(ড. সুরঞ্জনা’র আত্মপক্ষ সমর্থনের জবাবে)
ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের হাটে তোতা মিয়া ডাক্তার সর্বরোগের মহৌষধ বিক্রি করতেন। সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত সব ধরনের রোগের চিকিৎসা করতেন তিনি।
তোতা মিয়ার চিকিৎসায় কে কবে সুস্থ হয়েছেন জানা নেই তবে হাটে তার ‘উন্মুক্ত’ চেম্বারে রোগীর ভিড় লেগেই থাকতো।
ড. সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান, এই তোতা মিয়াকে যদি আমরা বাংলাদেশের ডাক্তারদের প্রতীক হিসেবে ধরে নেই এবং বলে দেই, তোতা মিয়া ডাক্তারদের দিয়ে দেশ ভরে আছে? যদি তোতা মিয়াকে দেখিয়ে বলি, এই হচ্ছে বাংলাদেশের ডাক্তারদের শিক্ষাগত যোগ্যতার অবস্থা, তাহলে, আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে?
আপনি নিশ্চই বলবেন, সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের ডাক্তারদের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই, চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কেও কিছুই জানি না। এবং আপনি আমাকে জেনে নিয়ে লেখার জন্য মূল্যবান উপদেশও দেবেন। যদি কিছু মনে না করেন, আপনি যখন ‘মিটফোর্ড প্রতিনিধি আয়নাল’ এর উদাহরণ দিয়ে লেখেন, ‘এই রকম আয়নালে যদি আজ দেশ ভরে যায়...’ তখন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আপনার জানা-শোনা কিংবা চোখ-কান খোলা রাখা নিয়ে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আরও সাধারণভাবে ধারণা হয়, মেডিকেল কলেজে যেনতেনভাবে একটা প্রেসক্রিপশন লেখার বিদ্যা এবং ওষুধের নাম মুখস্ত করার বাইরে ডাক্তাররা আর কিছু জানেন না বা শেখেন না বলেই দেশের অন্য পেশাজীবীদের এভাবে ‘আয়নালিকরণ’ করে দেখতে পারেন!
ড. সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান, ডাক্তারদের মধ্যে যেমন হাতুড়ে তোতা মিয়া আছে, ভুয়া ওহাব খানরা (ওহাব খান সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত তথ্য আছে) আছে, সাংবাদিকতাতেও কিছু ‘আয়নাল’ আছেন। কিন্তু তোতা মিয়ারা যেমন চিকিৎসক সমাজের প্রতীক নন, তেমনি ‘আয়নালরাও’ সাংবাদিক সমাজের প্রতীক নন।
সাংবাদিকতায় আগেও অনেক প্রথিতযশা বিদ্যানরা ছিলেন, এখনও আছেন। বিশেষ করে বর্তমানে পেশাদার সাংবাদিকতায় যারা আসছেন তাদের নব্বই শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। স্থানীয় এবং আর্ন্তজাতিক সংস্থা এখন নিয়মিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে। বিটওয়ারী কিংবা বিষয়ভিত্তিক রিপোর্ট যারা করেন, তাদের অনেকের রিপোর্ট গবেষণাপত্রের মতোই বিবেচনা করা হচ্ছে। আপনি পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে এতো বিচিত্র সব বিষয়ে কতো রিপোর্ট দেখছেন, আপনার মনে হচ্ছে, ‘আয়নালরা’ এগুলো সব লিখতে পারেন?
