হেফাজতে ইসলামের খবর আবার সংবাদ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি তারা একটা সমাবেশ করেছে এবং তাদের নেতা আল্লামা আহমদ শফী বলেছেন, সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ তাদের শত্রু নয়, বরং বন্ধু।
এই ঘোষণার পরে সরকারি দল আওয়ামী লীগ অবশ্য নিজেরা এ বিষয়ে মুখ খোলেনি, কিংবা তাদের নেতাদের মধ্যে কাউকে এ নিয়ে তেমন একটা কথা বলতে দেখা যায়নি। এখন হেফাজতে ইসলামের খবর আবার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আসার সাথে সাথে কয়েকটি বিষয় বারবার আমার মাথায় ঘুরছে।
মনে আছে নিশ্চয়ই, ৯/১১ এর কথা? বিমান এসে আঘাত করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের একটিতে। এ খবর যখন পুরো পৃথিবীবাসী টেলিভিশনে দেখছিলো ঠিক সে সময়ে আরেকটি বিমান এসে আঘাত করে টুইন টাওয়ারের অন্য ভবনে। দেখতে দেখতে উঁচু অট্টালিকা দুটো ধুলোয় মিশে যায়। এর পর পুরো পৃথিবীজুড়ে নিরাপত্তার বিষয়টি অন্য আঙ্গিকে দেখা শুরু হয় এবং আমরা সবাই জানতে পারি একটি নাম, ওসামা বিন লাদেন!
লাদেনকে ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলা হয়। সর্বশেষ আমরা দেখতে পারি, পাকিস্তানের এক ছোট শহরে মার্কিন বাহিনী বেশ কিছু সময় পাল্টাপাল্টি গুলি বিনিময়ের পর লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। আর পুরো দৃশটি অ্যামেরিকায় বসে দেখছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্টসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা!
আমেরিকা কিন্তু দুধ-কলা দিয়ে লাদেনকে পুষেছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে লড়াইয়ের জন্য। পড়ে এই লাদেনই আমেরিকার ঘাড়ে চড়ে বসে। তবে বিষয় হচ্ছে লাদেনকে আমেরিকা তৈরি করেছিলো এবং তাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমেরিকাই খেলেছে। এই খেলায় আমেরিকার অর্জন ছিলো বিশাল। লাদেন আসলে কখনো আমেরিকার ঘাড়ে উঠতে পারেনি, আমেরিকা খেলাটা যেভাবে চেয়েছে ঠিক সেভাবেই লাদেন খেলে গেছে। লাদেন খেলার একটা ঘুঁটি ছিলো, এর চেয়ে বেশি কিছু লাদেন হতে পারেনি। কারণ আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে আমেরিকাসহ তাদের মিত্র বাহিনী যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে তাদের তাবেদার পুতুল সরকার।
হ্যাঁ, আমেরিকার লাভই হয়েছে বলা চলে। আর আরবসহ ইসলামি বিশ্বের কান্নার কারণ হয়েছে। আমেরিকা নিজে সেই অর্থে আক্রান্ত হয়নি, ছোট খাটো সন্ত্রাসী হামলা ছাড়া। ঠিক তেমনি হেফাজতে ইসলামের মতো প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী গোষ্ঠীকে যদি সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ১৯৭১-এ যেমন এসব ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো, তার একটা আভাস অন্তত আমরা করতেই পারি। এতে বঙ্গভবন কিংবা সংসদ ভবন আক্রান্ত না হলেও সাধারণ মানুষ যে আক্রান্ত হবে সেটি নিশ্চিত। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলাম আর হেফাজতে ইসলাম গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারির পর যে তাণ্ডব চালিয়েছে এরপর এই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে বিশ্বাস করা মানে আসলে খাল কেটে কুমির আনার মতোই।
এখন অনেকে বলতে পারেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার রাজনৈতিক কারণেই হয়তো হেফাজতিদের ঘাঁটাতে চাইছে না। বিশেষ করে ওই সময় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর হয়তো তারা ভাবছে একটা বিশাল গোষ্ঠীকে তাদের কাছ থেকে আলাদা করে দিলে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়তে পারে।
কিছুদিন আগে কিন্তু স্থানীয় সরকার পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেছে। সেখানেও যে সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ভালো করেছেন তা কিন্তু নয়। বরং জামায়াতে ইসলাম সমর্থিত বেশ কিছু প্রার্থী জিতে যাওয়ায় অবাক হতে হয়েছে অনেককে। তাহলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কিংবা উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচনে খুব একটা ভালো ফলাফল না হওয়ায় আওয়ামী লীগ কি চাইছে হেফাজতের ভোট টানতে?
