জানি না কেউ কখনো এইভাবে চিন্তা করেছেন কিনা। আমাদের জীবনের যাবতীয় সমস্যাগুলো আমরা কাকে বলি? সবার আগে সৃষ্টিকর্তা কে, খুব প্রিয় কাউকে, বিপদে পড়লে উকিল সাহেবকে, আর আরো একজনকে ।
আঠারো ঊনিশ বছরের যেই ছেলেমেয়েগুলো চোখে মুখে এক রাশ স্বপ্ন নিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে পা রাখে তারা যদি স্বপ্নেও জানতে পারতো তাদের সামনে কি অপেক্ষা করছে! আমার মনে হয় বাঙালি মধ্যবিত্ত তাদের সন্তানদের ওপথে পাঠাতেন না। আমি অবাক হয়ে নতুন পাশ করা ডাক্তারদের দেখি । গত ছয় বছরে যাদের জীবন থেকে ঝরে গেছে অনেকগুলো সুন্দর বিকেল, বৃষ্টিভেজা সকাল , বকুলফুল আর আরো কত কিছু। সারাদেশের তার বয়সী ছেলেমেয়েরা যখন নিদ্রাচ্ছন্ন , এই অভাগারা তখন পরদিনের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সারাদেশ যখন নবর্ষেরর ছুটি কাটায় এরা হোস্টেলে রয়ে যায়, কারণ পরীক্ষা আসছে। সারা পৃথিবী যখন আইপিএলের ম্যাচ দেখে এরা তখন লাশঘরে। সারাদেশ যখন ঈদ আর পূজা-পার্বনে ব্যস্ত এরা তখন হাসপাতাল আগলে বসে আছে। ২০০৬ র রোজার ঈদের পরদিন যখন মেডিসিন ওয়ার্ডে এক তরুণ রোগীকে মৃত ঘোষণা করেছিলাম, আমার ঈদের আনন্দ ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আজকে সকল দোষ দেশের মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নদের। বাঙালি জাতি কবে বুঝবে যে প্রত্যেক টা হাসপাতালের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম পোস্টে আছে এই অভাগা ইন্টার্নরা। যাদের কাজ শুধু কাজ শেখা এবং ওপরের আদেশ পালন করে যাওয়া। অভিজ্ঞজনেরা বলবেন – ওরা নাকি মারমুখি হয়ে উঠছে, রোগী আর তাদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। আমার প্রশ্ন হলো, অবহেলা কাকে করেছে ? রোগীকে করেছে নাকি রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের করেছে?
আমার জানা মতে, যেই ইন্টার্নরা মাত্রই তাদের পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেছে তারা তাদের শেষ রক্তবিন্দু থাকতে কোনো রোগীকে অবহেলা করে না। করা সম্ভব না। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। ইন্টার্র্নির সময় আমাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা বেড ভাগ করে দেওয়া হতো, এক একটা ওয়ার্ডে। যে যার রোগীর দেখভাল করবে। ইন্টার্নদের দেখাশোনার জন্য আছেন সিনিয়র ডাক্তার। সবার ওপরে প্রফেসর। একেকটা হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতা যদি হয় ১০০০, রোগী আসে ১৮০০। সবার সমস্যাই গুরুতর। আমার, আপনার সমস্যাটা হয়ত সিরিয়াস; আমরা ভুগছি। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে শুধু আমি-আপনি না, যারা যাচ্ছে হসপিটালে সবার অবস্থাই আমাদের মত। ইন্টার্নরা সারাদিন এসব নিয়েই আছে। তারা আপনার আমার কাছে একটু সহনশীলতা চাইতেই পারে। নিজেকে একবার ওদের জায়গায় বসিয়ে দেখুন, সারাদিন শুধু সমস্যা নিয়েই কারবার। আপনাকে আজকে ওদের সিটে বসিয়ে দিই; চিকিৎসা দিতে হবে না, শুধু ধৈর্য ধরে মানুষের সমস্যা শুনবেন, গলাপচা ক্ষতগুলোতে একবার হাত বোলাবেন আর মানুষের আহাজারিতে সান্ত্বনা দেবেন। পারবেন?
