ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কিস্তি দুই

অমর্ত্য সেনের সাত ইচ্ছার কয়টি পূরণ হচ্ছে?

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৭ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৪
অমর্ত্য সেনের সাত ইচ্ছার কয়টি পূরণ হচ্ছে? অমর্ত্য সেন

দুনিয়াখ্যাত মানুষ খুব অল্প নেই ভারতে। কিন্তু একশ বিশ কোটি মানুষের দেশটিতে খুব অল্পই আছে যারা খ্যাতি আর মর্যাদার পাল্লায় কাছাকাছি হতে পেরেছে এই মানুষটির।

অর্থনীতির নোবেল জয় করেছেন ১৯৯৮ সালে। অর্থনীতি, উন্নয়ন, জাতিগত সংঘাত আর ন্যায়বিচার নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য গ্রন্থ। কাজের খাতিরে বহু দশক ধরে বাস করে আসছেন পশ্চিমা বিশ্বে। যদিও মনেপ্রাণে ভারতীয় পরিচিতি ছাড়েননি কখনও। জীবন্ত এ কিংবদন্তি সম্প্রতি এক সাক্ষা‍ৎকারে মন খুলে কথা বলেছেন ‘মনডিলাল নিউজ’-এর সঙ্গে, বাদ-বিসম্বাদে আমুণ্ডু জড়িয়ে থাকা ভারতে গত ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া বিশ্বের বৃহত্তম নির্বাচন নিয়ে। ‘মনডিলাল নিউজ’-এর সাক্ষা‍ৎকারটি নেন জি গরিস, বাংলায় অনুবাদ করেছেন মিলটন মোললা


কিস্তি দুই

নানা কারণেই বিভেদবাদী হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলের গন্ধ মুছে যায় না তাদের গা থেকে। আমার নিজেরও ঘোরতর সন্দেহ, চলতি নির্বাচনে সত্যিই কী এমন একটি দলের কথাই প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করছে আধুনিক ভারত? যদিও বিজেপি তাদের সকল প্রচারণায় নিজেদের এমনভাবে তুলে ধরছে যাতে এতোকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত দলীয় ভাবমূর্তি থেকে অদৃশ্য হয় সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্কজনক ছাপ। ভোটারদের সামনে এমন এক দল হিসেবে নিজেদের দেখানোর চেষ্টা করছে তারা যারা সৎ, যারা দক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি সরকার গঠন করতে সক্ষম।

‘অতীতের জাফরানি প্রচারণার চাইতে এই প্রচারণা মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয় করে তুলতে পারে তাদের। আর দক্ষতার প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ইউরোপীয়দের অভিজ্ঞতার কথা, ফ্যাসিস্ট সরকার বেনিতো মুসোলিনির আমলে কঠোর সময়ানুবর্তিতা মেনে টাইমটেবিল অনুসারে নিখুঁত সময়ে ট্রেন ছাড়তো প্রতিটি রেলস্টেশনে। এ কথার অর্থ যদিও এই নয় যে, বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে তুলনা করছেন তিনি। কিংবা বর্তমান নির্বাচনে বিজেপিকে নেতৃত্ব দানকারী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তুলনা করছেন ফ্যাসিস্ট নেতার সঙ্গে।

বিজেপির আরেক মাথাব্যথা তার নেপথ্য ক্রীড়নক রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘ বা আরএসএস। তৃণমূল পর্যায়ে ফ্যানাটিক জঙ্গিবাদী এই আন্দোলনের কারণে বহুবার বিপাকে পড়েছে তারা। একদিকে এ কথা সত্য যে, সংগঠনটির শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে দলীয় রাজনৈতিক প্রচারণায় অন্যদের তুলনায় সহজেই নির্বাচনী সুফল বয়ে আনতে পারে বিজেপি। আবার একই কারণে সহযোগী অন্যান্য দলগুলো ভয়ে তাদের ছেড়ে পিছিয়ে যেতে পারে। একা হয়ে যেতে পারে বিজেপি। ফলে সরকার গঠনের প্রশ্নে বড় ধরনের ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাদের ওপর আস্থা রাখার কোনো বাস্তবতাই নেই দেশের ৩০ শতাংশ অহিন্দু ভোটারের।

