ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কি ঘুমিয়ে!

ড. জিনিয়া জাহিদ, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৪
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কি ঘুমিয়ে! শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ

আজকাল ফেসবুকের মাধ্যমে যেকোনো সংবাদ অতি দ্রুত সবার কাছে পৌছে যায়। আমার যেহেতু কোনো ফেসবুক একাউন্ট নেই, তাছাড়া দেশের বাইরে থাকার কারণে টিভি ও পেপার মিডিয়ায় একসেস নেই, কাজেই সংবাদের জন্য অনলাইন পোর্টালগুলিই আমার প্রধান ভরসা।


 
দেশ সেরা অনলাইন পোর্টাল বাংলানিউজে এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটি নিয়ে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের নিবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। সেখানেই জানতে পারলাম, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে- আর সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ফেসবুকের মাধ্যমে ঘরে ঘরে সবার কাছে পৌছে যাচ্ছে! এমনকি উত্তরপত্রও নাকি ফেসবুকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে।

jafor_iqbalড. জাফর ইকবালের লেখা নিবন্ধের কারণে সমগ্র দেশবাসীর টনক নড়লেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারও যে বিন্দুমাত্র টনক নড়েনি, তা পরপর আরো দু’টি নিবন্ধের মাধ্যমেই জানতে পারলাম। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ হিসেবে পরীক্ষার আগে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ও পরীক্ষা হয়ে যাওয়া প্রশ্ন যে হুবহু এক তার স্ন্যাপশটও তার নিবন্ধে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটার একটা সুষ্ঠু সমাধান, তা বন্ধ করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রশ্ন ফাঁসের মত অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে দুর্নীতির বীজ বপন করে তাদের ভবিষ্যত জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে না দেয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন।

শিক্ষামন্ত্রীও ড. জাফরের লেখার জবাব দিলেন পত্রিকার মাধ্যমেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রশ্ন ফাঁসের পক্ষে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ‘প্রমাণ’ গুলোকে শিক্ষামন্ত্রী নিছক সাজেশন বলেই উড়িয়ে দিলেন! কথা হলো, সাজেশনই যদি হয়ে থাকে তবে তা হুবহু মিলে গেল কিভাবে?
 
গত ১০ এপ্রিল ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পর থেকে যেহেতু পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, কাজেই শিক্ষামন্ত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস, প্রশ্ন ফাঁসের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।  
 
অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। তাহলে কে ফাঁস করছে, এই ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিয়ে কেন তিনি ব্যাপারটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন?

আর যদি গুজবই হয়ে থাকে তবে সেই সাথে সন্দেহভাজন হিসেবে কেন তিনি কোচিং বাণিজ্যে জড়িত এবং ব্যবসাভিত্তিক সরকারবিরোধী মহলকে দায়ী করে ব্যাপারটিকে হালকা করতে চাইছেন? যদি তিনি কাউকে সন্দেহ করে থাকেন তবে দ্রুত তাদের গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করছেন না কেন?

nurul_islam_nahidআমরা  দেখেছি, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে ঘুরে পরীক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে অনেক পছন্দ করেন। তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের বেতনভুক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার পাশাপাশি পরীক্ষার্থীদের সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা কথা বলছেন না কেন? জাফর ইকবাল সাহেবের কাছে তদন্ত কমিটির লোক না পাঠিয়ে ওনাকেসহ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের ডেকে কেন কথা বলছেন না?
 
শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকেই জানা গেল, প্রশ্ন ফাঁসের তদন্তের জন্য নাকি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন জানি ইদানিং "তদন্ত কমিটি" শব্দ দু’টি শুনলেই হাসি পায়। এই তদন্ত কমিটির কথা বলা মানেই সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া। কারণ এসব তদন্ত কমিটি কালক্ষেপণ করে জনগণের "আই ওয়াশ" ছাড়া আর কিছুই করে না। অনির্দিষ্ট (?) কালের জন্য গঠন করে দেয়া এসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদৌ আলোর মুখ দেখে কি? 

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমরা সাধারণ জনগণ বিনীতভাবে জানতে চাইছি, কে আসলে সত্য কথা বলছেন- আপনার মন্ত্রণালয় নাকি ড. জাফর ইকবাল?

আর কত প্রমাণ পেলে আপনি স্বীকার করে নেবেন যে, আপনার মন্ত্রণালয়ের “কেউ কেউ” প্রশ্ন ফাঁস করে দিচ্ছে!

মাননীয় মন্ত্রী, আপনি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন? আর ভাবছেন, আপনার মন্ত্রণালয়ে যারা আপনার সাথে কাজ করছেন তারা সবাই আপনার মতই সৎ? তাহলে আপনার কাছে অনুরোধ, ঘুম থেকে জেগে উঠুন। চোখ মেলে ভালো করে দেখুন, এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ত আপনার অতি আস্থাভাজন কেউ করছে।

হতে পারে, যে প্রেস থেকে প্রশ্ন ছাপানো হয়, সেই প্রেসের কেউ ফাঁসের সাথে জড়িত। হতে পারে, যে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশ্ন সেট চাওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ, হতে পারে প্রশ্ন সম্পাদনা কমিটির মধ্যে কেউ। দয়া করে এরকম সম্ভাব্য “হতে পারে”-দের দ্রুত খুঁজে বের করুন।

question_smজানি, প্রশ্নফাঁস স্বীকার করে নিলে অনেকগুলো পরীক্ষা বাতিল করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরাও হয়ত পুনরায় পরীক্ষা দেবার বিষয়টিতে তেমন সাড়া নাও দিতে পারে। খরচের বিষয়টাও একটি ফ্যাক্টর। কিন্তু কথা হলো, চুপ থেকে এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়াটাও তো কোনো সমাধান নয়।

সমস্যার শুরু যেহেতু মন্ত্রণালয়ের "কেউ" করেছে, কাজেই এর সুষ্ঠু সমাধান মন্ত্রাণালয়কেই খুঁজে বের করতে হবে। সমস্যার মূল উত্পাটন না করে শুধু শুধু অদৃশ্য চক্রান্তকারীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?

আমরা চাই দুর্নীতির পথে লক্ষ লক্ষ জিপিএ ৫ বাড়ানোর জন্য বাহবা না কুড়িয়ে, শিক্ষামন্ত্রণালয় প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন করুক। আর এজন্য সবার আগে শিক্ষামন্ত্রী আপনাকে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সবাই "অতি সৎ" "প্রশ্নফাঁস বিরোধীদের চক্রান্ত" এই জাতীয় অলিক দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে হবে।
   
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, প্রশ্ন ফাঁসের এই ব্যাপারে আপনি ঘুমিয়ে আছেন, নাকি জেগে আছেন জানি না। যদি জেগে থাকেন তাহলে হয়ত জেনে থাকবেন, শহীদ মিনারে ড. জাফর ইকবাল এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ভুক্তভোগী ছাড়াও সচেতন সবাই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হবেই হবে। এদেশে তীব্র আন্দোলন ছাড়াও যে সমস্যার সমাধান করা যায়, তা অন্তত আপনি দেখিয়ে দিন।

তবে উপরের নির্দেশে আপনি যদি ঘুমিয়ে থাকেন, তা হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে আপনার নিশ্চুপ থেকে চেয়ারে শক্তভাবে বসে থাকা ছাড়া আর কি-ই-বা করার আছে!!

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৩ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।