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ‘মিটফোর্ডের আয়নালরা’ মার খাচ্ছেন না, মার খাচ্ছেন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকরাই। বরং ‘আয়নালদে’র সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক খুব ভালো। নাম না জানা বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার (হাল আমলে আন্ডারগ্রাউন্ড অনলাইন মাধ্যমও অসংখ্য গজিয়েছে) প্রতিনিধি এই ‘আয়নালরা’ শুধু নিজেরাই শুধু ‘টু পাইস’ কামান না, ডাক্তারদের জালিয়াতির সহযোগী হিসেবেও তাদের জুড়ি নাই। প্রায় প্রত্যেক হাসপাতালের পাশেই এসব আয়নালদের একটা কিংবা দু’টো ওষুধের দোকানও দেখা যায়। যার ওষুধের একটা বড় অংশের সাপ্লাই সরকারি হাসপাতাল থেকে আসে বলে শোনা যায়। হাসপাতালের বড় ডাক্তার সাহেবদের যে ‘সিক্রেট’ ক্লিনিক ব্যবসার কথা শোনা যায়, সেখানেও রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কাজে আয়নালরা সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। এ কারণে তারা কখনোই আক্রান্ত হন না। আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকেরা, যারা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্ততে অনিয়ম কিংবা জালিয়াতির অনুসন্ধানে যাচ্ছেন।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন দেশের স্বাস্থ্যখাতের স্বনামধন্য সাংবাদিক শিশির মোড়ল শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেদম মারধরের শিকার হয়েছেন বলে খবর এসেছে। শিশির মোড়ল কোন মানের সাংবাদিক দয়া করে বিএমএ’র বর্তমান কিংবা সাবেক নেতাদের কাছে খোঁজ নিলে ভালো করে জানতে পারবেন। তার নাম জানেন না স্বাস্থ্যখাতে এমন দায়িত্বশীলদের সংখ্যা খুবই কম।
জয়নুল হক শিকদার কার্ডিয়াক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে এ ওহাব খান বলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন যিনি কোনোদিন কোনো মেডিকেল কলেজে পড়েননি, ছিলেন পাবনার এক ওষুধের দোকানের সহকারী। পরে আর এক চিকিৎসকের সার্টিফিকেট নকল করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে যান আর তাকে বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয় শিকদার কার্ডিয়াক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার।
এ ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য ‘অজ্ঞ থেকে বিশেষজ্ঞ’ শিরোনামে প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিলেন শিশির মোড়ল। পরে বিএমডিসি’র অনুসন্ধানেও তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হয়। গত মঙ্গলবার শিশির মোড়ল সফিউল আযম নামে আর এক ডাক্তারের জালিয়াতির অনুসন্ধান করছিলেন। এই সফিউল আযমের সাইনবোর্ডে সহকারী/সহযোগী/অধ্যাপক লেখা। একজনের পদ কয়টা হয়? শুধু তাই নয় সফিউল আযম সরকারি চিকিৎসক হয়েও নিয়ম না মেনে শিকদার মেডিকেল কলেজে স্থায়ীভাবে নিয়োগ নিয়ে দুই স্থায়ী চাকরি একসঙ্গে করছেন। এটা সরকারি নিয়মেও যেমন কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তেমনি শিকদার মেডিকেলের নিজস্ব নীতিমালাতেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ যেটা পরে শিকদার মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষও বলেছে।
শিশির মোড়ল টেলিফোনে সফিউল আযমের বক্তব্য চেয়েছিলেন। সফিউল আযম তাকে বক্তব্য নেওয়ার জন্য হাসপাতালে ডাকেন এবং হাসপাতালে যাওয়ার পর তাকে নিজের কক্ষে না নিয়ে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে আগে থেকে তার আরও কয়েকজন সহযোগী ছিলেন, যারা শিশির মোড়লকে বেদম মারপিট করেন। আশা করি, সাংবাদিকরা কেন হাসাপতালে মার খাচ্ছেন ড. সুরঞ্জনার কাছে এখন অনেকটা পরিস্কার হবে।
আর একটা ঘটনার উদাহরণ দেই। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উত্তরা শাখায় ব্যবসায়ী রোকন উদ্দিন মিলন গিয়েছিলেন পেটে ব্যথা নিয়ে ডা. রুহুল আমীনের কাছে। তিনি এন্ডোস্কেপির জন্য পাঠালেন ডা. আনোয়ারুল কবীরের কাছে। ডা. কবীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবসায়ী মিলনকে জানান, তার খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হয়েছে, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ মেডিকেলে একজন বিশেষজ্ঞ সার্জনও ঠিক করে দেন তিনি। কিন্তু মিলন তার এক আত্মীয়ের পরামর্শে দেশের আর একজন নামকরা প্রবীণ চিকিৎসক ডা. খাদেমুল ইসলামের কাছে অপারেশনের জন্য যান। পপুলারের ডায়াগনসিস রিপোর্ট দেখে ডা. খাদেমুল নতুন করে পরীক্ষা না করেই অপারেশন করান এবং দেখতে পান ক্যান্সার দূরের কথা, মিলনের খাদ্যনালীতে আলসার পর্যন্ত নাই।
