বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের অনেকাংশ দখল করে রেখেছে। জুলিয়াস সিজারের পেছনে মার্ক এন্টনির আর ব্রুটাসের ছায়া দূরাগত অতীত থেকে আজও নাড়া দেয়।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিজ্ঞতার বাইরে নেই। এখানে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বহু নেতা রাজনৈতিক জিঘাংসায় নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মুজিব-জিয়ার সঙ্গে তাহের, মঞ্জুর, সিরাজ শিকদার, কিবরিয়া, ময়েজউদ্দিন, আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ বহুজনের নাম পাওয়া যাবে। দুঃখের বিষয়, এসব হত্যাকাণ্ডের সবগুলোর বিচার সম্পন্ন হয়নি। অনেকগুলোই রয়ে গেছে রহস্যের ঘেরাটোপের আড়ালে। এর ফলে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ ব্যাপকতর হয়েছে। কখনও কখনও রাজনীতি আর সাধারণ অপরাধ মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। অপরাধীরা রাজনৈতিক অবস্থানকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে অনেক অপকর্ম সম্পন্ন করেছে। এসব কথা মনে পড়ল, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ‘সেভেন মার্ডার’-এর অপহরণ, গুম ও হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রেক্ষাপটে। কারণ ৪০ বছর আগে বাংলাদেশ প্রকম্পিত হয়েছিল ‘সেভেন মার্ডার’-এর নামে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে কোহিনূরসহ সাতজন তরুণ ছাত্র নিহত হয়। ২০১৪ সালে নিহত হয়েছে সাতজন ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে।
আইন-শৃঙ্খলা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সুশাসনের একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। এটি যখন নস্যাৎ হয় বা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, তখন জনমনে ব্যাপক ভীতি আর উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ফেসবুকে উদ্বেগের মতো শ’ শ’ উৎকণ্ঠিত মন্তব্য পাওয়া গেছে। নাগরিক সমাজের এক বা একাধিক প্রতিবাদও লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছে গণঅনশন কর্মসূচির মাধ্যমে। এমন কি মানবাধিকার কমিশনের পক্ষেও উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, সর্ষের ভেতরেই ভূত রয়েছে। আগে সেই ভূতটিকে চিহ্নিত করুন। ‘চাটুকারদের’ কাছ থেকে দূরে থাকতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন তিনি। বরগুনায় মানবাধিকার কর্মী সমাবেশ উদ্বোধনকালে তিনি দেশের বর্তমান অবস্থা ‘চরম ভীতিকর’ উল্লেখ করে বলেন, আমরা অনেক আগেই আপত্তি তুলেছি, সাদা পোশাকে যেন কাউকে আটক করা না হয়। এখন অবস্থা যখন ভীতির পর্যায়ে চলে গেল, তখন প্রজ্ঞাপন করে সাদা পোশাকে কোন অভিযান না চালাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। কোন অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করতে হলে অবশ্যই পোশাক পরা অবস্থায় এবং সংশ্লিষ্ট বাহিনীর পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) দেখাতে হবে। এমনকি যাকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হবে অবশ্যই সেই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাক্ষী রেখে আটক করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা হলে দেশে খুন, গুম, অপহরণের এই ভয়ানক অবস্থা অনেকাংশে কমে যাবে। ড. মিজানুর বলেন, এরকম একটি বিষয় নিয়ে যদি শুধু রাজনৈতিক খেলা চলতে থাকে, তাহলে কিন্তু সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হবে না। পারস্পরিক দোষারোপ সমস্যার সমাধান না। মানুষ অপহৃত হচ্ছে, গুম হচ্ছে, নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। আটক বাণিজ্য চলছে। এসব বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আহ্বান জানান তিনি। জানি না, এসব আহ্বান ও আর্তি নিকট-অতীতের মতোই অরণ্যের রোদনে পরিণত হবে কিনা! হলে, মানুষের উদ্বেগ আর বিপদ মুক্তির পথও অচেনা আর অধরাই থেকে যাবে। আর তাহলে ঘোরতর মানসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-আইন-শৃঙ্খলাগত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-বিপদের অতল গহ্বরের মধ্যেই বাধ্য হয়ে বসবাস করতে হবে বাংলাদেশের মানুষদের।
আসলে মানুষকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত রাখা সুশাসনের অন্যতম লক্ষ্য; রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। বাংলাদেশে চলমান গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হত্যা ও সন্ত্রাস এক বিরাট সমস্যা। এ সমস্যা গণতান্ত্রিক সুশাসনের বিরুদ্ধে এক বিরাট চ্যালেজ্ঞ স্বরূপ। বিশ্বে অতীতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নানা কারণে ব্যাহত হলেও বর্তমানে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতির দেশের ইমেজে কালিমা লিপ্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশের বাইরে ভুল বার্তা যাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও অগ্রগতির সংগ্রাম এই বিরূপ পরিস্থিতির কারণে কিছুটা হলেও ব্যাহত হতে বাধ্য। এর আগে নানা ঘটনায়-দুর্ঘটনায় পোষাক শিল্প হোঁচট খেয়েছে এবং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অবস্থা প্রায় সঙ্কুল থাকে। এখন যদি আইন-শৃঙ্খলা ও হত্যাযজ্ঞের কারণে খোদ নাগরিকগণই বিপন্ন বোধ করেন, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা আত্মশক্তি হারাবো এবং বিশ্বের চোখে পিছিয়ে যাবো। এটা কখনও কাম্য হতে পারে না। জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে টিতে থাকতে হলে বাঁধার প্রাচীর সরিয়ে সামনে এগুতে হবেই। এবং এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আইনের শাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে মানুষের উদ্বেগ দূর করতে হবে এবং বিদেশে আমাদের উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনরূপ আপোস করা চলবে না।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৪