arvindএসব বিতর্কের কারণে কখনও কংগ্রেসবাদী মনে পারে অমর্ত্যকে। যদিও কংগ্রেস সরকারের তীক্ষ্ন সমালোচনা করা থেকে কখনও বিরত থাকতে দেখা যায়নি তাকে। সরকারের ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (ন্রেগা)-এর সমালোচনা করে তিনি বলেন, এর প্রধান দুর্বলতা এটাই যে, এটি দারুণ অস্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতার কোনো পদ্ধতি তৈরি করা হয়নি এখানে। কয়েকটি রাজ্য যেমন তামিলনাড়ু– কিংবা নীতীশ কুমারের বিহারে দারুণ সফল হয়েছে ন্রেগা। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান এবং অন্ধ্র প্রদেশে চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তাদের এ নীতি।

অমর্ত্য সেনের মতে ভারতের রাজনীতি এক ‘হতাশাজনক চিত্র’। তথাপি এর মধ্যেই সাজ সাজ রবে বেজে উঠেছে নির্বাচনী ডঙ্কা। ভোটারের হাতে কোন বিবেচনায় নির্ধারিত হতে যাচ্ছে তার ভাগ্য? বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য, নাকি বিরোধী পক্ষের অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি? সেন বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক মানসিকতাটা ভালোভাবে উপলব্ধি করা জরুরি। এখানকার সাধারণ মানুষ জীবন যাপনের প্রশ্নে ইহজাগতিক এবং তারা বিশ্বাস করে সমানাধিকারে। এমন এক রাষ্ট্র তাদের কাঙ্খিত, যেখানে প্রতিফলিত হবে সাধারণ মানুষের চাওয়া, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা কোনো বিশেষ ধর্মের নয়।

সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় চমক দুর্নীতিবিরোধী অ্যাকটিভিস্ট অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টির উত্থান। ২০১৩ সালের শেষদিকে এসে নির্বাচনে জিতে দিল্লীতে প্রাদেশিক সরকার গঠন করেছে তারা। অবশ্য দীর্ঘায়িত হয়নি তাদের এ সাফল্য। যদিও এ সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়ও অকার্যকর হয়ে যায়নি তারা। ‘চমৎকার একটি নমুনা হতে পারে এই ঘটনা, মন্তব্য করেন সেন। ‘নির্বাচনে জেতার জন্য কোনো প্রকার গোষ্ঠীগত পরিচিতির আশ্রয় নিতে হয়নি তাদের। একমাত্র এজেন্ডা ছিল সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুরন্ত সংগ্রাম। তাদের অর্জন থেকেই বোঝা যায় কোন ধরনের উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত ভারতীয় নাগরিকের।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে ছিল সাম্প্রদায়িকতা। সেই অশালীন ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এখন সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির প্রধান ইস্যু। ‘গুজরাটে দাপট দেখিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। ২০০১ সাল থেকে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর গদি দখল করে আছেন নরেন্দ্র মোদি। ২০০২ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি প্রাণহানি ঘটে গেছে সেখানে। অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান ইস্যু ছিল সুশাসন। চমৎকার একটি উদাহরণ হতে পারে বিহার। বহুদিন যাবৎ এটি ছিল কুশাসন, দারিদ্র্য আর দুর্নীতির কব্জায়। অথচ সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন নীতীশ কুমার।