পরে এ বিষয়টি নিয়ে বৈশাখী টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক অনুসন্ধান করেন। বের হয় চমকপ্রদ তথ্য, পপুলারের এই ডাক্তার চক্র দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া ডায়াগনসিস রিপোর্ট দেখিয়ে দূরারোগ্য অসুখের কথা বলে অপারেশনের নাটক করে মোটা টাকা আদায় করে আসছিলেন সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে। পপুলারের ওই দুই ডাক্তারের বক্তব্য নেওয়ার জন্য বার বার তাদের ফোন করেও পাওয়া যায়নি। পরে বৈশাখীর রিপোর্টার কৌশলে ক্যামেরা নিয়ে পপুলার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। ওই বক্তব্যে ডাক্তাররা নিজেদের দোষ বেমালুম অস্বীকার করেন।
পরে পপুলার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানাজানি না করে ব্যবসায়ী মিলনকে সমঝোতার প্রস্তাব দেন এবং ভুল স্বীকার করে রিপোর্ট প্রচার বন্ধ করারও চেষ্টা করেন। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি, রিপোর্টটি বৈশাখীতে প্রচারিত হয়।
এ উদাহরণটা তুলে ধরার একটা কারণ আছে। সাধারণত, হাসপাতালে কোনো হাই প্রোফাইল সেলিব্রেটির অসুখ-বিসুখ হলে সাংবাদিকরা দল বেঁধে হাসপাতালে যান, খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। আর চিকিৎসা নিয়ে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ পেলে তার অনুসন্ধানে যান। ইন্টার্ন ডাক্তারদের অনেকেই বলেন, হাসপাতালে অনিয়মের অনুসন্ধানের দায়িত্ব কে দিয়েছে সাংবাদিকদের? সাংবাদিকরা গোপনে ঢুকে চোরের মতো অনুসন্ধান করছেন বলেও ডাক্তাররা বলেন!
সত্য হচ্ছে, এই ডাক্তাররা সাংবাদিকতা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণাও রাখেন না। কেউ অসুস্থবোধ করলে যেমন ডাক্তারের কাছে যান, আইনগত সহায়তার জন্য যেমন উকিলের কাছে যান, নিরাপত্তাহীনতায় যেমন পুলিশের কাছে যান তেমনি কোথাও কোনো ব্যক্তির অধিকার ক্ষুন্ন হলে, কোথাও অন্যায়ের শিকার হলে কিংবা যেখানে প্রতিকার পাওয়ার কথা সেখানে প্রতিকার না পেলে তারা সাংবাদিকের কাছে আসেন। অন্যান্য ব্যক্তি বা পেশাজীবীর মতো ডাক্তাররাও তাদের কোনো কোনো দাবি সরকারের কাছ থেকে আদায় না করতে পারলে গণমাধ্যমের সামনে আসেন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কিংবা পত্রিকায় বিবৃতি পাঠিয়ে।
কেউ যখন সাংবাদিকের কাছে তার অধিকার ক্ষুন্নের কথা জানান কিংবা অন্যায়ের শিকার হওয়ার তথ্য জানান, তখন সেই তথ্যের অনুসন্ধান সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব। অবশ্যই যেখানে অনুসন্ধানের জন্য যাওয়া হবে সেখানে নৈতিকতা এবং পেশাগত সততা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েই সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু পপুলারের ওই অভিযুক্ত ডাক্তারদের মতো যখন অনেকেই নিজেদের অন্যায় সম্পর্কে বক্তব্য দিতে চান না কিংবা পাশ কাটিয়ে যেতে চান তখন সাংবাদিকদের তার বক্তব্য কিংবা তথ্য সংগ্রহে কৌশল অবলম্বন করতে বাধ্য হতে হয় অথবা ‘বক্তব্য পাওয়া যায়নি’ উল্লেখ করে খবরটা প্রকাশ করতে হয়।
যেমন ধরুন, বারডেমের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহুমুদুল হাসান মুনীরের দায়িত্বহীনতায় পাইলসের অপারেশন করাতে গিয়ে অকালে মারা গেলেন তরুণ কার্ডিওলজিস্ট ডা. ইমরান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ডা. মুনীরের ভুল এনেসথেসিয়া প্রয়োগ এবং পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার বিষয়টি উঠে আসে এবং তার শাস্তিরও সুপারিশ করা হয়। এ খবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে ডা. মুনীরের বক্তব্য জানার জন্য বারডেম কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের কোনো ধরনের সহায়তা করেননি, সাংবাদিকরা সহযোগিতা চেয়েও পাননি। এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা কি খবরটা প্রকাশ করবেন না? প্রকাশ করলে একতরফাভাবে ডা. মুনীরের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার অভিযোগ উঠলেও তার দায় কি সাংবাদিকদের?
