নিউয়ইর্কে তখন আমি সদ্য আগত। রাস্তাঘাট চিনি না, কোন বাঙালির সাথে তেমন একটা হাই-হ্যালো নেই, আর পকেট গড়ের মাঠ।
টি এস এলিয়ট তাঁর ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় যেমনভাবে ক্যকটাস, মুরুভূমি আর অন্তসারশূন্যতায় ভরা এক জীবনের বর্ণনা দিয়েছিলেন, আমার কাছে নিউইয়র্ক ছিল সত্যিকার অর্থেই তাই। কিন্তু কি আর করা! জীবনের এই সব আয়োজনের নায়কতো আমি নিজেই। জীবনের এই রং, এই ভূষণ সবাকিছুইতো আমি নিজেই সাজিয়েছি আমার মতন করে। কবি গুরুর ভাষায়, ‘রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি’।
কিন্তু জীবনের এই অরূপ রতনের সন্ধান ক’জন পেয়েছেন বলুন? কিন্তু তারপরও আমরা নিত্য আমাদের খুঁজে বেড়াই, আবিষ্কার করি। বুকে আশা নিয়ে, আকাঙ্খা আর স্বপ্নগুলোকে সযত্নে আগলে ধরে এখানে-সেখানে আমরা এই ছোট্ট জীবনের নোঙর ফেলি।
নিউইয়র্ক এর এস্টোরিয়া ৩৪ স্ট্রিট আর ৪৪তম সড়কের দুবেড রুমের বাসায় গাদাগাদি করে আমরা চারজন প্রাণি কোন রকম মাথা গুঁজে থাকি। এর মধ্যে মজিবুর ভাই এ বাড়ি ও বাড়ি বাঙালি ছেলেমেয়েদের আরবি পড়ান, মাহবুব ভাই ট্যাক্সি চালান, ফজলু ভাই একটা গ্রোসারীর দোকানে কাজ করেন, আর আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেকার।
ফরেন স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকায় এলে এর যে কি জ্বালা-যন্ত্রণা তা ভুক্তভোগীই বলতে পারবেন। টিউশন ফি আকাশ ছোঁওয়া, যুতসই কোন চাকরি বাকরি পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের মত এই ফরেন স্টুডেন্ট নামধারী(যাদের বাপের সাধ্যি নেই তাদের সন্তানদের টাকা-পয়সা দিয়ে কোন সাহায্য সহযোগিতা করা) একদিকে যেমন নুন আনতে পান্তা ফুরায়, অন্যদিকে ‘টিউশন ফি’ নামের বস্তুটি সারাক্ষণ মাথার চারপাশে ভো ভো করে চক্কর দিতে থাকে। প্রতিদিন ‘কাজ’ এর সন্ধানে বের হই, আর মন খারাপ করে আবার সন্ধ্যায় ছোট্ট ঘর নামের এই খোপটায় আস্তানা গাড়ি।
মজার বিষয় হলো প্রতিদিন সন্ধ্যায়ই রুমমেটদের সাথে আমার কাজের সম্ভাব্য ‘আপগ্রেড’ নিয়ে আলোচনা করি। ”‘আরে দেইখ্যেন, একটা কিছু হইয়্যা যাইবো, কোন টেনশন কইরেন না’ ।
আমার রুমমেটদের এ ধরনের অভয়বাণী আমার প্রতিদিনের নিত্যদিনের বাড়তি এক চালিকা শক্তি। কিন্তু এত আশা-ভরসার পরও আমি নিত্য ভাবি শুধু আমার কথা। সত্যি সত্যি চাকরি পাবো তো? এরকম ভাবতে ভাবতেই ঘটনা একটা ঘটল।
আমার প্রতিবেশী টেরি নামের এক ভদ্রলোকের সাথে আমার বেশ সখ্য হয়েছিল। তিনি ছিলেন একটা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। আমি কথায় কথায় একদিন টুক করে তাকে বলে রেখেছিলাম আমার কথাটা। একটা কাজ চাই, ভাই। বাস বয়, ওয়েটার যাই হোক না কেন। টেরি হয়তো আমার করুন চেহারাটা ঠিক তার মাথায় রেখে দিয়েছিলেন।
এক বিকেলে টেরির সাথে দেখা হতেই মুচকি হেসে জানতে চাইলেন, তার রেস্টুরেন্টে কিছু ওয়েটার নেওয়া হবে আর আমি এই কাজটা করতে পারবো কিনা। আমি ব্যাকুলভাবে ‘হ্যাঁ’ বলতেই টেরি ঝটপট আমাকে বলে দিলেন, একটা টক্সেডো প্যান্ট, একটা সার্ট, একটা বো টাই, আর একটা ভালো কালো জুতা লাগাবে। এ’কটা জিনিস নিয়ে আমি যেন তার সাথে শনিবার সকালে দেখা করি।
আমিতো খুশিতে আটখানা। মা লক্ষ্মী বুঝি শেষ পর্যন্ত আমার দিকে তার সদয় দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন! কিন্তু হঠাৎ যেন মাথায় বাজ পড়ল! আরে তাইতো, এই টক্সেডো প্যান্ট-সার্ট-জুতা-মোজা-এসব কিনতে এত্ত টাকা আমি পাবো কোথায়? পকেট যে গড়ের মাঠ। তখন নিউয়ইর্কে চেনা-পরিচিত এমন কেউ নেই যে, যার কাছ থেকে অন্তত দুশ’ টাকা ধার করা যায়।