যদি তাই হবে তাহলে সিটি কর্পোরেশন কিংবা উপজেলা নির্বাচনের সময় কিন্তু এই হেফাজতি নেতারা বলেননি সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ তাদের ভাই। বরং বলেছেন এমন একটা সময়ে যখন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ হয়েছে। জামায়াত কিংবা বিএনপির সাপোর্ট তাদের এখন দরকার নেই।
যদি নির্বাচনের আগে এই বন্ধুত্বের ডাক দিতো তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগের লাভই হতো। কিন্তু সেটি তারা করেনি। হয়তো এটিও জামায়াত-হেফাজতের একটি সূক্ষ্ণ চাল হয়ে থাকতে পারে। এখন বন্ধুত্বের ডাক দিয়ে হেফাজত ইস্যুতে সরকারকে বিব্রত করাই হয়তো তাদের উদ্দেশ্য।
এছাড়া ভুলে গেলে চলবে না- এই হেফাজত নেতারাই একদিন বলেছিলো এই সরকার দেশের শত্রু। হঠাৎ করে তাদের এই ভোল পাল্টানোর উদ্দেশ্য হয়তো সুদূরপ্রসারী। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের এ-বিষয়ে খুব ভালো করে নজর দেয়া জরুরি বলেই মনে হয়। রাজনৈতিক চাল বা খেলা এটি হতে পারে। বিষয় হচ্ছে, হেফাজত কিংবা এসব ধর্মীয় সংগঠন নিয়ে খেলাটা অনেক ভয়াবহ এবং একটা সময় সাপ হয়ে কামড় দেওয়ার আশংকা প্রবলতর।
আজকের জামায়াত নিয়ে একসময় জিয়া খেলতে চেয়েছেন। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়াই এদের এই দেশে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়েছেন। আজ সেই জিয়ার বিএনপিকে নিয়ে খেলছে জামায়াত। এখন যদি আওয়ামী লীগ হেফাজতকে নিয়ে খেলে- এ জন্য হয়ত আওয়ামী লীগকেও চরম মূল্য দিতে হতে পারে। হয়ত বললাম কারণ, আওয়ামী লীগের খেলার ওপর নির্ভর করবে হেফাজতের ভবিষ্যৎ এবং আওয়ামী লীগ কতটা মূল্য দেবে।
হেফাজতের ভবিষ্যৎ এবং মূল্য দেয়ার কথা যখন চলেই এলো তখন একটি কথা বিনা দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, ভোটের যে হিসাব সেখানে আওয়ামী লীগ কিছুটা ভুল এরই মধ্যে করে ফেলেছে। হেফাজতের ভোট কখনোই আওয়ামী লীগের বাক্সে যাবে না। এই একটি বিষয় যত তাড়াতাড়ি তারা বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। যে হেফাজতে ইসলামের নেতারা এ সরকারকে একদিন নাস্তিকদের সরকার বলেছে, যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তাদের ১৩ দফা দাবি পূরণ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় বাধা, তারা নৌকায় ভোট দেবে এটি ভাবা কতোটা দূরদর্শী সেটি এখনই ভাবতে হবে। যে হেফাজতের ৫ মের সমাবেশে বিএনপির নেতারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে পারলে সেদিনই সরকারকে উৎখাত করতে চায় সেই হেফাজত এখন যে বন্ধুত্বের কথা বলছে সেটি আসলে কাছে এসে ছোবল দেবার জন্যই বলছে। দূর থেকে তো আর ছোবল দেয়া যায় না। ছোবল দেয়ার জন্য কাছে আসতে হয়। আর এই জন্যই তাঁদের এই বন্ধুত্বের আহ্বান।
এতে হেফাজত তথা বিএনপি–জামায়াত সবার দুই দিক থেকে লাভ। প্রথম লাভ যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে একটি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে জানে, কিন্তু সেই অর্থে হয়তো সরাসরি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নয়, কিন্তু আদর্শগত কারণে হয়তো তাদের ভোট শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়ে, তাদের আস্থার জায়গাটায় কিছুটা হলেও আঘাত আসবে। হেফাজতের ১৩ দফার সাথে প্রগতির দূরত্ব যে যোজন যোজন সেটি অন্তত তারা খুব ভালো করেই বুঝে।
এ বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কথা মনে পড়ে গেলো। গত কয়েকদিন ধরে গণজাগরণ মঞ্চ আর ছাত্রলীগে টানাপড়েন দেখা যাচ্ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের সাথে রীতিমতো কাদা ছোড়াছড়ি করছে! এর মাঝে আরেক দল ঘোষণা করেছে তারাই মঞ্চের মুখপাত্র। অন্য দল যারা দীর্ঘ দিন ধরেই এই আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে, তারা বলছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু অংশ এ-কাজ করেছে।