কর্মস্থলে আমার পদস্থ একজনের মাধ্যমে একবার এক নামকরা কার্ডিওলজিস্ট আমাকে ডেকেছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী আর এক ডাক্তারের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের তথ্য দেওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় তার চেম্বারে যাওয়ার পর তিনি আমাকে দু’ঘন্টা ধরে তার সহকর্মীর বিরুদ্ধে তথ্য দিলেন, কিভাবে লিখতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। দু’ঘন্টা পার হওয়ার পর একজন রোগী প্রায় জোর করে চেম্বারে ঢুকে বললেন, তারা আর কতোক্ষণ বসে থাকবেন? আমি অবাক হলাম। তাকে বললাম, রোগীদের বসিয়ে রেখে আমাকে এখন তথ্য না দিলেও চলতো। পরে ফ্রি টাইমে আসতে পারতাম। তিনি বললেন, রোগীকে কতোক্ষণ বসিয়ে রাখবেন এটা ভাববার বিষয় তার, আমি যেন এ নিয়ে কথা না বলি।
বাইরে বের হয়ে দেখলাম, ৩১ জন রোগী বসে আছেন। একজন এসেছেন জয়পুরহাট থেকে, সিরিয়াল নিয়েছেন ১৭ দিন আগে। একজন সিলেট থেকে। জয়পুরহাটের রোগী রাতেই আবার ফিরে যাবেন, সিলেটের রোগী পরের দিন সকালে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে বসে আছেন, রাত তখন সোয় নয়টা। সত্যিই নামকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দায়িত্ববোধ দেখে বিস্মিত না হয়ে পারি না! এই ডাক্তারের চেম্বারে ক্ষোভের সঙ্গে যদি অনভিপ্রেত কিছু ঘটান রোগী কিংবা তার স্বজনেরা, তখন কতোটা দোষ দেবো আমরা?
সরকারি হাসপাতাল এখন পর্যন্ত সাধারণ রোগীদের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। পাঁচ তারা হোটেলের মতো করে সাজানো বড় বড় বিশেষায়িত হাসপাতালে সাধারণ মানুষের যাওয়ার সাধ্য নেই। এসব হাসপাতালে সবাইকে চিকিৎসাও দেওয়া হয় না। সরকারি হাসপাতাল একমাত্র জায়গা যেখানে এখন পর্যন্ত কিছু না কিছু সেবা সাধারণ মানুষ পান, সেবা না পেয়ে ফিরে আসার ঘটনা নেই বললেই চলে। আর এখানে সার্বক্ষণিক সেবা দেন ইন্টার্ন এবং অনারারি চিকিৎসকরা।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই তরুণ চিকিৎসকরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই সেবা দেন। অনেক সময় জরুরি বিভাগে এতো রোগী আসেন, সেখানে দুই তিনজন ডাক্তারের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তাদের সমস্যা একটাই, অনেক সময়ই তারা মেজাজ সামলে রাখতে পারেন না। হুটহাট ধমক দিয়ে বসেন রোগীদের, ওয়ার্ডবয়দের ধাক্কা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়। তাদের হাড়ভাঙ্গা শ্রম আর আন্তরিকতা চাপা পড়ে ওই খিটখিটে মেজাজ সামনে চলে আসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন ছাত্র তখন দু’জন ডাক্তার ছিলেন আচরণের দিক থেকে বিপরীতমুখী। একজন ডা. মাসুদ চরম দুর্ব্যবহারের জন্য অনেকবার শিক্ষার্থীদের হাতে মারধর খেয়েছেন। একবার এক ছাত্রের একশ’ তিন ডিগ্রি জ্বর। বন্ধুরা কোনো রকমে ধরে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে ডিউটি ডাক্তারের কক্ষে বসিয়েছেন। তখন ডা. মাসুদ সিটে নেই। কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারেন না। মিনিট দশেক পরে তিনি হন্তদন্ত হয়ে হয়ে ঢুকলেন। ঢুকে নিজের সিটে বসেই জ্বলে উঠলেন। রোগীকে কেন তার সামনের চেয়ারে বসানো হয়েছে, গলা ফাটিয়ে জানতে চাইলেন। বললেন, তার সামনের চেয়ারে সহযোগী অধ্যাপকের নিচে কারও বসার নিয়ম নেই। আর সামান্য থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট, এতো বড় আস্পর্ধা! বন্ধুরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, প্রচণ্ড জ্বর, সে দাঁড়াতে পারছে না, তাই বসানো হয়েছে।
