তিনি, গৌতম বুদ্ধ, জন্মেছিলেন আড়াইহাজার বছরেরও আগে এই উপমহাদেশে। যিনি বিশ্বাস করতেন, মানব কল্যাণ, মানব মুক্তি, মানব মৈত্রী আর মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সম্প্রীতিই জগতকে শান্তির পরিধিতে আশ্রিত করতে পারে।
এই বিশ্বে জন্ম নিয়ে বৌদ্ধ করুণাঘন অন্তরে যে দর্শন ও বাণী পরিবেশন করেছেন, তাতে বিশ্বমৈত্রীই ব্যাপকতা লাভ করেছে। বিশ্বের সকল প্রাণীর সার্বিক মঙ্গলের জন্য তাঁর পরিবেশিত দর্শন ও বাণী পৃথিবীতে এক অসাধারণ অধ্যায়ের সূচনা করে। হিংসা-দ্বন্দ্বযুক্ত সমাজের বিপরীতে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নির্মাণে মৈত্রীময় চেতনাকে স্থাপন করার কথা বলেছেন বুদ্ধ। বিশ্বমৈত্রীর ভাবনা ছাড়া মানুষের সুখ-শান্তি যে সম্ভাবনারহিত, আড়াইহাজার বছর আগে বুদ্ধ তা উচ্চারণ করেছিলেন। চেয়েছিলেন ‘তুমি যেমন সুখে থাক, অপরকেও সুখে থাকতে দাও’। বুদ্ধের মৈত্রী ভাবনাই তো হচ্ছে, অপরের সুখ ও হিত কামনা করা। সৃষ্ট জগতকে খণ্ড খণ্ড করে নানা দেশ, নানা জাতি হিসেবে দেখার নাম যে মানবতা নয়, তা উল্লেখ করে বুদ্ধ বলেছিলেন, সমস্ত বিশ্ব ও প্রাণীলোককে অখণ্ড হিসেবে দেখার নামই মানবতা। মানুষ মাত্রই সমান। মানুষের প্রতি মানুষের হিংসা ও বৈষম্য পরিহার করতে হবে। ধর্মের বা দেবতার নামে প্রাণীবধ বন্ধ করতে হবে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলবে না। মানুষকে তার আপন মর্যাদা দিতে হবে। কোনো প্রাণীকে হিংসা করা যাবে না। সব প্রাণীর প্রতি দয়া ও মৈত্রী পোষণ করতে হবে।
বিশ্বে যখন বিপন্ন মানবতা, মনুষ্যত্ব বিকাশের চরম বিপর্যয় অবস্থা, ধর্মের নামে অর্ধমের প্রসার- তখন বুদ্ধের আবির্ভাব। বর্ণে বর্ণে জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব সমাজজীবনকে করেছিল পঙ্গু। যখন হানাহানি, অহিংসা, অশান্তি, বিবাদ, দ্বন্দ্ব, বৈষম্য মানুষকে নিপীড়নের শিকারে পরিণত করেছে, অধিকারহারা মানুষের গরিষ্ঠতা কেবলই বেড়ে চলেছে, তখন এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ব্যাকুল মানুষ। কিন্তু কে তাদের উদ্ধার করবে— পরিস্থিতি তখন এমনই এক সংশয়ে দোলায়িত। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সে প্রসঙ্গে লিখলেন, ‘তখন বিশুদ্ধাত্মা শাক্যসিংহ অনন্তকালস্থায়ী মহিমা বিস্তারপূর্বক, ভারতাকাশে উদিত হইয়া, দিগন্ত প্রধাবিত রূপে বলিলেন— আমি উদ্ধার করিব। আমি তোমাদিগকে উদ্ধারের বীজমন্ত্র দিতেছি, তোমরা সেই মন্ত্রসাধন কর। তোমরা সবাই সমান। ব্রাহ্মণ শূদ্র সমান। মনুষ্যে মনুষ্যে সকলেই সমান। সকলেই পাপী। সকলেরই উদ্ধার সদাচরণে। বর্ণ বৈষম্য মিথ্যা। সুখ মিথ্যা, কে রাজা, কে প্রজা, সব মিথ্যা। ধর্মই সত্য। মিথ্যা ত্যাগ করিয়া সকলেই সত্যধর্ম পালন কর”। বঙ্কিমচন্দ্র গৌতমবুদ্ধকে বলেছেন, ‘পৃথিবীর প্রথম সাম্যাবতার। ’
আড়াইহাজার বছর আগেও বিশ্ব পরিপূর্ণ ছিল হানাহানিতে। দূর্যোগের কালো মেঘ ছিল সর্বত্রই। প্রেম, প্রীতি, উদারতা, করুণা, স্নেহ, মমতা প্রভৃতি মানবিক গুণগুলো লোপ পেতে বসেছিল। শ্রদ্ধা, ভালবাসা, মায়া, মমতা, আত্মবিশ্বাসেও ছিল ঘাটতি। সততার, আলো ছিল অজস্র দূরে। একটু ভালবাসার স্পর্শ আর সমাজবদ্ধ শান্তিময় জীবন ছিল দূরঅস্ত ! গৌতম বুদ্ধ যুক্তির অনুশীলনে বিশ্বমানবের মধ্যে ত্যাগতিতিক্ষা, ক্ষমা, অহিংসা, শান্তি ও কল্যাণের বাণী ছড়িয়েছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচাতে সাম্য-মৈত্রীর কথা বলেছেন। এক অখণ্ড সমাজ এবং পৃথিবীর সব মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য পরম আত্মীয়তার সূত্রে গ্রথিত— এ তথ্য তিনিই প্রথম প্রচার করেন। মানুষে মানুষে সংঘাত, অন্ধ কুসংস্কার, জাতিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে বুদ্ধই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি কামনা করেছিলেন এমন এক সমাজের, যেখানে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। একে অপরের কল্যাণ কামনা করে। সমস্ত মানুষের কল্যাণ; সমগ্র জাতির শান্তি— এই ছিল বুদ্ধ’র বাণী ও দর্শনের মূল কথা। দীর্ঘ আড়াইহাজার বছরেরও আগে বুদ্ধ এমন বাণী প্রচার করেছেন, যার লক্ষ্য বিশ্বশান্তি ও মানব কল্যাণ। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা; শ্রৈণী বৈষম্যহীন এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদি যে সব আদর্শের কথা আধুনিক পৃথিবীতে বলা হয়, সুদূর অতীতেই এসব প্রচার করেছেন বুদ্ধ। তাঁর প্রচারিত বাণী ও দর্শনে অত্যাচার বা উৎপীড়নের নজির নেই। ত্যাগ আর মৈত্রীর বাণী দিয়ে তিনি মানুষকে আপ্লুত করেছেন। সেনা, অস্ত্র, লুন্ঠন, পীড়ন এবং অত্যাচারের কোনো স্থান সেখানে ছিল না। সমস্ত প্রাণীজগতের প্রতি অনাবিল একাত্মভাব প্রকাশ করাই ছিল বুদ্ধের বিশ্বমৈত্রী ভাবনা। আর এই বিশ্বমৈত্রীই বিশ্বশান্তির এক এবং অদ্বিতীয় উৎস। এখানেই মহামনীষী বুদ্ধের জীবন, দর্শনের চির প্রাসঙ্গিকতা এবং বৈশাখি পূর্ণিমারও।
যুদ্ধের মূল কারণ হচ্ছে প্রতিহিংসা। যুদ্ধ অপরিহার্য বা ইতিহাসের অপরাজেয় বলতে কিছু নেই। মানুষের শক্তি রয়েছে নিজেকে দমন করার। তাই বুদ্ধ বলেছেন: ‘যো সহস্সং সহসসেন সঙ্গামে মানুষে জিনে/একঞ্চ জেয়্যমত্তানং স বে সঙ্গামজুত্তমো। /’- যে ব্যক্তি যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে জয় করে, তার তুলনায় যিনি কেবল নিজেকে জয় করেন, তিনিই সর্বোত্তম সংগ্রাম জয়ী। সর্বজীবের হিতের জন্য, সুখের জন্য কল্যাণের জন্যই মানব জীবন। বুদ্ধের এই আদর্শকে সাম্যবাদও বলা হয়েছে। বুদ্ধ তাঁর ভাবনায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এমনকী রাষ্ট্রের সীমারেখাকে অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব মানবজাতি থেকে শুরু করে দেবতা এবং ব্রহ্মা থেকে শুরু করে ইতর প্রাণী পর্যন্ত সমানভাবে ঠাঁই পেয়েছেন।
বুদ্ধ যে দর্শন প্রচার করেছেন মানব কল্যাণে তা হচ্ছে মানব ধর্ম। ইহলৌকিক মানবের জীবনধারার প্রবাহমানতায় পাপপুণ্যের সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। অনুসারী ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বলেছেন’ ‘চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়,/ লোকানুকম্পায় অত্তায় হিতায় সুখায় দেবমনুসানং। ’ অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, দেবতা ও মানুষের কল্যাণের জন্য তোমরা দিকে দিকে বিচরণ করো। তোমরা সদ্ধর্ম প্রচার করো। যার আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ, যা অর্থযুক্ত; ব্যঞ্জনযুক্ত ও পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রচার করো।
বুদ্ধের বাণী ও দর্শনের আদর্শ হলো বিশ্বের সব মানুষ তথা জীবজগতের মহাকল্যাণ সাধন করা। তাঁর শিক্ষা ভালোবাসা আর দয়ার কথায় পূর্ণ। তাঁর কাছে ছোট-বড় ধনী-দরিদ্র সবই সমান ছিল। অন্যদের পরনির্ভরশীল না হয়ে বলতেন স্বনির্ভর হওয়ার জন্য। অহিংসামন্ত্রে উদ্দীপ্ত সাম্য-মৈত্রী-করুণার বাণী নির্বাণসমৃদ্ধ ধর্মাদর্শ, জাতিভেদহীন সর্বমানবিক মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীনচিন্তা প্রকাশের ক্ষমতা ও অন্যায় অসত্য-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলনের বাণী বিশ্ববাসীকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে বৃহৎ ও মহৎ— এর মধ্যে পরম অমৃতকে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। বুদ্ধ সর্বজীবে মৈত্রী চেয়েছিলেন। আড়াইহাজার বছর পরও সে চাওয়া সর্বজীবেই রয়ে গেছে। মৈত্রীর বাণী এখনো শোনা যায়।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১১২৬ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৪