আমরা যে যার মত শুধু নিজের সমস্যা নিয়েই চিন্তিত, কথায় কথায় আমরা টাকা আর ক্ষমতার গরম দেখাই। উন্নত দেশের উদাহরণ দিই। ক্ষমতার গরমের কোনো প্রতিকার আমার জানা নেই। টাকার গরমের কথা আর নাই বা বললাম। মানতে বাধা নেই আমাদের বড় ডাক্তাররা অনেক অর্থেই বিত্তশালী, কিন্তু এই ইন্টার্নদের বেতন কিন্তু বাড়ির ড্রাইভারের চেয়ে কম। আমার বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে পাতায়া যায় ভ্রমণে, আর আমি ও ইন্টার্ন বন্ধুসকল পতেঙ্গা সৈকতে যাবার অর্থ ও উপার্জন করি না। আমাদের ক্ষমতা নেই, রাঘব বোয়ালদের ধরার, তাই চুনোপুঁটির ওপরে আমরা খবরদারি করে যাচ্ছি। বাকি রইল বাইরের দুনিয়া। পৃথিবীর আর কোন দেশে নিয়ম আছে রোগীর আত্মীয় স্বজনের ওয়ার্ডের ভেতরে ঢুকে হম্বিতম্বি করার আমার জানা নেই। ওটিতে নিতে দেরী হচ্ছে কেন? ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না কেন? এই ঐষধ দিলাম কেন? পৃথিবীর আর কোন দেশে “মিটফোর্ড প্রতিনিধি” / “ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রিতিনিধি” নামক সাংবাদিক আছে কিনা জানা নেই যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুবীক্ষণ যন্ত্রে পরিমেয়। আমাদের সময় আয়নাল(?) বলে একজন প্রতিনিধি ছিলেন, যার প্রধান কাজ ছিল টু পাইস কামানো। এই রকম আয়নালে যদি আজ দেশ ভরে যায়, আমি অধম অন্তত এটা বুঝি যে ওখানে আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
জনপ্রিয় যুক্তি হলো, ডাক্তাররা জনগণের টাকায় লেখা পড়া করে। কথা সত্য। জনগনের টাকায় তো বুয়েট চলে, বিশ্ববিদ্যালয়ও চলে। ওসব জায়গা থেকে যারা পাশ করে যায়, চাকরি করে, তারা দায়মুক্তির জন্য কি করে? তাদের জবাবদিহির জন্য কোথায় যেতে হয়? মানলাম ,তারা কেউ জীবনরক্ষার কাজ করে না। সাথে সাথে এটাও মানতে হবে, তাদের কারো গায়েই এই সার্টিফিকেটও নেই যে, প্রয়োজনে তাদের গায়ে হাত তোলা যাবে। কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখবেন বিষয়টা।
আমরা জন্ম এক মহিয়সী ডাক্তারের হাতে, পরবর্তী সময়ে বেশ ক’জনের কাছে সেবা নিয়েছি, ২০০২-এ ডেঙ্গু হয়ে যখন যমে-মানুষে টানাটানি, সেবারও বাঁচিয়েছেন আরেকজন ; এভাবে সারাজীবন শুধু নিয়েই গেছি। বিনিময়ে কি দিয়েছি জানি না, আজো চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা শপথ নিয়েছিলাম পেশাগত জীবনে প্রবেশের পূর্বে, তার ঋণ এখনো শোধ হয়নি। মাঝেমাঝে হতাশ লাগে আশেপাশের খবরে, পরক্ষণেই মনে হয় সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। বিধাতা এই অধম ‘কসাই’কে আর কিছু না হোক, মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার ক্ষমতা দিয়েছেন, অসংখ্য মানুষের আশীর্বাদ নেবার যোগ্যতা দিয়েছেন। নাইবা পেলাম মারপিট-করা কিছু মানুষের সন্মান। আমার বা আমার মত কিছু কসাইয়ের সন্মান তাতে এতটুকু কমেনি।
"আমি অকৃতী অধম বলেও তো
কিছু কম করে মোরে দাওনি ৷
যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তো কিছু নাও নি৷
তব আশিস-কুসুম ধরি নাই শিরে
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে৷
তবু দয়া করে কেবলই দিয়েছো
প্রতিদান কিছু চাওনি৷
আমি ছুটিয়া বেড়াই, জানি না কি আশে
সুধা পান করে মরি গো পিয়াসে,
তবু যাহা চাই সকলি পেয়েছি
তুমি তো কিছুই পাওনি ৷
আমায় রাখিতে চাহো গো বাঁধনে আঁটিয়া
শতবার যাই বাঁধনও কাটিয়া৷
ভাবি ছেড়ে গেছো
ফিরে চেয়ে দেখি এক পা-ও ছেড়ে যাও নি৷ "
ড. সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী চিকিৎসক
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৪