ডা. মাসুদ ‘স্ট্যান্ড আপ’ বলে চিৎকার করে বললেন, আরও দশ মিনিট পরে তাকে দেখবেন, এটাই ওই চেয়ারে বসার শাস্তি। এখন দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ডা. মাসুদ আবার কক্ষের বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন এবং অনিবার্যভাবে বন্ধুদের হাতে মারধরের শিকার হলেন।
অথচ এই মেডিকেল সেন্টারেই ডা. খলিল নামে একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি যখন ডিউটিতে থাকতেন, সামনে লম্বা লাইন পড়তো। কারণ, তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন, যত্ন নিয়ে দেখতেন, তার সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসা নিতে হতো না।
যিনি ভালো আচরণ জানেন না, তিনি কখনও ভালো ডাক্তার হতে পারেন না। সাংবাদিকদের জন্যও আচরণের বিষয়টা খুব জরুরি। টেলিভিশন রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যানদের আচরণ মাঝে মধ্যে খুবই অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দেয়। যে রিপোর্টার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খারাপ আচরণ করেন, তিনি কখনও ভালো রিপোর্টারও হতে পারেন না।
এখন হয়েছে আর এক সমস্যা। ডজনখানেকের বেশি টেলিভিশন চ্যানেল। কোথাও কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে রোগীদের সাধারণত কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সরকারি হাসপাতাল না পাওয়া গেলে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। একদিকে মুমূর্ষু রোগীর ভিড়, অন্যদিকে টেলিভিশন ক্যামেরার ছোটাছুটি, ডাক্তারদের মাথা পাগল হওয়ারই যোগাড়!
আবার রানা প্লাজায় ধস, তাজরীনে আগুনের মতো বড় ঘটনার সময়ে হাসপাতালের চিত্রও সাংবাদিকদের জন্য জরুরি গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং সেটা সাধারণ মানুষ জানতেও চান। রানা প্লাজা ধসের সময় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজে কিংবা সিআরপিতেও সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা, মারধরের মতো কিছু তো ঘটেনি! এর কারণ ছিল, এখানে কর্তৃপক্ষের যারা ছিলেন, তারা নিজেরাই তাৎক্ষণিকভাবে একটা ব্যবস্থা করে ফেলেন। টেলিভিশনের যারা যাচ্ছিলেন, তাদের অনুরোধ করেন, একসঙ্গে দুই জনের বেশি এক ওয়ার্ডে না ঢুকতে। এবং পাঁচ মিনিটের বেশি সময় না নিতে। সাংবাদিকরা সেটা মেনে নিয়েছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতমলীর ঘটনার পর যখন একের পর এক মুমূর্ষু রোগীরা এসেছিলেন, তখনও কিন্তু বার্ন ইউনিটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কারও কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।
সমস্যা তৈরি হয় জরুরি বিভাগে, তখন সেখানে বড় কোনো ঘটনায় অসংখ্য রোগীও আসেনি। তাহলে কি ঘটেছে? সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) একটিমাত্র টিভি চ্যানেলই ঢুকেছিল সে সময়। একুশে টিভির একটি অনুসন্ধানী দল সেখানে চিকিৎসার অনিয়মের বিষয়ে রোগীর বক্তব্য নিচ্ছিল, সেই সময় বক্তব্য নিতে একজন ডাক্তার বাধা দেন। এরপর তর্কাতর্কি, অত:পর কর্মস্থলে গায়ের জোরই আলাদা, সাংবাদিকদের না পেটালে মিটফোর্ডের ডাক্তার এবং পরিচালকের মান-মর্যাদা থাকে কেমনে?
