প্রধান ফটকের বাইরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। কাজ শেষে বের হলে, অনুমতি নিয়ে রাস্তার পাশে কোন স্টলে অথবা বাড়িতে গিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হয়েছে। লালমনিরহাটে একটি বিড়ি কারখানার বাইরে ৩ সদস্যের এক শ্রমিক পরিবারের মা সদস্যর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- কারখানায় এত শিশু, শুধুই কি অভাব? তার উত্তরের সারসংক্ষেপ হলো, অভাব তো আছেই কিন্তু বিড়ি কোম্পানির স্বার্থও কম নয়।
শিশুদের সরু সরু আঙুল কোম্পানির খুব পছন্দ। বড়দের তুলনায় শিশুরা সরু আঙুল দিয়ে বিশেষ করে খালি ঠোস তৈরি ও তামাক ভরা ঠোসের মাথা মোড়ানোর কাজ খুব দ্রুত ও নিখুঁতভাবে করতে পারে। এছাড়া শিশুদের সহজে পাওয়া যায় এবং পুর্নবয়স্ক শ্রমিকদের তুলনায় শিশুদের মজুরি মুল্যের চাহিদাও কম। একপর্যায়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে তার ৮ বছরের মেয়ে ও ১০ বছরের ছেলের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি জানান, তার ছেলে গত তিন বছর ধরে কাজ করছে আর মেয়ে কাজ করছে দেড় বছর ধরে। মেয়েটি সারাবছরই নানারকম অসুখে ভোগে বিশেষ করে কাশি থাকে সবসময়।
তার কাছে আরও জানা গেল, মালিক পক্ষ কেন টিমের লোকজনকে কারখানার অভ্যন্তরে একটি বিশেষ ঘরে যেতে আপত্তি করেছিল। কারাখানার ওই ঘরের বেশির ভাগই শিশু শ্রমিক। তার কাছে আরও জিজ্ঞেস করা হলো, কারখানার একজন কর্মকর্তা বললো এসব শিশু স্কুলে যায়, কিন্তু কিভাবে? টিমের কাছে উন্মোচিত হলো কাখানা কর্তৃপক্ষের এক নতুন চরিত্র। কারখানার মালিক পক্ষ বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে এসব বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, ভর্তি শেষ হলে প্রথম এক-দুইমাস যারা স্কুলে পড়ে তাদের সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ছুটি দেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে সে নিয়ম শিথিল হয়ে আবার বিড়ি তৈরির কাজ চলতে থাকে সারাদিন। স্কুলে নিয়মিত যায় এমন শিশুর সংখ্যা খুবই কম। এটি কোম্পানির এক ভয়াবহ কৌশল, শতভাগ শিশু স্কুলে ভর্তি কিন্তু কাজ করে সারাদিন কারখানায়!
বিড়ি কারখানার অভ্যন্তরে শিশুশ্রমের ব্যবহার সত্যিই আশঙ্কাজনক। রংপুরের হারাগাছে ২টি এবং লালমনিরহাটের খুনিয়াগাছে ১টি মোট ৩টি বিড়ি কারখানা পরিদর্শন শেষে ৬ সদস্য বিশিষ্ট টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ওয়াচবিডি টিম শিশুশ্রম ব্যবহারের মাত্রা বিষয়ে প্রায় অভিন্ন অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছে।
তাদের মতে, কারখানাগুলোতে কর্মরত অর্ধেকের বেশি (শতকরা ৬০-৬৫ ভাগ) শ্রমিক শিশু, যাদের আনুমানিক বয়স ৪-১৪ বছরের মধ্যে। পর্যবেক্ষণ, বিড়ি শ্রমিকদের সাথে কথা বলা এবং ছবি বিশ্লেষণ করে টিমের সদস্যরা শিশুশ্রম ব্যবহারের এ অনুপাত অনুমান করছে।
যেহেতু অধিকাংশ শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত বা রুগ্ন এবং শারীরিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয়, ফলে সঠিক বয়স নির্ণয় করা কঠিন।
তবে স্থানীয়দের সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য, শিশুশ্রম সংক্রান্ত বিদ্যমান পরিসংখ্যান প্রভৃতির সাথে টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ওয়াচবিডি টিমের সংখ্যাগত মূল্যায়নের সাযুজ্য রয়েছে। তবে পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন এই অমানবিক শ্রম বন্ধ হোক এটাই টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ওয়াচবিডি টিমের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৪