ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

যা দেখিনা তা বুঝি না: কামার

কায়সার আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪
যা দেখিনা তা বুঝি না: কামার কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত দশজন উদীয়মান পরিচালকের সঙ্গে কামার আহমাদ সাইমন ও সারা আফরীন

তিনি কামার আহমাদ সাইমন, স্বপ্নবাজ একজন বাঙালি। যিনি স্বপ্নপূরণের জন্য, সেইসাথে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য হাতে তুলে নিয়েছেন ক্যামেরা, স্থপতি থেকে হয়ে উঠেছেন ছবির কারিগর! তারেক মাসুদের পরে কান চলচ্চিত্র উত্সবে তিনি দ্বিতীয় বাংলাদেশি আমন্ত্রিত চলচ্চিত্রকার, যিনি তারেক মাসুদেরই শিষ্য ছিলেন।

ছেলেবেলায় পুরনো ঢাকায় এবং তারুণ্যে বুয়েট ক্যাম্পাসে বেড়ে উঠলেও তার ছবিতে পুরোদস্তুর মাটির ঘ্রাণ।

গত বছর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্য উৎসব 'সিনেমা দ্যু রিলে' শ্রেষ্ঠ ছবির  সর্বোচ্চ পুরষ্কার 'গ্রাঁপ্রি' এবং এ বছর মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ার অন্যতম প্রামাণ্য উৎসব 'মিফে' শ্রেষ্ঠ ছবির সর্বোচ্চ পুরষ্কার 'স্বর্ণশঙ্খ' জয় করেছিলো কামার আহমাদ সাইমনের প্রথম ছবি 'শুনতে কি পাও!'

এর আগে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীণ প্রামাণ্য উৎসব জার্মানীর ডক-লাইপজিগের উদ্বোধনী ছবি এবং বৃহত্তম প্রামাণ্য উৎসব নেদারল্যান্ডের ইডফায় আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেয়েছিলো ছবিটি। গত সপ্তাহে প্যারিসের মর্যাদাপূর্ণ লুক্সার থিয়েটারে হলো বিশেষ প্রদর্শনী।

১৯২১ সালে তৈরি এই থিয়েটারটি প্রায় পঁচিশ বছর বন্ধ থেকে গত বছর থেকে আবার চালু করা হলে রাজনীতি সচেতন তরুণদের কাছে মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় কেন্দ্রে পরিণত হয়ে ওঠে। বর্তমানে থিয়েটারটি শুধু ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকস অথবা আন্তর্জাতিকভাবে পুরষ্কৃত ছবিগুলোই প্রদর্শিত করে থাকে। বিশ্বখ্যাত কম্বোডিয়ান নির্মাতা রিতি পানের নেতৃত্বে, প্যারিসবাসী চলচ্চিত্রকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে "একটি দেশ, একটি ছবি, একজন পরিচালক ও একটি আলোচনা" এর আলোকে গত ১৩ মে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীতে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন।

১৪ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবে নবীন নির্মাতাদের বিশেষ আসর 'লা ফ্যাব্রিক সিনেমা দ্যু মোন্দ ' এও এ বছর আমন্ত্রণ পেয়েছেন পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন ও প্রযোজক সারা আফরীন, তাদের প্রথম ফিকশন চিত্রনাট্য 'শঙ্খধ্বনি'র জন্য। এ বছর ১২৫টি চিত্রনাট্য থেকে নির্বাচিত দশটির প্রযোজক-পরিচালক আমন্ত্রণ পেয়েছেন এই কার্যক্রমে। এই কান, যেখানে তামাম পৃথিবীর সব পুঁজিপতিরা আসেন অবকাশ যাপন করতে। একদিকে আলপ এর পাহাড়, আরেকদিকে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি, এখানেই বসে প্রতিবছরের এই ছবি লীলা, এই নীল জলরাশির ধারে বসে তার সাথে আড্ডায মেতে উঠার ফাঁকে ফাঁকে বলে উঠলেন, চলচ্চিত্র নিয়ে তার ভাবনা বিশেষ করে বাংলাদেশি ছবির ভবিষৎ নিয়ে।

ছবিতে আসার পেছনে কি প্রেরণা?

