চাইলেও কিছু বিষয় থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবেন না। এই এখন যেমন ভারতের নির্বাচন।
ভারতের নির্বাচনের জ্বরে তারপরও এমন ভূকম্পন শুরু হল! বাংলাদেশের মানুষ কাঁপে, মানুষের রাখালরা কাঁপে, নেতানেত্রীরা কাঁপে, রাজনীতিবিদরা কাঁপে, রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞরা কাঁপে, হিন্দু কাঁপে, মুসলিম কাঁপে। এমন তুমুল কাঁপাকাঁপির মধ্যে আমি না কেঁপে তো পারি না। কারণ আমিও তো সবার মতোই মহা-ভারত আর বঙ্গোপসাগরের চিপার মধ্যে এক চিলতে কম্পমান ভূমির ওপরই দাঁড়িয়ে আছি।
এই রকম পরিস্থিতিতে পড়েই ভারতের নির্বাচন নিয়ে আমাদের সাধারণ ও অসাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াগুলো লক্ষ্য করেছি। কিংবা লক্ষ্য করতে না চাইলেও, চোখ ফিরিয়ে নিলেও, সেগুলো বারবার চোখের সামনে এসে ভারতনাট্যম নাচছে। সেইসব প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় একটা সোজা কথা বলে দেয়া যায়। সেটা হচ্ছে, আমাদের দীনতা-হীনতা আর হীনমন্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে এই নির্বাচনী পরিস্থিতিতে এবং নরেন্দ্র মোদির জয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে ওবামা যখন হয় তখন মনে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নয় আসলে বিশ্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশে ওবামা বা ডেমোক্র্যাটদের যত সমর্থক ছিল মিট রমনি বা রিপাবলিকানদের তত ছিল না। বলা যায়, ওবামার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন ছিল একচেটিয়া। পাশের দেশ মিয়ানমারে যদি নির্বাচন হয় আর অং সান সুচির যদি তাতে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকে, তবে তাতেও সুচির প্রতিও এই দেশের মানুষের তেমন একচেটিয়া সমর্থন থাকবে। তবে ওবামার চেয়ে সূচি নিয়ে হুল্লোড়টা একটু কম থাকবে, এই যা। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যকারণ বিচারে এসব সমর্থনের চেয়ে ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি সমর্থনের হিসেবটা কিছু ক্ষেত্রে এক এবং কিছু ক্ষেত্রে আলাদা। সাম্রাজ্যবাদ ও বৈশ্বিক রাজনীতির অনিবার্য প্রভাব আমরা অস্বীকার করতে পারি না। পারি না বলেই নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা মিয়ানমারে কেউ ক্ষমতায় এলে আমাদের মন খারাপ হয়, আবার কেউ ক্ষমতায় এলে আমাদের মন ভালো হয়।
বাংলাদেশে কথিত প্রগতিশীল কিংবা উদার গণতান্ত্রিক বা অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ানো কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকুক সেটা আমরা চাই বা না চাই, যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে তা থাকুক সেটা আমরা চাই। অন্তত এতদিন ব্যাপারটা এরকমই ছিল। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে বিজেপি যখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এল এবং ২০০২ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকল তখন আমরা খুশি ছিলাম না। ২০০৪ সালে কংগ্রেস প্রথম মেয়াদে এবং ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আমরা খুশি হয়েছিলাম।
এবারের ভারতের নির্বাচন সামনে আসতেই দেখা গেল ব্যাপারটা আর আগের মতো নেই, ব্যাপারটা আর ওবামা বা সুচির মতো নেই। বাংলাদেশের মানুষের কংগ্রেসের প্রতি একচেটিয়া সমর্থনটা আর নেই। কংগ্রেসের পরাজয় হবে এই আশায় কেউ তখন থেকেই লাফাচ্ছিল, আবার কেউ কেউ লাফাচ্ছিল বিজেপি’র জয় হবে এই আশায়। বাংলাদেশের মানুষের এই ধরনের লাফালাফির কারণটা যতটা না ভারত তারচেয়ে বাংলাদেশ, যতটা না কংগ্রেস তারচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগ । গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের মানুষের একাংশের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, কংগ্রেস বিএনপিকে দুচোখে দেখতে পারে না। তারা মনে করছেন, বিজেপি ও মোদি বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাববে, আওয়ামী লীগকে কংগ্রেসের মতো খাতির করবে না, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তারা নতুন করে কলকাঠি নাড়বে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও তাদের হেডোম থাকবে না।
বিজেপির জয়ে আওয়ামী লীগ ভেতরে ভেতরে কোথাও চোট খেয়েছে কি-না সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা তো এত সোজাও নয়। কারণ চোট খেয়ে থাকলে সেটা তাদের দুর্বলতা। তারা তো আর তাদের দুর্বলতাটা দেখিয়ে বেড়াবে না। আওয়ামী লীগের হাবভাবে তেমন কিছু না দেখা গেলেও বিএনপি’র নেতা থেকে কর্মী পর্যন্ত বিজেপির জয়ে একটা উল্লাস আছে। তাদের চোখেমুখে একটা আমোদ ও আশা দেখা যাচ্ছে।