একজন সুশীল নাগরিক হিসেবে কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থন নিয়ে কংগ্রেসকেই বিজয়ী হিসেবে ক্ষমতায় দেখতে চান সেন। তবে এ ধরনের দায়িত্ব নেয়ার আগে নিজেকে আরও যোগ্য করে নেয়ার প্রশ্নে বিস্তর করণীয় রয়েছে কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর। এখনও তাদের সকল প্রচারণার প্রধান বিষয়বস্তু মার্কিন বিরোধী প্রচারণা। এ তো কেবল ফেলে আসা অতীতেরই গান গেয়ে যাওয়া। চোখ মেললেই দেখা যাচ্ছে সময়ের চাহিদা মিটিয়ে নিজেদের কী দারুণভাবে বদলে নিয়েছে চীন, রাশিয়া আর ভিয়েতনাম। দ্রুততম সময় আর চমৎকার সাফল্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে। তো ভারতীয় কম্যুনিস্টদের সমস্যাটা কোথায়? এর বাইরে তারা যেসব কথা বলে তাতে প্রতিফলিত হয় কেবল মধ্যবিত্তের আশা আকাঙক্ষা। বিপুলবিস্তারী সর্বহারাদের কথা অতি অল্পই উচ্চারিত হয় তাদের প্রচারণায়। ডিজেলে ভর্তুকি দেয়ার জন্য অতোটা সোচ্চার হচ্ছে কেন এসব দল যখন তাদের ভালোই জানা আছে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ক্ষমতাই নেই একটা গাড়ি কেনার?

INDIA_01অমর্ত্য সেনের সাম্প্রতিক লেখায় বারবার উঠে এসেছে এই প্রশ্নটি। ডিজেল, বিদ্যুৎ আর কুকিং গ্যাসে ভর্তুকির কারণে লাভবান হয়েছে কেবল মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত। অথচ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এর ব্যয় মেটাতে গিয়ে যে টাকা খরচ হচ্ছে সেটি দরিদ্রতম জনগণের কল্যাণে নিবেদিত নেগ্রা প্রকল্পের বরাদ্দের চাইতে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। বিশেষ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি হীরা আর সোনা আমদানির ওপর থেকে শুল্ককর তুলে নেয়ার কথা। এখানে সরকারের ব্যয় হবে ‘রাইট টু ফুড বিল’ বা ‘খাদ্যের অধিকার’ কার্যক্রমে ব্যয়িত টাকার দুই গুণের চাইতেও বেশি। অবশ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে ভারতের শক্তিশালি মিডিয়া আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী।

আর্মস্টারডামের ক্রাসনাপোলস্কি হোটেলে এই সাক্ষাৎকার নেয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে জয়পুরে আয়োজিত বিশ্বের বৃহত্তম সাহিত্য সম্মেলনে এক লাখের বেশি আমন্ত্রিত অতিথির সামনে একটি মুখ্য প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অমর্ত্য সেন। অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অব স্মল থিংস’-এর অনুরূপ এখানে তিনি কল্পনায় মুখোমুখি হন ‘গডেস অব মিডিয়াম থিংস’ এর সঙ্গে। সেখানে ভারতের জন্য চাওয়া তার সাতটি ইচ্ছাকে মঞ্জুর করেন দেবী। এর মধ্যে তৃতীয় ইচ্ছাটি চমকপ্রদ: আমি রাজনৈতিকভাবে চাই এমন শক্তিশালি এক ডানপন্থী দল, যা হবে ইহজাগতিক এবং অসাম্প্রদায়িক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমার চাওয়া দলটিকে এমন হতে হবে যারা স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে পারে, যা বাজারমুখী এবং ব্যবসামুখী। যাকে নির্ভর করতে হয় না কোনো সাম্প্রদায়িক দলের ওপর। যা একটি গোষ্ঠীকে স্থান দেবে না অন্য সমস্ত গোষ্ঠীর ওপর। সেন যখন দেবীকে জানান তার চতুর্থ ইচ্ছার কথা, শক্তিশালী একটি বাম দলের কথা, যারা কথা বলবে ভারতের হতভাগ্য দরিদ্রতম মানুষের হয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবী তাকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে তাদের শক্তিশালী করা আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই যোগ্য হয়ে উঠছে নতুন চিন্তাকে ধারণ করার জন্য।

মে মাসের ১৫ তারিখে যখন শেষ হয়ে আসবে এ নির্বাচন ততদিনে আমরা নিশ্চয়ই জেনে যাব অমর্ত্য সেনের- সাতটি ইচ্ছার কতোগুলো মঞ্জুর হয়েছে সেখানে!

 

কিস্তি এক: অমর্ত্য সেনের সাত ইচ্ছার কয়টি পূরণ হচ্ছে?

 

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।