যদিও রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি, তবে কবিতা লিখতাম ছোটবেলা থেকেই, চারপাশের মুহূর্ত আর ভাবনাগুলো কবিতায় আঁকড়ে ধরার অভ্যেস ছিল। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় এক চীনা চলচ্চিত্র উত্সবে যাওয়ার সুযোগ ঘটে, আর তখন থেকেই চলচ্চিত্র দেখার একটা আসক্তি চলে আসে, কিন্তু তখনো ভাবিনি সিনেমা বানাবো, কিন্তু আরো পরে জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার 'ড্রিমস' ছবিটি দেখার পরে মাথাটা ঘুরে গেলো। মনে হলো শিল্পকলার সবগুলো মাধ্যমকে একসাথে যাচাই করার এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না… মনে হলো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিছু রেখে যাওয়া সম্ভব না, ঠিক করলাম আমি ছবিই বানাবো।

বাংলাদেশে ছবি করার বড় বাধা কি অর্থ?

অর্থ কে বড় বাধা বলার লোক আমি নই। এখানে সবচেয়ে বড় বাধা পেশাদারিত্ব। একটা কাজ সঠিকভাবে করে দেওয়ার লোকের অভাব। একটা চলচ্চিত্রে অনেকগুলো উপাদান থাকে। ফটোগ্রাফি, এডিটিং, সাউন্ড মিক্সিংসহ অনেক কিছু, যেখানে সব ক্ষেত্রে দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তির প্রয়োজন। একজন পরিচালকের পক্ষে একাই সবকিছু করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বেশি যেটা ক্ষতিকর সেটা হলো- একটা ভালো ছবি যদিওবা বানানো গেলো… দেখানোর তেমন কোন ব্যবস্থা নাই।

কলকাতায় বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্র অনেকটা এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশে সম্ভব হচ্ছেনা কেন, যদিও বাংলাদেশের বাজার আরো বড়?

পেশাদারিত্বের অভাব, সেটা পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, প্রদর্শক… সবক্ষেত্রেই। এখন সত্যিই বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ তরুণ দর্শক আছে, যারা সারা পৃথিবীর ছবি দেখছে। কিন্তু চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি টিকবেনা যদি দর্শক হলে গিয়ে  টিকেট কেটে ছবি না দেখে। এই যেমন তারেক মাসুদ তার রানওয়ে ছবির প্রদর্শনীর জন্য প্রজেক্টর সাথে করে সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন এবং প্রচুর সাড়া পেয়েছেন। কিন্তু একজন চলচ্চিত্রকারকে যদি এই কাজ করতে হয় তাহলে তিনি ছবি নিয়ে কাজ করবেন কখন?

আমি মনে করি, চলচ্চিত্র পরিবেশনায় দেশের বড় বড় বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসা উঠিত। ঢাকার বাইরের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগীয় শহরে অন্তত একটা করে মিনি সিনেপ্লেক্স বানালে, দেশি ছবি প্রদর্শনীর নীতিমালা করলে পাঁচ বছরেই পুরো চেহারাটা পাল্টে যেতে পারে।

বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানির ক্ষেত্রে আপনার মতামত?

হলে চলছে না বলে কি আমাদের কোন দর্শকের বিদেশি কোন ছবি দেখা বাদ থাকছে? থাকছে না, বলিউড থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা পর্যন্ত সব ছবিরই এখানে পাইরেটেড ডিভিডি পাওয়া যায়, অথবা ডাউনলোড করে দেখে। সিনেপ্লেক্সেতো এখন সারা বিশ্বের সাথে একইদিন হলিউডের ছবি মুক্তি পাচ্ছে।

এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমি কোন দেশের ছবিরই বিপক্ষে না। বরং চেষ্টা করতে হবে কিভাবে একটা নীতিমালা তৈরি করে এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কাজে লাগানো যায়। যেমন একটা হলে সপ্তাহের কিছু সময়ে বিদেশি ছবি, বাকি সময়ে দেশি ছবি- এভাবে একটা সমন্বয় করলে আদতে আমাদের লাভই হবে। হল মালিকদের কাছ থেকে বিদেশি ছবির জন্য বেশি ট্যাক্স এবং দেশি ছবির জন্য কম ট্যাক্স নিলে ব্যাপারটা আমাদের হাতের নাগালেই থাকবে এবং অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে না, হল মালিকরাও বাঁচবে।

এবার আপনার ভবিষত পরিকল্পনা বলুন?

কাজটা না করেই তা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না, এটা একটা বাজে সংস্কৃতি। আমি আমার মত করে চলচ্চিত্র বানাতে চাই, আমার মত করে কাজটা করতে চাই। আমার চারপাশের জাগতিক পৃথিবী, যেখানে মানুষ হাসে, কাঁদে, কথা বলে… সেটাই আমার বিষয়। আমি যা দেখিনা, তা বুঝি না… বাকিটা সময়েই বলে দেবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৪ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।