বিজেপির জয়ে বিএনপি’র নেতারা আসলেই আনন্দিত কি-না তা ভাবার ও বিশ্লেষণের বিষয়। তবে তাদের আনন্দটা যে শতভাগ খাঁটি আনন্দ নয়, সেটা কিছু ভাব-লক্ষণে বোঝা যায়। ক্ষমতা নামের বসন্ত না থাকলে রাজনৈতিক দলের বাগান খাঁখাঁ করে।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির আন্ধাচক্করে গুলশানের বাগানে এখন বসন্ত নেই। বসন্তের এই সুদীর্ঘ অনুপস্থিতি বিএনপিকে দুর্বল করে রেখেছে। বাগানের মালিরা মনমরা, ডালিরা ঝিমায়, মৌমাছিরা উড়ে না, ফুল, ফল ও মধুর ক্রেতা ও বিক্রেতারাও তেমন আসে না। এমনকি গুয়ের মাছিরাও সেখানে রসদ পায় না। বিপরীতে ধানমণ্ডির বাগানে চলছে দীর্ঘায়িত বসন্ত। এই রকম পরিস্থিতিতে বাগানবিলাসী সবাইকে আকৃষ্ট করতে বিএনপিকে মাঝে মাঝে কৃত্রিম সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ ছড়াতে হয়।
বিএনপি’র শীর্ষ নেতা থেকে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বিজেপির জয়ে যে আনন্দ তা যেন রাজনৈতিক মনোবিদ্যার আশ্রয়ে এক ধরনের কালাবিদ্যা। তারা বোঝাতে চান যে, মোদি আমাদের লোক। মোদি জিতেছে মানেই আমাদেরও দিন এসে গেছে। আমরাও ফিরে আসছি। নেতাকর্মীদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করা আর জনগণকে বাতাসের ভাও বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বিএনপির এই মেকি আনন্দের আয়োজন একটা মনস্তাত্ত্বিক থ্যারাপি। ভারতের মোদি বা মনমোহন, বিজেপি বা কংগ্রেস কোনো সরকারই তাদের দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে না। আমাদের মতো দেশের রাজনীতিবিদরা তা করলে করতেও পারেন। বিএনপি যদি জানে যে কংগ্রেস তাদের বিরোধী, তবে তারা এটাও জানে যে কংগ্রেস কেন তাদের বিরোধী। সেই কেনটি বা কেনগুলো যতটা না কংগ্রেসবিরোধী তার চেয়ে বেশি ভারতবিরোধী। অতএব মোদিতে আমোদি বিএনপিকে দেখে সমর্থকদের আনন্দিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। সাধারণ জনগণেরও বাতাস উল্টা দিকে বইবে মনে করার কোনো কারণ দেখি না।
মোদির জয়ে কালাবিদ্যা আওয়ামী লীগেরও আছে। তারা যে খুব একটা রা-গা করছে না, তার কারণ, তারাও রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানের একটা কালাবিদ্যার ভেলকি দেখাচ্ছে। সেটা হলো, কংগ্রেস নেই, সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। সোনিয়া গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, শিবশংকর মেননরা নেই তো কী হয়েছে, নরেন্দ্র মোদি, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজরা তো আছেন। আওয়ামী লীগও জনগণ ও তাদের সমর্থকদের আশ্বস্ত করতে চাইছে, তাদের দিকে রাখতে চাইছে এই থোরাই পরোয়া ভাব দিয়ে। কিন্তু দু’দলই তলে তলে জানে, এই ভাবের একটা প্রভাব থাকলেও কূটনৈতিক বাস্তবতা পুরোপুরি এর আওতাধীন নয়।
বিএনপি’র মতোই আনন্দিত হয়েছে বাংলাদেশের আরও একটি গোষ্ঠী। সেটি তাদের জোটের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা অংশ জামায়াত। জামায়াতসহ ১৮ দলের জোটের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবাই মোদীয় আমোদে নড়ছে। আওয়ামী লীগের দুর্দিন মানে তো বিএনপি’র সুদিন, বিএনপি খুশি হলে তো তাদের লেজ বা কান নড়বেই। ধর্মের নামে রাজনীতি করা জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর পালে ফু দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া ধরিয়ে দিয়েছেন হিন্দুত্ববাদী কলির অবতার।
অবাক ব্যাপার হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের সুদিন মানে যারা অন্তত নিজেদের দুর্দিন মনে করেন তারা অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও মোদির ক্ষমতায় আসা দেখে মনে মনে আনন্দিত, তারাও চাঙ্গা বোধ করছেন। বৈপরীত্যের কি অদ্ভূত মিল! বিএনপি-জামায়াত আর সংখ্যালঘুকে কলির অবতার মোদি বাবা তার তেলেসমাতিতে একেবারে এক কাতারে বসিয়ে দিয়েছেন। মোদি যদিও পশ্চিমবঙ্গে এসে নির্বাচনের আগে কড়া ভাষায় সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, ‘যারা বাঙাল আছ, তারা ঘটিবাটি নিয়ে তৈরি হও। ১৬ তারিখের পরে কিন্তু আর দেশে রাখব না। ’ তাতেও তাদের আনন্দে চির ধরেনি। সংখ্যালঘু হিন্দু বাংলাদেশিদের অপেক্ষাকৃত কম সচেতন বড় অংশটা মনে মনে ভাবছে, যাক, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে তাড়া দিলে মোদি বাবা অন্তত তাদের ছেড়ে কথা বলবে না।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট জয়ী হয়ে বিএনপি, ইসলাম ধর্মের নামে রাজনীতি করা তাদের শরিক দলগুলো এবং তাদের ভয়ে তটস্থ থাকা প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে একসঙ্গে ও একযোগে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই রকম আজব ক্ষমতার অধিকারী প্রত্যক্ষ ভারতবিজয়ী ও পরোক্ষ বঙ্গবিজয়ীদের আমাদের মতো নাদানরা ধন্যবাদ ও অভিনন্দন না জানিয়ে কি পারি?
লেখক : গল্পকার, সাংবাদকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৪