দেশভাগের পর ব্রিটিশ সরকার তঃকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকারকে একটি দলিল হস্তান্তর করে, তাতে তারা বলে যে উত্তরবঙ্গে বড় বড় শালবন ছিল, বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে, তারা সেগুলো কেটে ফেলে সেখানে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করেছিল। উত্তরাঞ্চল যেহেতু মরুপ্রবণ, এই গাছগুলো যদি সেখানে আবার লাগানো না হয় তাহলে, উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হয়ে যাবে।
এখানে বিশাল জনবসতি গড়ে ওঠায় পাকিস্তান সরকার এই স্থিতাবস্থা নষ্ট করতে চায়নি। ঠিক ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতের উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ গান্ধীপন্থি রাজনীতিক, নিজরাজ্যে শ্রমিকশ্রেণি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের কথা ভেবে শিল্প নির্মাণের বদলে কৃষির উপর একক গুরুত্ব দেন। এবং হিমালয়ের পাদদেশে বিস্তৃত তরাই অঞ্চল আবাদ করার জন্য ভূমিহীনদের বিনামূল্যে জমি বিতরণ করেন। প্রকৃতির স্বাভাবিকতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য বনটি এভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
কিছুদিন সেখানে ফসল ভালোই হয়েছিল তারপর নদীগুলো সব শুকিয়ে যায়, জলসেচের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা আজ এই ধ্বংসযজ্ঞের ভুক্তভোগী। হিমালয় ও তরাই অঞ্চলের গাছপালা কাটার ফলে বনের বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ক্ষমতা ৪০ থেকে ২০ শতাংশে নেমে আসে, ত্বরিৎ বন্যা দেখা দেয়, শীতে নদী শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং নদী ও জলাশয় অধিক পলিতে ভরাট হতে থাকে।
এইসব ক্ষতিকর প্রক্রিয়া সর্বজনীন। এগুলি থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন। বন ধ্বংসে শুধু তিস্তা নয়, হিমালয় থেকে উৎপন্ন সকল নদীর প্রবাহেই পরিবর্তন ঘটবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে হিমালয়ের ভিতরে বিশাল বিশাল সব হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো আটকা পড়ে আছে, বের হতে পারে না। কিন্তু এগুলো উপচে পড়ে কিংবা ভেঙে বেরিয়ে এলে মহাপ্লাবন দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান আমরা সকলেই এই ঝুঁকির মধ্যে আছি। প্রকৃতি তো খেলার জিনিস নয় যে তার সঙ্গে যদৃচ্ছা ব্যবহার করা যাবে। এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, বহুমাত্রিক বিবেচনা ছাড়া এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া তা থেকে সুফল লাভ কঠিন। উন্নয়ন আজ প্রকৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক পথরেখায় পরস্পরের মুখোমুখি। এ এক অশনিসংকেত। সবাই ভাবছেন, কিন্তু আজও কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হয়নি।
লেখক : অধ্যাপক, পরিবেশবিদ ও লেখক
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৪