বিষয় হচ্ছে, এই দুই পক্ষই কিন্তু অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদহীন, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশে বিশ্বাসী। তাহলে এই যে একটা টানাপড়েন চলছে সেটি কি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন না? অনেকের মনে কিন্তু প্রশ্ন ওঠা শুরু করেছে, তাহলে কি আওয়ামী লীগ বা সরকার চায় এই বিভক্তি।
পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের পর এখন ভেবে দেখার সময় কেন্দ্র ও পরিধির মাঝে ফারাক কেমন; এবং যদি দূরত্ব থেকে থাকে তাহলে সেটি কিভাবে পূরণ করা যায়। এটি মনে রাখতে হবে, হেফাজতের মতো সংগঠন যতই কাছে আসুক, এরা এক সময় দূরে সরে যাবেই। আদর্শিক ফারাকই এর জন্য যথেষ্ট। উল্টো যাদের কাছে টানা উচিত তাদের আওয়ামী লীগ দূরে সরিয়ে দিচ্ছে কিনা সেটিও দেখতে হবে।
এই হেফাজতই কিন্তু একদিন শাহবাগ আন্দোলন ও গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কটাক্ষ করেছিলো। তারা শাহবাগে আক্রমণ করার দু:সাহসও করেছিলো।
হেফাজত, জামায়াতসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীই কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছে। যে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।
এখন এই সাধারণ মানুষই যদি দেখে সরকার দলীয় ছাত্র সংঘটনের সাথে মঞ্চের কর্মীদের টানাপড়েন চলছে, তাহলে এর ফায়দা কাদের হবে সেটিও ভেবে দেখা দরকার।
তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যে দিন হেফাজতের সুফী হুজুর বলেছেন-সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ তাদের বন্ধু। তার পরের দিনই পত্রিকায় দেখলাম এক হেফাজতি নেতা বলছেন- গনজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকারের পরিণতি দেখে তাদের ভালো লাগছে। এ কথার মাধ্যমে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন? সাধারণ মানুষ কি এ থেকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাবে না?
গণতন্ত্রের সবচেয়ে সুন্দর দিক হচ্ছে, সমালোচনা শুনতে পারা এবং যদি গঠনমূলক সমালোচনা হয় তাহলে যিনি সমালোচনা করছেন তাকে ও তার সমালোচনাকে আমলে নেওয়া। গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার বিষয়টি আমাদের মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি।
এর কারণে দেখা যায়, যখন একটা দল রাষ্ট্র-ক্ষমতায় থাকে তখন দলটির ভেতর যারা নানান দায়িত্ব পেয়ে থাকে তারা সবসময় সব কাজের প্রশংসা করে থাকে। এতে করে যেটি হয় তা হচ্ছে, অনেক সময় কোনো একটি সিদ্ধান্ত হয়তো দলের পক্ষে যাচ্ছে না, কিন্তু সেটি সঠিক সময়ে বিবেচনা করা সম্ভব হয় না। যখন বিষয়টি বড় আকার ধারণ করে তখন সবাই উপলব্ধি করতে শুরু করে সিদ্ধান্তটি ভুল ছিলো। কেন্দ্র এবং পরিধির দূরত্বও আসলে এইভাবেই সৃষ্টি হয়।
আমাদের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, সমালোচনা করা মানেই বিপক্ষ দলের পক্ষে চলে যাওয়া। এখন সবাই যদি এটি ভেবে সব কাজের শুধু প্রশংসা করতে শুরু করে তাহলে সেটি কতোটা মঙ্গল বয়ে আনবে সেটিও ভেবে দেখা দরকার।
আদর্শিকভাবে যারা সমমনা, তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে বরং যারা এই আদর্শকে ঘৃণা করে, যারা স্বাধীনতার চেতনাকে ঘৃণা করে তাদের থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। তাই সমমনা আদর্শিক মানুষগুলোকে কিভাবে এক সূত্রে, একটি প্লাটফর্মে আনা যায় সেটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি হেফাজতের মতো সংগঠনগুলোকে কিভাবে হেফাজত করা যায় সেটিও ভেবে দেখতে হবে। এজন্য দরকার হলে আলাদা একটা উইংও থাকতে পারে দলের পক্ষ থেকে, যারা এই বিষয়ে আলাদাভাবে নজর দেবে।
আত্মোপলব্ধির একটা জায়গা যেখানে তৈরি হবে, যেখানে বিষয়গুলোকে গঠনমূলক সমালোচনার ভিত্তিতে দেখা হবে এবং তাদের এই ভাবনাগুলো সরাসরি উপর মহলে জানাতে এবং জানতে হবে। তাহলে কেন্দ্র ও পরিধির ব্যবধানও হয়তো ঘুচবে।
আমিনুল ইসলাম: গবেষক ও ও অন লাইন অ্যাক্টিভিস্ট, ইমেইল - tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ০৩০২ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৪