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ডাক্তারদের মারামারির খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা, তখন তাদের মারপিট করেছেন ডাক্তাররা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে মারামারির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপত্তি।
ধরুন, কোনো হাসপাতালে গিয়ে কোনো সাংবাদিক অপেশাদার আচরণ করলেন, তখন শিক্ষিতজন হিসেবে ডাক্তাররা তাদের মারবেন, না-কি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কিংবা ওই সংবাদ মাধ্যমের কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চাইবেন? সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তো পরিচালক নিজেই মারপিটে জড়িয়ে গেছেন, একুশে টিভির বার্তা প্রধান সেখানে গেলে তাকে বের করে দিয়েছেন, এটা কি কোনো সুস্থ মানুষ সমর্থন করতে পারেন? পরিচালক কি নিজেকে ব্রিটিশ আমলের জমিদার ভাবেন যে, একটা টিভির বার্তা প্রধান তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেলেন? এ যুগে জমিদারি শাসন নেই, সেটাও কিছুক্ষণের মধ্যে পরিচালক টের পেয়েছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ফোন পেয়ে ওই পরিচালকই কিন্তু ভুল স্বীকারও করেন!
সাংবাদিকরা কারও বন্ধুও নন, শত্রুও নন। তারপরও নিজের অজান্তেই অনেকের শত্রু হয়ে যান। আজ একটি সত্য প্রকাশ করলে কারও ম্বার্থের পক্ষে গেলে তিনি খুশি হন, আবার বিপক্ষে গেলে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি তাকে নানা কায়দায় আক্রমণ করে বসেন। সাংবাদিকরা শত সহস্র মানুষের না পাওয়া, দু:খ-বেদনার কথা তুলে ধরেন, কিন্তু নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। অব্যক্ত বেদনার ভার বহন করাই সাংবাদিকের নিয়তি।
আবার যতো পেশাজীবী আছেন, তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সাংবাদিকদের কাজই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ সত্য মেনে নিয়েই সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়। ডাক্তাররা তো তবু রোগীদের জিম্মি করে ধর্মঘট ডেকে প্রতিকার চাইতে পারেন, বিএমএএ তাদের পাশে দাঁড়ায়, সাংবাদিকরা মার খেলে সব সময়ই একাংশের সাংবাদিক নেতারা চুপ থাকেন কিংবা নিচু গলায় কিছু একটা বলে দায়িত্ব শেষ করেন। যতো সাংবাদিক হত্যা হয়েছে, কোনটার বিচার হয়েছে বলুন?
কিছু ডাক্তারের জালিয়াতি, অনিয়মের উদাহরণ সামনে এনে আমরা যেমন বলতে পারি না, সব ডাক্তার দায়িত্বহীন তেমনি ‘আয়নালদের’ উদাহরণ তুলে ধরে বলতে পারেন না, টু-পাইস কামানোর সাংবাদিক দিয়ে দেশ ভরে গেছে! দুর্ভাগ্য হচ্ছে, অনেকে এখনও সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনের ধরনটাই বোঝেন না। যে কারণে কখনও সাংবাদিকদের কিনতে চান, আবার কখনও মারতে চান। নিরেট সত্য হচ্ছে, সাংবাদিকদের কেনাও যায় না, মেরেও দমন করা যায় না।
কোনো রোগীর স্বজন কোনো অনভিপ্রেত আচরণ করলে তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে, ডাক্তাররা তাকে মেরে আহত করে হাসপাতাল থেকে বের করে দিতে পারেন না। কে কোন পেশার বিবেচনা করে হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় একজনকে দিনের পর দিন ফেলে রাখতে পারেন না।
আমি জানি না, মেডিকেল কলেজগুলোতে মানবাধিকারের বিষয় পড়ানো হয় কি-না। যদি না হয়, তাহলে মানবাধিকার বিষয়ে একটা কোর্স বাড়তি পড়ানো উচিত। অন্তত, জাতিসংঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রটা ভালো করে পড়ানো হলে ‘হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার’ সাংবাদিকদের ভূমিকা এবং ডাক্তারদের দায়িত্ব সম্পর্কে ভালো করে বুঝবেন তরুণ ডাক্তাররা। তাহলেই তাদের অযাচিত পেশাগত অহংবোধ এবং অযৌক্তিক আবেগের চর্চা বন্ধ হবে, হাসপাতালে অনেক ঝামেলাও এড়ানো যাবে।
রাশেদ মেহেদী: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৪