১৯ শতকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় শিল্পায়ন ও পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীরও বিকাশ হয়েছে। কিন্তু সেই সময়ে শ্রমিকদের কর্মসময়, বয়স, মজুরি কোনোকিছুরই ঠিক ছিলো না।
বাংলাদেশে গত চার দশকে সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে তার একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর গঠনের পরিবর্তন। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে ৮০’র দশক থেকে অনেকগুলো রাষ্ট্র্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে আদমজী পাটকল। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র্রায়ত্ত শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ৮০’র দশক পর্যন্ত রাষ্ট্র্রায়ত্ত শিল্প খাতের শ্রমিকরাই ছিলেন দেশের শিল্প শ্রমিকদের প্রধান সংগঠিত অংশ। রাষ্ট্র্রায়ত্ত শিল্প কারখানা বন্ধ করার এই প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র রাষ্ট্র্রায়ত্ত সম্পদ ব্যক্তিদখলে নেওয়ার প্রক্রিয়াই ছিল না, এটি একইসঙ্গে শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তিকে ভেঙ্গে দেওয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশ ছিল। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিল্পখাতের মধ্যে রাষ্ট্র্রায়ত্ত শিল্পখাতের অবস্থান খুবই প্রান্তিক। একই কারণে ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যাও তুলনায় অনেক কম। ৮০’র দশক থেকে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রায় অনুপস্থিত। রফতানীমুখি খাত হিসেবে গার্মেন্টস শিল্পখাত এখন প্রাধান্যে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিল্পশ্রমিক এই খাতেই নিয়োজিত। কিন্তু এই খাতে কোন ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এখনও কার্যকর হয়নি। ৮০’র দশকের সামরিক শাসনের সময় থেকে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে সংগঠিত আয়োজন শুরু হয় তা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলোর সময়েও অব্যাহত থাকে।
অন্যদিকে গত কয়েক দশকে একই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে উদ্ভুত হয়েছে কয়েক হাজার দখলদার চোরাই কোটিপতি। উৎপাদনশীল প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং বিকশিত করার চাইতে অতিশোষণ, দখল, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস ও পাচারের মধ্য দিয়ে দ্রুত কোটিপতি হওয়াই তাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতি প্রধানত তাদের দ্বারাই পরিচালিত। সেই কারণে জনগণের বৃহত্তম অংশ শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যুনতম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত। বেশিরভাগ শিল্প কারখানায় ন্যুনতম বাঁচার মতো মজুরি, ৮ ঘন্টা শ্রম দিবস, নিয়োগপত্র. সাপ্তাহিক ছুটি, কাজ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা— এর সবগুলো বা অধিকাংশই অনুপস্থিত। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণী গঠনে লিঙ্গীয় পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হয়েছে। এখন অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। এই শ্রমিকদের বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে নারী শ্রমিক এক নতুন প্রতিবাদী সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলেও, যেহেতু তাদের মজুরীসহ বঞ্চনা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সেহেতু ক্ষোভ, বিক্ষোভও সমাজের মধ্যে বিস্তৃত হচ্ছে। সেজন্য গত ১ দশকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি নতুন চেহারা আমরা দেখতে পেয়েছি। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অনেক বিস্তৃত। তবে সাংগঠনিক শক্তি ও যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে মাঝেমধ্যেই পর্যদুস্ত। শ্রমিকশ্রেণীর বর্তমান গঠনের কারণে বর্তমানে সকল খাতের শ্রমিকদের মধ্যে অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, ইনফর্মাল শ্রমিকদের সংখ্যাই এখন বেশি। সুতরাং তাদের আন্দোলনে সংগঠনের ধারণাও নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে। মে দিবসের মূল যে দাবী ৮ ঘন্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরী, তা থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক-মেহনতি মানুষ অনেক দূরে। সেজন্যই শুধু মজুরি বঞ্চনা বা নিপীড়নের প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা দিয়েই শ্রমিকের জীবন শেষ হচ্ছে না। স্পেকট্রাম, তাজরীন, স্মার্ট বা রানা প্লাজার মতো বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকারও তাদের হতে হচ্ছে।
প্রতিবছর মে দিবস একদিকে বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্বের জানান দেয় এবং একইসঙ্গে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় তাঁদের অব্যাহত প্রান্তিকীকরণ ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হবার তাগিদ দেয়। এই লড়াই ও সংগঠনের দুর্বলতা শ্রমিকশ্রেণীকে কতটা হীন অবস্থায় ফেলতে পারে বাংলাদেশ তার দৃষ্টান্ত। এতোবছর পরেও ৮ ঘন্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি পাবার অধিকার বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং তাঁদের জীবন এখন পরিণত হয়েছে লুটেরা দেশি চোরাই কোটিপতি ও আন্তর্জাতিক মুনাফাখোরদের সীমাহীন লোভ ও তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ভয়ংকর শিকারে। তাদের কারণেই কারখানা পরিণত হলো গণকবরে।
গত ২৩ বছরে অনেক গার্মেন্টস কারখানায় আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে ও পিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। পুলিশের গুলি, সন্ত্রাসীদের ধর্ষণ ও নির্যাতনেও খুন হয়েছেন অনেকে। আমরা জানি বিশ্বে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি এখনো সর্বনিম্ন। আর এসব হত্যাকাণ্ড আর তারপর সরকারের ভূমিকা থেকে বোঝা যায়, এই দেশে যে শ্রমিকদের শ্রমে অর্থনীতি চলে তাদের জীবনের দামও সর্বনিম্ন। যে শ্রমিকেরা বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেশে ডলারের পাহাড় তৈরি করছেন, শুধু দেশী মালিক নয়, বিদেশী বায়ার-স্টোর-রাষ্ট্র ইত্যাদিরও মুনাফা নিশ্চিত করছেন, তাদের জীবনই সবদিক থেকে নিরাপত্তাহীন।
তাজরীন বা রানার মতো এক একটি এমন ঘটনা প্রকাশ করছে রাষ্ট্রের স্বরূপ, ক্ষমতার সম্পর্ক, পুঁজির পুঞ্জিভবনের নির্মম প্রক্রিয়া। মালিকদের সংগঠন আছে, সেখানে তৈরি হয়েছে দলনির্বিশেষে শক্তিশালী শ্রেণী ঐক্য। বিজিএমইএ ভবনটি তাদের সম্মিলিত ঐক্যের প্রতীক। মালিকদের আছে সংগঠন, সরকার, থানাপুলিশ। পাশাপাশি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ কোনো সাংগঠনিক শক্তি নাই, রাজনৈতিক দিশা অস্পষ্ট। মাঝেমধ্যে কেবল তার স্বতস্ফূর্ত প্রতিরোধ শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্নিহিত শক্তির জানান দেয়। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে স্বচ্ছতা, ঐক্য ও সাংগঠনিক শক্তির বিকাশই। অতএব, গ্রাম শহরের শ্রমিক নারীপুরুষ মানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একমাত্র সড়ক। অপমান, নিপীড়ন, শোষণ আর গণহত্যা থেকে ভিন্ন ভবিষ্যৎ তৈরির অন্য কোনো পথ বাংলাদেশের নাই। মে দিবস প্রবলভাবে সেকথাটাই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়