মনের দুঃখে সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোয় চুপচাপ ঘরে বসে আছি। একে একে আমার সব রুমমেট সন্ধ্যার পাখির মত তাদের নিজ ছোট্ট নীড়ে ফিরতে লাগলেন। আমি চুপচাপ বসে আছি আমার আপন ভুবনে। আমি আমার রুমমেটদের সবার ঘরের খবরই রাখি। সবাই যাকে বলে মজলুম। টাকা-পয়সায় নিয়ে সবাই কমবেশি কষ্টে আছেন। টেনেটুনে কোনমতে অল্প কিছু টাকা বাংলাদেশে প্রিয়জনদের জন্য পাঠান। তাই আমি তাদের কাছে টাকা ধার চাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু এগিয়ে এলেন আমাদের ফজলু ভাই।
আগেই বলেছি, ফজলু ভাই স্থানীয় এক গ্রোসারির দোকানে কাজ করেন। খুব সামান্য কটা টাকা পান। তার উপর বাংলাদেশে তার স্ত্রী অসুস্থ। মোটা অংকের টাকা পাঠাতে হয় তাকে। আমি জানি সে খবর।
আমি জানি, আমাদের ফজলু ভাই আমাকে সাহায্য করতে যে কতটুকু অসহায়! কিন্তু তিনি সেই কাজটি করার জন্যই এগিয়ে এলেন। ফজলু ভাই নাছোড় বান্দা।
আদনান সাব, আপনি এইভাবে মন খারাপ কইরা থাকলে তো চলবো না। কি অইছে কন, দেখি কিছু একটা করন যায় কিনা!
আমাকে শেষ পর্যন্ত বলতে হল সব কথাই। আমার অন্তত দুশ’ টাকা ধার প্রয়োজন। আমি ওয়েটারির কাজে ঢুকেই তা দ্রুত শোধ করে দিতে পারব। আমার এই কথা শুনে ফজলু ভাই কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। আড়াল করে চোখটা মুছলেন। তারপর আমাকে টেনে জোর করে তার রুমে নিয়ে গেলেন।
আদনান সাব, এই কথাডা আপনে আমারে কইবেন না? এই রকম পর ভাবতে পারলেন? এই লন দু’শ’ টাকা। আপনার যখন খুশি তখনই ফেরত দিয়েন।
কিন্তু ফজলু ভাই, আমিতো জানি আপনার এই দু’শ’ টাকা বাংলাদেশে পাঠানোর কথা ছিল আপনার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। আমি সেই টাকাটা আপনার কাছ থেকে নেই কিভাবে?
অস্পষ্ট ভেজা কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু আমাদের ফজলু ভাই আমার আর কোন আপত্তিই শুনবেন না। শেষ পর্যন্ত আমাকে কড়া একটা ধমক দিয়ে দিলেন।
আপনারে আমি আমার ছোট ভাই এর মত দেখি। আমারে যদি বড় ভাই এর মত মানেন তাইলে আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। ইনশাল্লাহ আপনার ভাবীর চিকিৎসা নিয়ে কোন সমস্য অইবো না। আপনি আপনার সুযোগ-সময়মত টাকাটা আবার দিয়ে দিবেন। ঠিক আছে?
আমি আর ’না’ করার সাহস পেলাম না। সেদিন সেই মুহূর্তে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। সেদিনের সেই দু’শ’ টাকা ছিল আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। পরদিন সেই টাকা দিয়ে টক্রিডো প্যান্ট-সার্ট, জুতা-মুজা সব কিছুই কেনা হল। ওয়েটারের কাজটাও পেয়ে গেলাম। প্রথম বেতন পেয়ে সেই ধারের টাকাটা ফজলু ভাই এর হাতেই ফেরত দিলাম। সব কিছুই হল। কিন্তু ফজলু ভাই এর সেই যে আদর মাখা হাত, সেই ভালোবাসায় ভরা দু’টো চোখ, সেই দৃশ্য আমি ভুলি কি করে? অনেকদিন পর্যন্ত ফজলু ভাই এর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল।
কিন্তু সেদিন জানা গেল, তিনি নাকি স্থায়ীভাবেই বাংলাদেশে চলে গেছেন। খবরটা শুনে প্রথমেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আর কোনদিন ফজলু ভাই এর সাথে দেখা হবে না? কিন্তু মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। কারণ ফজলু ভাইতো আছেন আমার হৃদয় মন্দিরে। সারাক্ষণ আর সারাবেলা আমার ভালোবাসার একজন হয়ে। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তিনি থাকবেন আমার সাথেই। আমার প্রাণের বাঙালি ভাইটি হয়ে।
ফজলু ভাই, খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনার কথা। আপনি ভালো আছেন তো? কেন জানি আজ বার বার আপনার চরণ দুটো খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
আদনান সৈয়দ: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রযুক্তিবিদ
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৫